মহাভারতের অজানা কন্যা সুথনু: এক লুক্কায়িত রাজকুমারীর গল্প

🎧 Listen in Audio
0:00

মহাভারত এমন এক মহাকাব্য যা হাজার বছর ধরে ভারতীয় সমাজ ও সংস্কৃতির আত্মার সাথে জড়িত। এই মহাকাব্যে যুদ্ধ, ধর্ম, রাজনীতি, প্রেম ও ত্যাগের অসংখ্য কাহিনী রয়েছে। কিন্তু এর সমান্তরালে অনেক লোককথাও জন্মেছে, যা সময়ের সাথে সাথে মৌখিক ঐতিহ্যের মাধ্যমে টিকে আছে। এই লোককথাগুলোর মধ্যে একটি রহস্যময় নাম সামনে আসে - সুথনু, যাকে দ্রৌপদী ও ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরের কন্যা বলা হয়। এই নাম মহাভারতের মূল গ্রন্থে পাওয়া যায় না, কিন্তু এই কাহিনী যদি সত্য হয় তাহলে মহাভারতের গল্পেরই দিক পরিবর্তন হতে পারত।

দ্রৌপদী: পাঁচ স্বামীর রানী ও মাতৃত্বের ছায়া

দ্রৌপদী, রাজা দ্রুপদের কন্যা এবং অগ্নিকুণ্ড থেকে উৎপন্ন, পাঁচ পান্ডবের স্ত্রী ছিলেন। তিনি যুধিষ্ঠির, ভীম, অর্জুন, নকুল এবং সহদেবের কাছ থেকে এক একজন পুত্র জন্ম দিয়েছিলেন। তাঁর পুত্রেরা ছিলেন - প্রতিবিন্ধ্য, সুতসোম, শ্রুতকীর্তি, শতানীক এবং শ্রুতকর্মা। কিন্তু দ্রৌপদীর মাতৃত্ব শুধু এখানেই সীমাবদ্ধ ছিল না, যদি লোককথাগুলোকে বিশ্বাস করি তাহলে তিনি এক কন্যাও জন্ম দিয়েছিলেন — সুথনু।

কোন ছিলেন সুথনু? এক লুক্কায়িত রাজকুমারী

লোককথা অনুসারে, সুথনু ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির ও দ্রৌপদীর কন্যা ছিলেন। যখন সুথনুর জন্ম হয়, তখন মহাভারতের যুদ্ধ তীব্রতম পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল। কৌরবদের ছল ও অত্যাচার চরমে পৌঁছেছিল। এমন পরিস্থিতিতে দ্রৌপদী আশঙ্কা করেছিলেন যে, যদি তাঁর কন্যার কথা কেউ জানতে পারে, তাহলে কৌরবরা তার উপরও অত্যাচার করতে পারে।

তাই, দ্রৌপদী সুথনুকে তাঁর এক বিশ্বস্ত বন্ধুর কাছে রেখে দিয়েছিলেন এবং তাকে সম্পূর্ণ গোপনে রেখেছিলেন। এই সিদ্ধান্ত মাতৃত্বের জন্য অত্যন্ত বেদনাদায়ক ছিল, কিন্তু পরিস্থিতির বাধ্যবাধকতা দ্রৌপদীকে এটি করতে বাধ্য করেছিল।

যদি সুথনুর রহস্য উন্মোচিত হতো...

অনেক পণ্ডিত ও লোককথাবিদ মনে করেন যে, যদি সুথনুর অস্তিত্ব জনসাধারণের কাছে প্রকাশিত হতো এবং কৌরবরা তার বিষয়ে জানতে পারতো, তাহলে মহাভারতের ইতিহাস একটি ভিন্ন মোড় নিতে পারত। দ্রৌপদীর অপমানের প্রতিশোধ নেওয়ার আগুনে পান্ডবরা ইতোমধ্যেই জ্বলছিল, যদি তাঁদের কন্যার সাথেও অপমান করা হতো, তাহলে এই যুদ্ধ আরও ভয়াবহ রূপ ধারণ করত।

