জগন্নাথের গজানন বেশ: একটি ঐশ্বরিক রহস্য ও সাংস্কৃতিক বার্তা

🎧 Listen in Audio
0:00

হিন্দু ধর্মের সমৃদ্ধ ঐতিহ্য ও বিশ্বাসের অন্তর্গত প্রতিটি দেবরূপ ও অবতারের পিছনেই লুকিয়ে আছে কোনও না কোনও আধ্যাত্মিক রহস্য ও সাংস্কৃতিক বার্তা। এমনই একটি আকর্ষণীয় ও ঐশ্বরিক ঘটনা জড়িত জগন্নাথ দেবের গজানন বেশের সাথে, যা ওড়িশার পুরী অঞ্চলে প্রচুর ভক্তি ও ঐতিহ্যের সাথে পালিত হয়।

পুরীর জগন্নাথ ধাম, যাকে পৃথিবীর বৈকুণ্ঠ বলা হয়, কেবলমাত্র ভগবান বিষ্ণুর অবতার জগন্নাথের প্রধান মন্দির নয়, এটি ভারতীয় সংস্কৃতি ও ঐক্যের প্রতীকও বটে। প্রতি বছর অনুষ্ঠিত জগন্নাথ রথযাত্রা দেশ-বিদেশ থেকে লক্ষ লক্ষ ভক্তকে আকর্ষণ করে। এ বছর এই যাত্রা ২৭শে জুন শুরু হয়ে ৫ই জুলাই শেষ হবে।

গজানন বেশের পৌরাণিক কাহিনী

ওড়িশার লোককাহিনী, বিশেষ করে মন্দিরের ঐতিহাসিক গ্রন্থ 'মদলা পাঞ্জি' এবং 'স্কন্দ পুরাণ' এর উৎকল খণ্ডে এই কাহিনীর বিস্তারিত বর্ণনা পাওয়া যায়। কাহিনী অনুযায়ী একবার রথযাত্রার তারিখে গণেশ চতুর্থী পড়েছিল। এই দিন গণেশের জন্মোৎসব হয় এবং তিনি দেবতাদের মধ্যে প্রথম পূজ্য।

প্রতিটি শুভ কাজের আগে গণেশের পূজা অপরিহার্য বলে মনে করা হয়, কারণ তিনি বিঘ্ন দূর করেন। কিন্তু রথযাত্রার উৎসবে সেদিন কেবলমাত্র জগন্নাথের পূজা হচ্ছিল এবং গণেশের উপেক্ষা হয়েছিল। এই উপেক্ষায় গণেশ ক্রুদ্ধ হয়েছিলেন।

যখন ক্রুদ্ধ হলেন গণপতি, এবং দেখলেন ভগবান নিজের যোগদৃষ্টিতে

গণেশের ক্রোধ স্বাভাবিক ছিল, কারণ শিব নিজেই তাঁকে আশীর্বাদ করেছিলেন যে, প্রতিটি কাজে তিনি প্রথম পূজিত হবেন। যখন জগন্নাথ নিজের ঐশ্বরিক দৃষ্টিতে দেখলেন যে গণেশ ক্রুদ্ধ হয়েছেন, তখন তিনি ভক্তদের অনুভূতি, সংস্কৃতি ও শাস্ত্রীয় নিয়মের সম্মান করে একটি অসাধারণ সিদ্ধান্ত নিলেন।

জগন্নাথ নিজেই গজানন বেশ ধারণ করলেন এবং ভক্তদের দর্শন দিতে লাগলেন। এই রূপে তিনি হাতির মাথা ও বড় কান নিয়ে প্রকাশিত হলেন, যেন গণেশ নিজেই সেখানে উপস্থিত।

বিনয় ও সমর্পণের অসাধারণ উদাহরণ

ভগবানের এই রূপ একটি ঐশ্বরিক বার্তা দেয় যে, সত্যিকারের ইশ্বর হলেন তিনি যিনি ভক্তদের অনুভূতি ও ধর্মীয় নিয়মের সম্মান করেন। জগন্নাথ কেবল গণেশকে খুশি করার জন্যই নয়, বরং সেই সনাতন ঐতিহ্যকে জীবন্ত রাখার জন্যও এই রূপ ধারণ করেছিলেন, যেখানে গণেশকে প্রথম পূজ্য বলে মনে করা হয়।

এই ঘটনাটি এটাও দেখায় যে, ইশ্বর অহংকার রাখেন না। যখন বিষ্ণুর অবতার জগন্নাথ নিজেই গণেশ বেশ ধারণ করেন, তখন এটি মানবতাকে শেখায় যে, সমর্পণ ও বিনয়ই সত্য ধর্ম।

গণেশ বেশের ঐতিহ্য আজও জীবন্ত

পুরীতে আজও এই ঘটনার স্মৃতিতে জগন্নাথের গণেশ বেশ পালিত হয়। এই অনুষ্ঠানটি রথযাত্রার পূর্বে বিশেষ আচার-অনুষ্ঠানের সাথে হয়, যেখানে ভগবানকে গজানন রূপে সাজানো হয়। ভক্তরা এই দিন বিশেষ পূজা করেন এবং গণেশের মন্ত্র জপ করে বিঘ্নমুক্তির কামনা করেন।

ধর্মীয় বার্তা: প্রতিটি কাজের সাফল্যের ভিত্তি – গণেশ পূজা

এই কাহিনীটি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, কোনও কাজের সাফল্যের জন্য বিঘ্নহর্তা গণেশের পূজা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। তিনি কেবল শুভারম্ভের দেবতা নন, বরং জীবনের প্রতিটি মোড়ে मार्गदर्शन देने वाला ঐশ্বরিক সঙ্গীও। এজন্যই প্রতিটি পূজা, যাত্রা, বিবাহ, ব্যবসা ও শিক্ষার শুরু হয় গণেশ বন্দনার সাথে।

জগন্নাথ কর্তৃক গজানন বেশ ধারণ করা কেবলমাত্র একটি পৌরাণিক কাহিনী নয়, বরং সনাতন সংস্কৃতির গভীরতা প্রদর্শনকারী একটি ঐশ্বরিক ঘটনা। এটি আমাদের শেখায় যে, অহংকার ত্যাগ করে ধর্ম, ঐতিহ্য ও ভক্তদের অনুভূতির সম্মান করাটাই সত্য ঐশ্বর্য।

Leave a comment