মহাভারতের অত্যন্ত প্রসিদ্ধ এক কাহিনী আছে যেখানে গান্ধারী দুবার তার চোখের পট্টি খুলেছিলেন। এই কাহিনী সম্পর্কে প্রায়ই শুধুমাত্র এটাই বলা হয় যে তিনি একবার তার চোখের পট্টি খুলেছিলেন, যখন তিনি যুদ্ধে তার পুত্র দুর্যোধনকে বিজয়ী দেখার ইচ্ছায় এই পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। কিন্তু আসলে এই ঘটনা দুবার ঘটেছিল। আসুন, জেনে নেই এই কাহিনী সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে এবং বুঝে নেই কেন এটি ঘটেছিল।
গান্ধারী কে ছিলেন?
গান্ধারী মহাভারতের একজন প্রধান চরিত্র ছিলেন। তিনি ধৃতরাষ্ট্রের স্ত্রী এবং দুর্যোধনের মা ছিলেন। তার জন্ম কাশীরাজের গৃহে হয়েছিল। গান্ধারী তার স্বামী ধৃতরাষ্ট্রের অন্ধত্বের কারণে তার চোখে পট্টি বেঁধেছিলেন, যাতে তিনি তাঁর সাথে সমান জীবনযাপন করতে পারেন। তিনি ভগবান শিবের ভক্ত ছিলেন এবং তিনি এক বিশেষ বর পাওয়া ছিলেন, যার মাধ্যমে তিনি তার পুত্র দুর্যোধনের দেহকে বজ্রের মতো কঠিন করার জন্য দিব্য দৃষ্টি ব্যবহার করেছিলেন। তাঁর গল্প ত্যাগ, সমর্পণ এবং মাতৃভক্তির প্রতীক।
গান্ধারীর কত পুত্র ছিল?
গান্ধারীর ১০০ জন পুত্র ছিলেন, যাদের মধ্যে সবচেয়ে প্রধান ছিলেন দুর্যোধন। দুর্যোধন মহাভারতের প্রধান চরিত্রদের একজন এবং কৌরবদের নেতা ছিলেন। তার বাইরে, গান্ধারীর অন্যান্য পুত্রদের মধ্যে দুশ্যন্ত, দুঃশাসন, বিকর্ণ এবং আরও অনেক কৌরব অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। এই ১০০ পুত্রের প্রত্যেকেরই নিজস্ব গুরুত্ব ছিল, কিন্তু দুর্যোধনের নাম সবচেয়ে বেশি বিখ্যাত হয়েছিল, কারণ তিনিই মহাভারত যুদ্ধের প্রধান কারণ হয়েছিলেন এবং পান্ডবদের সাথে যুদ্ধের সূচনা করেছিলেন। গান্ধারীর সকল পুত্র যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল এবং তাদের অধিকাংশেরই মৃত্যু হয়েছিল মহাভারত যুদ্ধে। গান্ধারীর মাতৃত্ববোধ এবং তার পুত্রদের প্রতি অপার প্রেম মহাভারতে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান ধারণ করে।
গান্ধারী কেন চোখে পট্টি বেঁধেছিলেন?
গান্ধারী তার স্বামী ধৃতরাষ্ট্রের প্রতি গভীর প্রেম এবং সমর্পণ প্রদর্শনের জন্য তার চোখে পট্টি বেঁধেছিলেন। ধৃতরাষ্ট্র জন্মগতভাবেই অন্ধ ছিলেন এবং এটা জেনে গান্ধারী অত্যন্ত দুঃখিত হয়েছিলেন। কিন্তু তিনি স্থির করেছিলেন যে যখন তার স্বামী পৃথিবী দেখতে পারছেন না, তখন তিনিও তার চোখ দিয়ে কিছু দেখবেন না। তিনি তার পুরো জীবন এই সংকল্প পালন করে তার চোখে পট্টি বেঁধেছিলেন।
এই সমর্পণ শুধুমাত্র একজন স্ত্রীর তার স্বামীর প্রতি প্রেম ছিল না, বরং এটি ছিল তাঁর বিশ্বাস এবং সমর্থনও। গান্ধারীর এই পদক্ষেপ ছিল তার স্বামীর সাথে সমানতা অনুভব করার, যাতে তিনি জীবনে তার স্বামীর অবস্থার অনুভূতি পেতে পারেন। এই সিদ্ধান্ত গান্ধারীকে একজন আদর্শ স্ত্রী এবং নারী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। তাঁর এই অনুভূতি আমাদের শেখায় যে প্রেম এবং সমর্পণে শক্তি আছে, যা আমাদের প্রিয়জনদের সাথে কঠিন সময় পার করার অনুপ্রেরণা দেয়।
গান্ধারী প্রথমবার তার পট্টি কখন খুলেছিলেন?