সুথনুর বিবাহ: যখন কৃষ্ণ হলেন সম্ভ্রান্ত

আরেকটি আকর্ষণীয় দিক হল লোককথা অনুসারে সুথনুর বিবাহ শ্রীকৃষ্ণ ও সত্যভামার পুত্র ভানুর সাথে হয়েছিল। এভাবে, কৃষ্ণ ও যুধিষ্ঠির সম্ভ্রান্ত হয়েছিলেন। এই সম্পর্ক মহাভারতের বন্ধুত্ব ও রাজনীতির সীমার বাইরে গিয়ে পারিবারিক আন্তরিকতায় পরিণত হয়েছিল। এই বিবাহ শুধুমাত্র একটি পারিবারিক সম্পর্ক নয়, বরং দুটি মহান বংশের মিলন — পান্ডব ও যাদবের। এটি দেখায় যে যুদ্ধ ও রাজনীতির বাইরেও সম্পর্কের এক জগৎ ছিল, যাকে প্রায়ই মহাভারতের মূল কাহিনীতে স্থান দেওয়া হয়নি।

বেদব্যাসের বচন ও সুথনুর অব্যক্ত কাহিনী

কথিত আছে যে দ্রৌপদী নিজেই বেদব্যাসের কাছ থেকে এই প্রতিশ্রুতি নিয়েছিলেন যে তিনি তাঁর কন্যার বিষয়ে মহাভারতে কিছুই লিখবেন না। এর কারণ সম্ভবত এটাই ছিল যে তিনি তাঁর কন্যাকে যেকোনো ধরণের রাজনীতি ও সংঘর্ষ থেকে দূরে রাখতে চেয়েছিলেন। তাই মূল মহাভারতে সুথনুর নাম আসে না, কিন্তু লোককথা ও কিংবদন্তীতে তিনি জীবিত আছেন।

দ্রৌপদী ও মাতৃত্বের বিস্মৃত দিক

মহাভারতে দ্রৌপদীকে প্রায়ই এক যোদ্ধা, সংগ্রামী রানী ও অপমানিত নারী হিসেবে দেখা হয়। কিন্তু সুথনুর কাহিনী এটা প্রমাণ করে যে তিনি একজন মাও ছিলেন, যিনি তাঁর কন্যার জন্য তাঁর মমতাকেও গোপন রেখেছিলেন। এমন একজন মা, যিনি তাঁর হৃদয়ের বেদনাকে লোকনির্দেশনা, রাজনীতি ও অপমানের উপর রেখেছিলেন।

আধুনিক দৃষ্টিকোণ থেকে এই কাহিনীগুলো কী বলে?

আজকের প্রেক্ষাপটে যখন আমরা নারী সবলীকরণ, মাতৃত্ব ও নারীর অধিকারের কথা বলি, তখন সুথনু-র মতো কাহিনী আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে প্রতিটি যুগে নারীরা তাদের সন্তানদের জন্য সংগ্রাম করেছে। দ্রৌপদীর এই ত্যাগ শুধুমাত্র একজন মায়ের গল্প নয়, বরং এক ইতিহাস যা নিঃশব্দে দমিয়ে দেওয়া হয়েছিল। সুথনুর কাহিনী মহাভারতের সেই রহস্যময় দিকগুলোর মধ্যে একটি যা আমাদের বলে দেয় যে প্রতিটি মহাকাব্যের পিছনে অনেক গল্প লুকিয়ে থাকে। মহাভারতের গল্প শুধু যুদ্ধের নয়, প্রেম, ত্যাগ, মাতৃত্ব ও লুক্কায়িত সম্পর্কেরও।

সুথনু যদি সামনে আসতেন, তাহলে সম্ভবত দ্রৌপদীর রূপ একজন মা হিসেবে আরও বেশি উন্মোচিত হতো, এবং কৃষ্ণের সাথে তাঁর সম্পর্ক আরও গভীরে বোঝা যেত। এই কাহিনী আমাদের ইতিহাসের জ্ঞাত ও অজ্ঞাত দিকগুলোর উপর পুনরায় চিন্তা করার জন্য অনুপ্রাণিত করে। অবশেষে, সুথনু মহাভারতের সেই ছায়ার নাম যা কখনো সূর্যের মতো প্রকাশিত হয়নি, কিন্তু যার আলো আজও লোককথায় ঝলমলে।

Leave a comment