আগামী ১৮ জুন ভারতীয় নৌবাহিনী তাদের নতুন যুদ্ধ জাহাজ আইএনএস অর্ণলা (INS Arnala) তাদের বহরে যোগ করতে চলেছে। এই ছোট কিন্তু শক্তিশালী যুদ্ধ জাহাজটি বিশেষ করে অ্যান্টি-সাবমেরিন ওয়ারফেয়ার অর্থাৎ পানডুবী বিরোধী অভিযান এবং নিম্ন তীব্রতার সমুদ্র অভিযানের জন্য ডিজাইন করা হয়েছে।
নয়াদিল্লি: ভারতীয় নৌবাহিনী তাদের শক্তি এবং আত্মনির্ভরতার দিকে একটি বড় ধাপ এগোতে চলেছে। ১৮ জুন ২০২৫ তারিখে নৌবাহিনীর বহরে একটি নতুন যুদ্ধ জাহাজ আইএনএস অর্ণলা (INS Arnala) যুক্ত হবে, যাকে সমুদ্রের ‘তেজস’ বলা হচ্ছে। এই যুদ্ধ জাহাজটি পানডুবী বিরোধী ক্ষমতা (অ্যান্টি-সাবমেরিন ওয়ারফেয়ার) এবং নিম্ন তীব্রতার সমুদ্র অভিযানের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে।
ভারতের স্বদেশী প্রতিরক্ষা উৎপাদন এবং ‘আত্মনির্ভর ভারত’ অভিযানের এক উজ্জ্বল উদাহরণ হিসেবে এই জাহাজটি দেশের সমুদ্র সুরক্ষা এবং কৌশলগত ক্ষমতাকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাবে।
স্বদেশী প্রযুক্তি এবং উৎপাদনের চমৎকার উদাহরণ
আইএনএস অর্ণলার নির্মাণ করেছে গার্ডেন রিচ শিপবিল্ডার্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ার্স (GRSE), এল অ্যান্ড টি শিপবিল্ডার্সের সহযোগিতায়। এই যুদ্ধ জাহাজটি ৭৭ মিটার লম্বা এবং প্রায় ১,৪৯০ টন ওজনের, যা আধুনিক সেন্সর এবং প্রযুক্তি দিয়ে সজ্জিত। এটি তৈরি করার সময় ৮০% এর বেশি উপাদান ভারতেই উন্নত করা হয়েছে, যার মধ্যে বিশেষ করে ভারত ইলেকট্রনিক্স লিমিটেড, L&T, মহিন্দ্র ডিফেন্স ইত্যাদি ভারতীয় কোম্পানিগুলি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
এটি প্রথম এমন যুদ্ধ জাহাজ যাতে ডিজেল ইঞ্জিন এবং ওয়াটারজেট প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে, যা এটিকে উন্নত গতি এবং সমুদ্র নিয়ন্ত্রণ প্রদান করে। এই জাহাজে থাকা উন্নত সেন্সর পানির নিচে শত্রু পানডুবীর সন্ধান করতে এবং তাদের থামাতে সক্ষম, যা ভারতীয় নৌবাহিনীর অ্যান্টি-সাবমেরিন যুদ্ধ ক্ষমতায় অসাধারণ উন্নতি আনবে।
১৬ টি স্বদেশী যুদ্ধ জাহাজের ধারাবাহিকতার প্রথম
আইএনএস অর্ণলা ১৬ টি স্বদেশী ছোট যুদ্ধ জাহাজের ধারাবাহিকতার প্রথম জাহাজ, যাদের নির্মাণ করা হচ্ছে মোট ১২,৬২২ কোটি টাকার ব্যয়ে। এর সাথে GRSE এবং কোচিন শিপইয়ার্ড মিলে ৮-৮ টি করে যুদ্ধ জাহাজ তৈরি করছে, যা ২০২৮ সালের মধ্যে নৌবাহিনীকে হস্তান্তর করা হবে। এই জাহাজগুলি ভারতের সমুদ্র সুরক্ষাকে শক্তিশালী করার সাথে সাথে নৌবাহিনীর কৌশলগত ক্ষমতা বৃদ্ধি করবে।