মহাভারতের যুদ্ধের সময়, যখন দুর্যোধন তার মা গান্ধারীর কাছ থেকে সাহায্য চেয়েছিল, তখন গান্ধারী তার দিব্য দৃষ্টি ব্যবহার করেছিলেন। ভগবান শিবের কাছ থেকে প্রাপ্ত এক বরদানের কারণে, তিনি যেকোনো ব্যক্তির দেহকে বজ্রের মতো কঠিন করতে পারতেন। দুর্যোধন, যিনি যুদ্ধে বিজয়ী হতে চেয়েছিলেন, তার মা কাছ থেকে এই আশীর্বাদ চেয়েছিলেন, যাতে তার দেহ বজ্রের মতো শক্তিশালী হয় এবং যুদ্ধে তাকে কেউ পরাজিত করতে না পারে।
গান্ধারী তার ছেলে দুর্যোধনের দেহকে বজ্রের মতো কঠিন করার জন্য তার দিব্য দৃষ্টি ব্যবহার করেছিলেন। একই সময়ে, তিনি তার চোখের পট্টি খুলেছিলেন। তবে, ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তার চাতুর্যের মাধ্যমে দুর্যোধনের দেহকে শুধুমাত্র কোমর পর্যন্ত বজ্রের মতো কঠিন করেছিলেন, যার ফলে সে পুরোপুরি রক্ষা পায়নি। ফলস্বরূপ, দুর্যোধন পরাজিত হয়ে যুদ্ধে তার প্রাণ হারিয়েছিলেন। এই ঘটনা গান্ধারীর পট্টি খোলার প্রথম কারণ হয়েছিল এবং এটি মহাভারত যুদ্ধের দিকনির্দেশনাকে প্রভাবিত করেছিল।
গান্ধারী দ্বিতীয়বার তার পট্টি কখন খুলেছিলেন?
মহাভারত যুদ্ধের পর, যখন গান্ধারী এই দুঃখজনক সংবাদ পেয়েছিলেন যে তার প্রিয় পুত্র দুর্যোধনের মৃত্যু হয়েছে, তখন তিনি অত্যন্ত দুঃখিত হয়েছিলেন। একজন মায়ের জন্য তার ছেলের মৃত্যুর সংবাদ শোনা সবচেয়ে বেশি বেদনাদায়ক ছিল। তার ছেলের মৃতদেহ দেখার ইচ্ছায়, গান্ধারী যুদ্ধক্ষেত্রে গিয়েছিলেন। সেই সময় তিনি দ্বিতীয়বার তার চোখের পট্টি খুলেছিলেন, যাতে তিনি তার পুত্রকে শেষবার দেখতে পারেন।
এটি ছিল একজন মায়ের প্রেম, যা তাকে তার পুত্রকে দেখার জন্য এত বড় পদক্ষেপ নিতে বাধ্য করেছিল। এই ঘটনা অত্যন্ত ভাবপ্রবণ ছিল এবং মহাভারতের একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হয়ে উঠেছে। গান্ধারীর এই পদক্ষেপ শুধুমাত্র একজন মায়ের প্রেমই প্রকাশ করে না, বরং এটি তার নিষ্ঠা, সমর্পণ এবং তার ধর্মের প্রতি তার বিশ্বাসেরও প্রতীক ছিল। তিনি তার চোখে পট্টি বেঁধে পৃথিবী থেকে বিরত থাকতেন, কিন্তু যখন তার ছেলের কথা এলো, তখন তিনি তার বিশ্বাস এবং মমত্বের কারণে তার পট্টি খোলার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।
গান্ধারীর সমর্পণের গুরুত্ব
