সনাতন ধর্মে ব্রত-উপবাসকে আত্মিক শুদ্ধি এবং ঈশ্বর ভক্তির সবচেয়ে শক্তিশালী মাধ্যম হিসেবে মনে করা হয়। সারা বছর ধরে মোট ২৪টি একাদশী পালিত হয়, কিন্তু এর মধ্যে জ্যৈষ্ঠ শুক্ল পক্ষের একাদশী, যাকে নির্জলা একাদশী বলা হয়, বিশেষভাবে কঠিন এবং পুণ্যময় বলে মনে করা হয়। এই ব্রত তপ, ত্যাগ এবং সংযমের প্রতীক, কারণ এই দিনে ব্রত পালনকারী ব্যক্তি জল পর্যন্ত গ্রহণ করেন না, তাই এর নাম ‘নির্জলা’ রাখা হয়েছে। এই ব্রত মানসিক, শারীরিক এবং আত্মিক অনুশাসনের অনন্য উদাহরণ বলে মনে করা হয়।
নির্জলা একাদশী ২০২৫: ব্রত তিথি এবং শুভ মুহূর্ত
বৈদিক পঞ্জিকা অনুযায়ী ২০২৫ সালে নির্জলা একাদশী ৬ জুন পালিত হবে। এই তিথি ৬ জুন রাত ২:১৫ টা থেকে শুরু হয়ে ৭ জুন সকাল ৪:৪৭ টা পর্যন্ত থাকবে। যেহেতু একাদশী তিথির আরম্ভ ৬ জুন হচ্ছে, তাই ব্রতও ৬ জুনই রাখা হবে। এই দিনে ব্রতীকে সূর্যোদয়ের আগে উঠে স্নান করে, সংকল্প করে ব্রতের আরম্ভ করতে হবে এবং ভগবান বিষ্ণুর পূজা-অর্চনা করতে হবে।
ব্রতের কঠিনতা এবং তার গুরুত্ব
নির্জলা একাদশীর ব্রত সকল একাদশীর মধ্যে সবচেয়ে কঠিন বলে মনে করা হয়, কারণ এই দিনে শুধুমাত্র অন্ন ও ফলের ত্যাগ করা হয় না, বরং জলও পান করা যায় না। এই ব্রত বিশেষ করে জ্যৈষ্ঠ মাসে পড়ে, যখন গরম চরমে থাকে, তখন পানি ছাড়া থাকা একটি বড় তপস্যা। এই কারণেই একে মহাব্রত বা মহাএকাদশীও বলা হয়। এটি কেবল শরীরকে কষ্ট দেওয়ার অনুশীলন নয়, বরং নিজের মন, বাক্য এবং ইন্দ্রিয়ের উপর নিয়ন্ত্রণ রাখার সাধনা।
এই ব্রতের গুরুত্ব শুধুমাত্র উপবাস রাখার চেয়ে অনেক বেশি। এটি আত্মার শুদ্ধি এবং ঈশ্বরের প্রতি সমর্পণের প্রক্রিয়া। যাদের পুরো বছর ২৪টি একাদশীর ব্রত পালন করা সম্ভব হয় না, তাদের জন্য নির্জলা একাদশীর ব্রত বিশেষ ফলদায়ক বলে মনে করা হয়। বিশ্বাস করা হয় যে এই দিনে শ্রদ্ধা এবং নিয়মিতভাবে ব্রত পালন করলে সারা বছরের সকল একাদশীর পুণ্য একসাথে লাভ করা যায়। यही কারণে এ ব্রতকে সংযম, ভক্তি ও আস্থার অনন্য সংগম বলে মনে করা হয়।
भीमसेन से जुड़ी पौराणिक कथा
পৌরাণিক গ্রন্থ অনুযায়ী, নির্জলা একাদশী ব্রতের সূচনা মহাভারতের বীর যোদ্ধা ভীমসেনের সাথে জড়িত। ভীম, যিনি পাণ্ডবদের মধ্যে সবচেয়ে বলশালী এবং খাদ্যপ্রিয় ছিলেন, কোন একাদশীতেই উপবাস করতে পারতেন না। তিনি প্রতিদিন প্রচুর পরিমাণে খাবার গ্রহণ করতেন এবং ব্রতের সময় ক্ষুধার্ত থাকা তার জন্য অত্যন্ত কঠিন ছিল। কিন্তু যখন তিনি দেখলেন যে তার অন্যান্য ভাই—যুধিষ্ঠির, অর্জুন, নকুল এবং সহদেব—নিয়মিতভাবে একাদশী ব্রত রাখেন এবং ভগবান বিষ্ণুর কৃপা লাভ করছেন, তখন তিনি চিন্তিত হলেন যে তিনি এই পুণ্য থেকে বঞ্চিত হবেন না।