সমুদ্রের ঐতিহ্যের প্রতীক – ‘অর্ণলা’র নাম এবং প্রতীক চিহ্ন
এই জাহাজের নাম রাখা হয়েছে মহারাষ্ট্রের বসাইতে অবস্থিত ঐতিহাসিক অর্ণলা দুর্গের নামানুসারে, যা মারাঠা যোদ্ধা চিমাৠি আপ্পা ১৭৩৭ সালে নির্মাণ করেছিলেন। এই দুর্গটি বৈতরণী নদীর মোহনায় অবস্থিত ছিল এবং কঙ্কণ উপকূলের রক্ষা করত। ঠিক সেভাবেই আইএনএস অর্ণলাও সমুদ্র অঞ্চলে ভারতের রক্ষার এক শক্তিশালী ভিত্তি হবে।
জাহাজের প্রতীক চিহ্নে শঙ্খ রয়েছে, যা কঠিন পরিস্থিতিতে শক্তি এবং সতর্কতার প্রতীক। নৌবাহিনীর মতে, এই শঙ্খ শত্রুদের উপর নজর রাখার এবং তাদের থামানোর ক্ষমতার প্রতিনিধিত্ব করে। জাহাজের নিচে ‘অর্ণবে শৌর্যম’ লেখা আছে, যার অর্থ ‘সমুদ্রে বীরত্ব’। এই বাক্যটি জাহাজের কর্মীদের সমুদ্রে সাহস এবং দৃঢ়তার সাথে কাজ করার জন্য অনুপ্রাণিত করে।
অ্যান্টি-সাবমেরিন ওয়ারফেয়ারে ভারতের শক্তি বৃদ্ধি
আইএনএস অর্ণলা প্রধানত পানডুবী বিরোধী অভিযানের জন্য তৈরি করা হয়েছে। পানডুবী যুদ্ধের কৌশলগুলি দ্রুত বিকশিত হচ্ছে, এবং সমুদ্র সুরক্ষার দিক থেকে পানডুবীর সন্ধান করা এবং তাদের থামানো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই জাহাজে থাকা অত্যাধুনিক সোনার এবং অন্যান্য যন্ত্রপাতি পানডুবীর সন্ধান করতে, তাদের ট্র্যাক করতে এবং কার্যকরীভাবে ধ্বংস করতে সক্ষম।
এই জাহাজের স্থাপনার মাধ্যমে ভারত হিন্দ মহাসাগর অঞ্চলে তার সমুদ্র আধিপত্য আরও শক্তিশালী করবে। এছাড়াও, এটি নিম্ন তীব্রতার অভিযানেও সক্রিয় ভূমিকা পালন করবে, যার ফলে নৌবাহিনী দ্রুত প্রতিক্রিয়া এবং অভিযানে সাফল্য অর্জন করবে।
‘আত্মনির্ভর ভারত’র আওতায় নৌবাহিনীর নতুন উদাহরণ
আইএনএস অর্ণলার নির্মাণ ‘আত্মনির্ভর ভারত’ অভিযানের একটি বড় সাফল্য। এই প্রকল্পে ৫৫ টির বেশি ছোট এবং মাঝারি আকারের কোম্পানি (MSME) অবদান রেখেছে, যার ফলে দেশে কর্মসংস্থানের সুযোগ বেড়েছে এবং প্রতিরক্ষা উৎপাদন ক্ষেত্রে নতুন প্রযুক্তি এবং দক্ষতা এসেছে। এই জাহাজটি কেবল ভারতের সমুদ্র সুরক্ষাকে শক্তিশালী করবে না, বরং দেশের প্রতিরক্ষা ক্ষমতাকে স্বদেশীকরণের দিকে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবেও প্রমাণিত হবে।
ভারতীয় নৌবাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা এই জাহাজটিকে সমুদ্রের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সক্ষম ‘তেজস’ হিসেবে দেখছেন। এই জাহাজটির শক্তিশালী গঠন, আধুনিক যন্ত্রপাতি এবং চমৎকার যুদ্ধ ক্ষমতার কারণে সমুদ্র অঞ্চলে শত্রুদের উৎসাহ ভেঙে দিতে পারে।