গান্ধারীর সমর্পণ এবং তার অনুভূতি আমাদের শেখায় যে জীবনে অন্যের প্রতি সম্পূর্ণভাবে নিবেদিত থাকা সম্ভব। তার এই সমর্পণ শুধুমাত্র তার স্বামী ধৃতরাষ্ট্রের জন্যই ছিল না, বরং তার পুত্র দুর্যোধনের জন্যও ছিল। গান্ধারী তার স্বামীর জন্য তার চোখে পট্টি বেঁধেছিলেন এবং তার সন্তানদের জন্য দিব্য দৃষ্টি ব্যবহার করেছিলেন। তার ভগবানের প্রতি বিশ্বাস এবং ভক্তি অত্যন্ত গভীর ছিল, কিন্তু যখন তার সন্তানদের কথা এলো, তখন তার মাতৃত্ববোধ তাকে তার সংকল্প ভঙ্গ করতে বাধ্য করেছিল।
গান্ধারীর কাহিনী এটিও শেখায় যে জীবনে ভারসাম্য বজায় রাখা জরুরি। কখনও কখনও আমাদের আমাদের অনুভূতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে হয় এবং বিবেকের সাথে কাজ করতে হয়। গান্ধারী তার পুত্রের জন্য দিব্য দৃষ্টি ব্যবহার করেছিলেন, কিন্তু এর ফলাফল হলো সে শেষ পর্যন্ত পরাজিত হয়েছিল। এটি দেখায় যে যেকোনো শক্তির ব্যবহার সঠিক সময় এবং সঠিক পদ্ধতিতে করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সমর্পণ এবং বিশ্বাসের সঠিক ভারসাম্যই জীবনে সফলতা এবং শান্তি আনতে পারে।
মহাভারতে গান্ধারীর ভূমিকা কী ছিল?
মহাভারতে গান্ধারীর ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তিনি ধৃতরাষ্ট্রের স্ত্রী এবং দুর্যোধনের মা ছিলেন। গান্ধারী তার স্বামীর অন্ধত্বের কারণে নিজেও তার চোখে পট্টি বেঁধেছিলেন, যাতে তিনি তার চোখ দিয়ে পৃথিবী দেখতে না পারেন, যেমনটি তার স্বামী দেখতে পারেননি। তার এই সমর্পণ এবং ত্যাগ তার পরিবারের প্রতি গভীর প্রেম এবং নিষ্ঠার প্রতীক ছিল।
গান্ধারীর ভূমিকা শুধুমাত্র একজন স্ত্রী এবং মায়ের ছিল না, বরং একজন সशক্তিশালী নারীরও ছিল, যিনি তার পরিবারের জন্য তার জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। তার পুত্র দুর্যোধনের দৃঢ় ইচ্ছাশক্তি এবং মহাভারত যুদ্ধে বিজয়ের আকাঙ্ক্ষাকে পূরণ করার জন্য তিনি ভগবান শিবের কাছ থেকে প্রাপ্ত তার দিব্য দৃষ্টি ব্যবহার করেছিলেন।
যদিও তার এই পদক্ষেপ শেষ পর্যন্ত দুর্যোধনের জন্য ক্ষতিকারক প্রমাণিত হয়েছিল, তবে তার এই সমর্পণ তার প্রেম এবং বিশ্বাসকে প্রকাশ করে। মহাভারতে গান্ধারীর ভূমিকা শুধুমাত্র একজন মাতৃশক্তির ছিল না, বরং একজন মায়ের দুঃখ এবং সংগ্রামের সাথেও জড়িত ছিল।
```