তার দুঃখ নিয়ে তিনি মহর্ষি ব্যাসের কাছে গেলেন এবং সমাধান চাইলেন। তখন ব্যাসদেব তাকে একটিমাত্র ব্রত পালনের পরামর্শ দিলেন—যা সারা বছরের সকল একাদশীর সমান পুণ্য প্রদান করে। এটি ছিল নির্জলা একাদশীর ব্রত, যাতে শুধুমাত্র অন্ন ও ফলের ত্যাগ নয়, বরং জলেরও সেবন নিষিদ্ধ। ব্যাসদেব বললেন, যদি ভীম একদিনের জন্যও তার খাদ্যের মোহ জয় করতে পারে এবং পূর্ণ শ্রদ্ধা সহকারে এই ব্রত পালন করে, তাহলে তাকে পুরো বছরের সকল একাদশীর ফল পাওয়া যাবে।
ভীম সাহস করে এই ব্রত রাখলেন এবং তা পূর্ণ নিষ্ঠার সাথে পালন করলেন। তিনি পানি পান না করে এই কঠিন ব্রত পালন করলেন, যার ফলে তিনি আধ্যাত্মিক লাভের সাথে সাথে ভগবান বিষ্ণুর বিশেষ কৃপা লাভ করলেন। তখন থেকেই এই ব্রতকে ভীমসেনী একাদশী বা পাণ্ডব একাদশীও বলা হয়। এই কথা আজও বলে যে, সত্যিকারের সংকল্প এবং শ্রদ্ধা দিয়ে অসম্ভবও সম্ভব হয়ে ওঠে।
क्या इस दिन पानी पी सकते हैं?
নির্জলা একাদশীর নাম থেকেই স্পষ্ট যে, এই দিনে জলেরও সেবন করা যায় না। কিন্তু কিছু বিশেষ পরিস্থিতিতে জল গ্রহণের ছাড় দেওয়া হয়েছে, যেমন:
- পূজনের সময় আচমানের জন্য: পূজা করার সময় তিনবার আচমান করার প্রথা আছে, যাতে অতি সামান্য পরিমাণে জল নেওয়া হয়। এটি ব্রতকে ভঙ্গ করে না।
- শারীরিক দুর্বলতা বা অসুস্থতার অবস্থায়: যদি ব্রতধারী অসুস্থ হন বা অত্যধিক দুর্বলতা অনুভব করেন, তাহলে ধর্মশাস্ত্রে সামান্য পরিমাণে জল পান করার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। তবে এটিকে পূর্ণ ব্রত বলে মনে করা হবে না।
- সূর্যাস্তের আগে জল গ্রহণ করা উচিত: যদি ব্রতধারীকে জল নেওয়া প্রয়োজন হয়, তাহলে তিনি সূর্যাস্তের আগে পূজা বা অর্ঘ্যের সময় তা নিতে পারেন। সূর্যাস্তের পর জল পান করা উপযুক্ত নয়।
ব্রতের পারণ কীভাবে করবেন?
নির্জলা একাদশী ব্রতের সমাপ্তি অর্থাৎ পারণ দ্বাদশী তিথির দিন করা হয়, যা একাদশীর পরের দিন আসে। এই দিন সকালে সূর্যোদয়ের পর, যখন দ্বাদশীর শুভ মুহূর্ত হয়, তখন ব্রতধারীকে ব্রত ভাঙ্গা উচিত। পারণ করার সময় কিছু বিষয়ের দিকে লক্ষ্য রাখা প্রয়োজন:
- পারণের সময়: ব্রত ভাঙ্গার সঠিক সময় দ্বাদশী তিথিতেই হয়। যদি দ্বাদশী চলে যায়, তাহলে ব্রত অসম্পূর্ণ বলে মনে করা হয়। তাই সময় দেখে ব্রতের পারণ করুন।
- ব্রাহ্মণকে দান-দক্ষিণা: পারণের আগে ব্রাহ্মণকে ভোজন করানো, জল দেওয়া বা কোনো দান দেওয়া শুভ বলে মনে করা হয়। এতে ব্রতের পুণ্য অনেক গুণ বৃদ্ধি পায়।
- ফলাহার বা হালকা খাবার: ব্রত ভাঙ্গার সময় ব্রতীকে প্রথমে পরিষ্কার জল পান করা উচিত, তারপর ফল, দুধ বা হালকা ফলাহার করে ব্রত সমাপ্ত করতে হবে। খুব ভারী খাবার খেলে শরীরের উপর প্রভাব পড়তে পারে।
- ভগবান বিষ্ণুর স্মরণ: ব্রত ভাঙ্গার আগে ভগবান বিষ্ণুর পূজা করুন এবং ধন্যবাদ জানান যে তিনি এই কঠিন তপস্যা সম্পূর্ণ করার শক্তি দিয়েছেন।
নির্জলা একাদশী পূজা বিধি
নির্জলা একাদশী ভগবান বিষ্ণুকে উৎসর্গীকৃত একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্রত, যাতে জল গ্রহণ না করে পুরো দিন উপবাস রাখা হয়। এটি বিধিপূর্বক করলে বিশেষ ফল পাওয়া যায়।
