২০২৫ সালের বকরিঈদ: ঐতিহ্য, কোরবানি ও সমাজসেবার বার্তা

🎧 Listen in Audio
0:00

বকরিঈদ, যাকে ঈদ-উল-আযহা বা ঈদ-উল-জুহা নামেও জানা যায়, ইসলাম ধর্মের একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎসব। এই উৎসব কেবলমাত্র ধর্মীয় কার্যক্রমে সীমাবদ্ধ নয়, বরং এর মধ্যে মানবতা, ত্যাগ, বিশ্বাস এবং সমাজসেবার গভীর বার্তা লুকিয়ে আছে। ২০২৫ সালে বকরিঈদ ৭ জুন, শনিবার পালিত হবে। আসুন জেনে নেই এই উৎসবের ঐতিহাসিক পটভূমি, কোরবানির গুরুত্ব এবং বকরিঈদ সংক্রান্ত সামাজিক ও আধ্যাত্মিক দিকগুলি সম্পর্কে।

বকরিঈদের ঐতিহাসিক ও ধর্মীয় পটভূমি

ইসলামী ঐতিহ্য অনুযায়ী, বকরিঈদের সরাসরি সম্পর্ক হযরত ইব্রাহিম (আঃ)-এর সেই পরীক্ষার সাথে যার মধ্যে আল্লাহ তাঁর বিশ্বাস পরীক্ষা করার জন্য তাঁকে তাঁর প্রিয়তম পুত্রের কোরবানি দেওয়ার আদেশ দিয়েছিলেন। হযরত ইব্রাহিমের জন্য এই আদেশ একটি বিরাট পরীক্ষা ছিল। তিনি আল্লাহর আদেশ কোন প্রশ্ন ছাড়াই মেনে নিয়েছিলেন এবং তাঁর পুত্র ইসমাইলকে কোরবানির জন্য প্রস্তুত করেছিলেন।

হযরত ইসমাইলও এই আদেশকে আল্লাহর ইচ্ছা মেনে নিয়েছিলেন। কিন্তু যখন ইব্রাহিম তাঁর পুত্রের কোরবানি দেওয়ার চেষ্টা করলেন, আল্লাহ এক অলৌকিক ঘটনা ঘটিয়ে ইসমাইলের বদলে একটি মেষ পাঠিয়ে দিলেন। এই ঘটনা ইসলামী ইতিহাসে বিশ্বাস, নিষ্ঠা ও ত্যাগের প্রতীক হয়ে উঠেছে, এবং তখন থেকেই বকরিঈদে কোরবানির প্রথা শুরু হয়।

কোরবানির প্রকৃত অর্থ: কেবলমাত্র পশুর বলি নয়

প্রায়শই বকরিঈদ নিয়ে বাইরের সমাজে এই ভুল ধারণা থাকে যে এটি কেবলমাত্র পশুর বলি দেওয়ার উৎসব। কিন্তু বাস্তবতা অনেক গভীর এবং মানবিক। কোরবানির অর্থ হলো – নিজের স্বার্থ, অহংকার এবং সাংসারিক মোহকে উর্ধ্বে নিয়ে আল্লাহর ইচ্ছার সামনে নিজেকে সম্পূর্ণভাবে সমর্পণ করা। বকরিঈদে দেওয়া কোরবানি সেই আধ্যাত্মিক বলিদানের একটি প্রতীক, যার মধ্যে ব্যক্তি আল্লাহর আদেশকে সর্বোচ্চ মনে করে।

এই দিন মুসলমানরা বিশেষ নামাজ আদায় করে এবং তারপর হালাল পদ্ধতিতে বকরি, ছাগল, গরু অথবা উটের কোরবানি দেয়। এই কোরবানির তিন ভাগ করা হয় – এক ভাগ নিজের জন্য, দ্বিতীয় ভাগ আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধুবান্ধবদের জন্য, এবং তৃতীয় ভাগ গরিব ও অসহায়দের দেওয়া হয়। এই বণ্টন সমাজে সমতা, ভ্রাতৃত্ব ও সহযোগিতার भावনাকে জোরদার করে।

কোরবানি ও সমাজসেবার গভীর সম্পর্ক

বকরিঈদ কেবলমাত্র ধর্মীয় উৎসব নয়, বরং সামাজিক সমতা ও সেবার প্রতীক। যখন কোরবানির মাংস সমাজের প্রতিটি শ্রেণীর কাছে পৌঁছায়, তখন এটি ইসলামের সেই মূল নীতিকে উজ্জ্বল করে তোলে যা বলে – "প্রত্যেক মানুষ সমান"। এই উৎসব শেখায় যে কেবলমাত্র নিজের পরিবারের পেট পূর্ণ করা নয়, বরং অভাবীদের ক্ষুধা নিবারণ করাও মানুষের কর্তব্য।

আজকের সময়ে যখন সমাজ শ্রেণী, জাতি ও ধর্মে বিভক্ত দেখা যায়, বকরিঈদের এই বার্তা আরও প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে – মানবতা সর্বোচ্চ।

হজ্জ ও বকরিঈদের পারস্পরিক সম্পর্ক

বকরিঈদের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো এটি হজ্জের সাথে জড়িত। হজ্জ ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের মধ্যে একটি এবং প্রতিটি সক্ষম মুসলমানের উপর জীবনে একবার মক্কা গিয়ে হজ্জ করা ফরজ। হজ্জের প্রক্রিয়ার সময়ও কোরবানি দেওয়া হয়, যা হযরত ইব্রাহিমের সেই প্রথাকে স্মরণ করিয়ে দেয়। এভাবে বকরিঈদ ও হজ্জ উভয়ের মধ্যেই ত্যাগ, নিষ্ঠা ও আল্লাহর প্রতি সত্যিকার বিশ্বাসের भावনা প্রধান।

আধুনিক সমাজে বকরিঈদের বার্তা

আজকের যুগে যখন মানুষ নিজ নিজ স্বার্থে জড়িত থাকে, বকরিঈদ আমাদের শেখায় যে সবচেয়ে বড় বলিদান হলো যা অন্যের কল্যাণের জন্য দেওয়া হয়। ত্যাগ ও সেবার এই বার্তাকে গ্রহণ করে আমরা কেবলমাত্র একজন উত্তম মানুষ হতে পারি না, বরং একটি শক্তিশালী ও সমৃদ্ধ সমাজ গঠনও করতে পারি। বকরিঈদ এও শেখায় যে ধর্ম কেবলমাত্র পূজা-পাঠ নয়, বরং একটি জীবনধারা যা মানুষকে নম্রতা, উদারতা ও সংবেদনশীলতার পথে চলতে অনুপ্রাণিত করে।

উৎসবের উল্লাস: ঐতিহ্য ও আধুনিকতার সংমিশ্রণ

বকরিঈদের দিন সকালে বিশেষ ঈদের নামাজ আদায় করা হয়। মানুষ নতুন কাপড় পরে, পরস্পরকে আলিঙ্গন করে ঈদের মোবারকবাদ জানায়। ঘরে ঘরে বিশেষ রান্না করা হয় এবং আত্মীয়-স্বজন, বন্ধুবান্ধব ও গরিবদের আমন্ত্রণ করে ভোজন করানো হয়। এই উৎসব সামাজিক সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্যের জীবন্ত উদাহরণ।

Leave a comment