ওড়িশার পুরীতে অবস্থিত শ্রীজগন্নাথ মন্দির ভারতের অন্যতম প্রাচীন ও রহস্যময় মন্দিরগুলির মধ্যে একটি। এই মন্দির কেবলমাত্র স্থাপত্যের অপূর্ব নিদর্শন নয়, বরং আধ্যাত্মিক রহস্য ও অনন্য ঐতিহ্যেরও কেন্দ্রবিন্দু। প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ ভক্ত ভগবান জগন্নাথের দর্শনার্থে এখানে আসেন, কিন্তু খুব কম লোকই জানে যে মন্দিরের তৃতীয় সিঁড়িতে পা রাখা নিষিদ্ধ। এটি কোন সাধারণ নিষেধ নয়, এর পিছনে লুকিয়ে আছে গভীর আধ্যাত্মিক ও পৌরাণিক রহস্য, যার সম্পর্ক বলা হয় যমরাজের সাথে।
২২টি সিঁড়ি, কিন্তু তৃতীয় সিঁড়ি কেন এত বিশেষ?
পুরীর শ্রীজগন্নাথ মন্দিরে প্রধান প্রবেশদ্বার থেকে গর্ভগৃহের দিকে যাওয়ার জন্য মোট ২২টি সিঁড়ি আছে। এই সিঁড়িগুলি প্রতীকাত্মকভাবে জীবনের বিভিন্ন পর্যায় ও আধ্যাত্মিক উন্নতির প্রতিনিধিত্ব করে। কিন্তু এই ২২টির মধ্যে তৃতীয় সিঁড়ি, যাকে ‘যমশিলা’ বলা হয়, বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। বিশ্বাস করা হয় এই সিঁড়িতে পা রাখলে পাপের দিকে নয়, বরং যমলোকের যাত্রার দিকে নিয়ে যায়। এ কারণেই এই সিঁড়িতে পা রাখা নিষিদ্ধ।
যমরাজ ও ভগবান জগন্নাথের দেখা
পৌরাণিক কাহিনী অনুযায়ী, একবার যমরাজ নিজেই ভগবান জগন্নাথের সাথে দেখা করতে পুরী এসেছিলেন। তিনি ভগবানের কাছে একটি প্রশ্ন করেছিলেন—‘যারা আপনার দর্শন করে, তাদের সব পাপ ক্ষমা হয়ে যায়। তাহলে আমার লোকে (যমলোকে) কে আসবে?’ এই প্রশ্নে যমরাজের উদ্বেগ ছিল যে, মোক্ষপ্রাপ্ত প্রাণীরা তার অধীনে থাকবে না।
ভগবান জগন্নাথ যমরাজের কথা শুনে তাকে একটি বিশেষ স্থান দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘মন্দিরের তৃতীয় সিঁড়িতে তুমি বাস করবে। এই সিঁড়ি যমশিলা নামে পরিচিত হবে। যে কোনও ভক্ত আমার দর্শনের পর এই সিঁড়িতে পা রাখবে, সে যমলোকে যাবে। অতএব এই সিঁড়ি সেই ভক্তদের জন্য একটি সতর্কীকরণ যে, যদি তোমরা মোক্ষ চাও, তাহলে এই শিলায় পা রাখা থেকে বিরত থেকো।’
তৃতীয় সিঁড়ির আধ্যাত্মিক অর্থ
তৃতীয় সিঁড়িকে যমরাজের প্রতীক হিসেবে দেখা হয়। এটি সতর্ক করে যে, অজ্ঞতা, অহংকার ও অধর্মের পথে চললে, যতই দর্শন করা হোক না কেন, যদি বিবেকের পালন না করা হয়, তাহলে মৃত্যুর দ্বার অর্থাৎ যমলোকে যেতেই হবে। এই কারণেই এই সিঁড়িতে পা রাখা অশুভ বলে মনে করা হয় এবং একে একটি ধর্মীয় শৃঙ্খলার অংশ বলেও মনে করা হয়।
দর্শনের পর কেন পা রাখা হয় না?
ভগবানের দর্শন করার পর ভক্তদের মন, শরীর ও আত্মা পবিত্র বলে মনে করা হয়। এমন অবস্থায় যদি তারা যমরাজের শিলায় পা রাখে, তাহলে বিশ্বাস করা হয় যে, সেই পুণ্য নষ্ট হতে পারে এবং ব্যক্তি পুনরায় কর্মবন্ধনে জড়িয়ে পড়তে পারে। অতএব তৃতীয় সিঁড়ি পার হওয়ার পরিবর্তে ভক্তরা তা লাফিয়ে পার হয় অথবা মাথা নত করে শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে।
বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকেও আকর্ষণীয়
যদি আমরা এই ঐতিহ্যকে আধ্যাত্মিক শক্তির দৃষ্টিকোণ থেকে দেখি, তাহলে মন্দিরের প্রতিটি সিঁড়িতে চলাচলের মাধ্যমে শরীরের শক্তির মাত্রা উপরের দিকে যায়। তৃতীয় সিঁড়িতে দাঁড়ানো অথবা স্পর্শ করা সেই শক্তির ভারসাম্য নষ্ট করতে পারে। সম্ভবত পূর্বপুরুষরা অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে এই বিষয়টি বুঝেছিলেন এবং তাকে ধর্মীয় বিশ্বাসের রূপ দিয়েছিলেন।
মন্দিরের ঐতিহ্যে লুকিয়ে আছে জীবনের দর্শন
জগন্নাথ মন্দির কেবলমাত্র একটি ধর্মীয় স্থান নয়, বরং মানবজীবন ও মৃত্যুর গভীর রহস্যও তুলে ধরে। এখানে প্রতিটি ঐতিহ্য, প্রতিটি প্রতীকেরই কোনও না কোনও অর্থ অবশ্যই আছে। তৃতীয় সিঁড়ির বিশ্বাস আমাদের শেখায় যে, মোক্ষের পথে সতর্কতা অপরিহার্য। কেবলমাত্র দর্শন করার মাধ্যমে নয়, বরং শ্রদ্ধা, সংযম ও জীবনের ধর্ম পালনের মাধ্যমেই মোক্ষ লাভ সম্ভব।
জগন্নাথ মন্দিরের তৃতীয় সিঁড়ি কোন সাধারণ পাথর নয়, বরং একটি সতর্কীকরণ, একটি নির্দেশনা, জীবন ও মৃত্যুর মধ্যকার ভারসাম্যের একটি ইঙ্গিত। এটি আমাদের শেখায় যে, মোক্ষের পথ কেবলমাত্র বাহ্যিক পূজার মাধ্যমে নয়, বরং আত্মচিন্তন, বিবেক ও ধর্ম পালনের মাধ্যমেই উন্মুক্ত হয়। যে ভক্ত এই সতর্কীকরণ বুঝতে পারেন, তারা যমশিলাকে কেবলমাত্র একটি সিঁড়ি নয়, বরং ধ্যান, শ্রদ্ধা ও আত্মবিবেকের পরীক্ষা মনে করেন।