- পূজার প্রস্তুতি: নির্জলা একাদশীর দিন সকালে তাড়াতাড়ি উঠে পরিষ্কার করে স্নান করুন এবং পরিষ্কার কাপড় পরুন। তারপর পূজার জায়গাটি ভালো করে পরিষ্কার করে ভগবান বিষ্ণুর ছবি বা মূর্তি রাখুন। পূজার জন্য ফুল, দীপ, আগরবাতি, ফল এবং প্রসাদও প্রস্তুত রাখুন।
- পূজা আরম্ভ করুন: পূজার শুরু ‘ॐ नमो भगवते वासुदेवाय’ মন্ত্র বলে করুন। তারপর ভগবান বিষ্ণুর ছবি বা মূর্তিতে হলুদ, কেসর এবং তিলক লাগান। এরপর দীপ জ্বালান, আগরবাতি ধরুন এবং ফুল চড়ান।
- ব্রতের পালন: এই দিন সম্পূর্ণরূপে খাবার এবং পানি থেকে বিরত থাকুন। শুধুমাত্র পূজার সময় তিনবার অল্প জল আচমানের জন্য পান করতে পারেন, এতে ব্রত ভেঙে না। যদি স্বাস্থ্য খারাপ হয় তাহলে অল্প পানি পান করাও ঠিক।
- আরতি এবং প্রার্থনা: সন্ধ্যায় ভগবান বিষ্ণুর আরতি করুন এবং মনে মনে তাঁর কাছে ধন্যবাদ জানান। এই সময় ভগবানের কাছে সুখ, সমৃদ্ধি এবং সুস্বাস্থ্যের জন্য প্রার্থনা করুন। সাথে সাথে ব্রতের নিয়মগুলি সঠিকভাবে পালনের শপথও নিন।
- ব্রত ভাঙ্গা: নির্জলা একাদশীর ব্রত পরের দিন সূর্যোদয় অথবা দুপুরে ভাঙ্গুন। প্রথমে হালকা খাবার খান এবং ধীরে ধীরে জল পান করুন। ব্রত ভাঙ্গার সময় ভগবানের কাছে ধন্যবাদ জানানো অবশ্যই মনে রাখবেন।
নির্জলা একাদশীর আধ্যাত্মিক গুরুত্ব
নির্জলা একাদশীর ব্রত শুধুমাত্র একটি ধর্মীয় প্রথা নয়, বরং এটি একটি আধ্যাত্মিক সচেতনতা এবং আত্ম-অনুশাসনের পন্থাও। এই ব্রতের সময় শরীরকে তপস্যা করা হয় যাতে আত্মাকে শক্তিশালী করা যায়। এই ব্রত আমাদের শেখায় কীভাবে আমাদের ইন্দ্রিয়ের উপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে হয়, যেমন খাদ্য এবং পানির প্রয়োজনীয়তা ত্যাগ করে ভগবানের প্রতি পূর্ণ ভক্তি ও সমর্পণের অনুশীলন করা হয়। এতে ব্যক্তি তার সাংসারিক বন্ধন থেকে উঠে আধ্যাত্মিক উন্নতির দিকে এগিয়ে যায়।
মনে করা হয় নির্জলা একাদশীর ব্রত পালন করলে ব্যক্তির পাপ থেকে মুক্তি মেলে এবং তার জীবনে ইতিবাচক শক্তির সংযোগ হয়। এই সাথে সাথে এই ব্রত অক্ষয় পুণ্যের উৎসও বলে মনে করা হয়। অনেক ধর্মীয় বিশ্বাস অনুযায়ী, এই ব্রতের সঠিক পালন করলে ব্যক্তি মোক্ষের প্রাপ্তি করে এবং সে ভগবান বিষ্ণুর বৈকুণ্ঠধামে স্থান পায়। তাই নির্জলা একাদশী ব্রতের আধ্যাত্মিক গুরুত্ব অত্যন্ত গভীর এবং প্রভাবশালী।
যদি আপনি সংযম, শ্রদ্ধা এবং তপস্যার শক্তিকে আত্মস্থ করতে চান, তাহলে নির্জলা একাদশী ব্রত আপনার জন্য একটি শক্তিশালী মাধ্যম হতে পারে। এই ব্রত শুধুমাত্র ধর্মীয় দিক থেকে নয়, আত্মিক শুদ্ধির জন্যও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যারা সারা বছর একাদশী রাখতে পারে না, তারা কেবল এই একটি ব্রত রেখে সারা বছরের পুণ্য লাভ করতে পারে। এই কারণেই একে বছরের সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ একাদশী বলে মনে করা হয়।