আজ, ওড়িশার পুরীতে ভগবান জগন্নাথের বিশ্ববিখ্যাত রথযাত্রা শুরু হচ্ছে। এই বিশাল শোভাযাত্রা পুরীর জগন্নাথ মন্দির থেকে বেরিয়ে গুন্ডিচা মন্দির পর্যন্ত যায়।
Jagannath Rath Yatra 2025: পুরীর ঐতিহাসিক ভূমিতে আজ থেকে ভগবান জগন্নাথের মহাপ্রসিদ্ধ রথযাত্রার সূচনা হচ্ছে। শ্রদ্ধা, সংস্কৃতি এবং ভক্তির এক অসাধারণ দৃষ্টান্ত স্থাপন করে এই যাত্রা প্রতি বছর কোটি কোটি মানুষকে আকৃষ্ট করে। ভগবান জগন্নাথ, তাঁর বড় ভাই বলভদ্র এবং বোন সুভদ্রা এই সময়ে মাসির বাড়ি গুন্ডিচা মন্দিরে যান এবং ১২ দিন পর ফিরে আসেন। এবার এই মহাযাত্রা ২৭ জুন শুরু হয়ে ৮ জুলাই নীলadri বিজয়ের সাথে সমাপ্ত হবে।
পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের সামনে তৈরি রথ ইয়ার্ডে তিনটি রথ—তালধ্বজ (বলভদ্রের রথ), দেবদলন (সুভদ্রার রথ) এবং নন্দীঘোষ (ভগবান জগন্নাথের রথ)-এর নির্মাণকাজ সম্পন্ন হয়েছে এবং আজ থেকে এগুলি টানার রীতি শুরু হচ্ছে। পুরীর রাজার দ্বারা অনুষ্ঠিত ঐতিহ্যবাহী ‘ছেরা পহঁরা’ রীতিতে, যেখানে তিনি সোনার ঝাড়ু দিয়ে রথের চত্বর পরিষ্কার করেন, তার পরে ভক্তরা ভারী দড়ি দিয়ে রথগুলি গুন্ডিচা মন্দিরের দিকে টানা শুরু করবেন।
ভক্তদের মধ্যে উৎসাহ, প্রশাসন সম্পূর্ণ প্রস্তুত
রথযাত্রা উপলক্ষে পুরী প্রশাসন কঠোর ব্যবস্থা নিয়েছে। এসজেটিএ-র মুখ্য প্রশাসক অরবিন্দ পাধি জানিয়েছেন যে নিরাপত্তা এবং তীর্থযাত্রীদের সুবিধার জন্য প্রশাসন মাসখানেক আগে থেকেই প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছে। এবার পুরো শহরকে কভার করে একটি সমন্বিত কমান্ড এবং কন্ট্রোল সেন্টার তৈরি করা হয়েছে, যেখানে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা)-ভিত্তিক CCTV নজরদারি ব্যবস্থা কাজ করছে।
এডিজি ট্রাফিক দয়াল গাঙ্গোয়ার জানিয়েছেন, ট্রাফিক ব্যবস্থা স্বাভাবিক রাখতে ড্রোন ক্যামেরারও সাহায্য নেওয়া হচ্ছে। এছাড়াও, শহরে বিভিন্ন স্থানে পুলিশকর্মী, সিভিল ডিফেন্স স্বেচ্ছাসেবক এবং বিপর্যয় ব্যবস্থাপনা দল মোতায়েন করা হয়েছে, যাতে যেকোনো জরুরি পরিস্থিতির দ্রুত মোকাবিলা করা যায়। একটি ওয়ার রুমও স্থাপন করা হয়েছে, যেখানে রিয়েল-টাইম মনিটরিং (তাত্ক্ষণিক পর্যবেক্ষণ) করা হবে।
নেত্র উৎসবের পর নব্যযৌবন দর্শন
১১ জুন অনুষ্ঠিত স্নানযাত্রা অনুষ্ঠানের পর ঐতিহ্যগতভাবে ভগবান জগন্নাথ, বলভদ্র এবং সুভদ্রার সর্বসাধারণের দর্শন বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। এই সময়ে দেবতারা ১৫ দিন ‘অনাশর গৃহ’ (বিচ্ছিন্নতা কক্ষ)-এ বিশ্রাম করেন, যা ‘অসুস্থ হওয়ার’ স্বীকৃতি হিসাবেও বিবেচিত হয়। এরপর আজ রথযাত্রার প্রাক্কালে ভক্তরা নব্যযৌবন দর্শন করেছেন, যেখানে ভগবান তরুণ রূপে বিশেষ পোশাক পরিধান করেন। এই সময়ে নেত্র উৎসবও অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে দেবতাদের মূর্তির চোখে নতুন করে রং করা হয়।
জগন্নাথ সংস্কৃতির গবেষক ভাস্কর মিশ্র জানান, এই অনুষ্ঠানটি ভগবানের রূপান্তরের প্রতীক, যেখানে তিনি পুনরায় শক্তি সঞ্চয় করে ভক্তদের মাঝে আবির্ভূত হন।
রথযাত্রার দিন-প্রতিদিনের কর্মসূচি
- ২৭ জুন (শুক্রবার) - রথযাত্রা শুরু: তিনটি রথ জগন্নাথ মন্দির থেকে গুন্ডিচা মন্দির পর্যন্ত টানা হয়। পুরীর রাজার ছেরা পহঁরা রীতির পর ভক্তরা রথ টানা শুরু করেন।
- ১ জুলাই (মঙ্গলবার) - হেরা পঞ্চমী: গুন্ডিচা মন্দিরে পাঁচ দিন কাটানোর পর দেবী লক্ষ্মী ভগবানের সঙ্গে দেখা করতে আসেন। এটিকে হেরা পঞ্চমী বলা হয়।
- ৪ জুলাই (শুক্রবার) - সন্ধ্যা দর্শন: এই দিনে ভক্তরা গুন্ডিচা মন্দিরে ভগবানের বিশেষ দর্শনের সুযোগ পান।
- ৫ জুলাই (শনিবার) - বহুদা যাত্রা: ভগবান জগন্নাথ, বলভদ্র এবং সুভদ্রা আবার তাঁদের মন্দিরে ফিরে আসেন। মাঝপথে মাসির মন্দিরে ‘পোড়া পিঠা’ নিবেদন করা হয়।
- ৬ জুলাই (রবিবার) - সোনা বেশ: দেবতাদের স্বর্ণালঙ্কারে সজ্জিত করা হয়, যা দেখতে হাজার হাজার ভক্ত সমবেত হন।
- ৭ জুলাই (সোমবার) - আধানর পানা: এই দিনে দেবতাদের ঐতিহ্যবাহী মিষ্টি পানীয় ‘আধানর পানা’ নিবেদন করা হয়।
- ৮ জুলাই (মঙ্গলবার) - নীলadri বিজয়: তিনজন দেবতা পুনরায় তাঁদের গর্ভগৃহে বিরাজ করেন এবং রথযাত্রার সমাপ্তি হয়।
রাজ্যজুড়ে উৎসবের আমেজ
ওড়িশার মুখ্যমন্ত্রী মোহন চরণ মাঝি এবং রাজ্যপাল ডঃ হরি বাবু কম্বমপতি এই রথযাত্রা উপলক্ষে সকল ভক্তদের শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। মুখ্যমন্ত্রী মাঝি বলেছেন, এটি বিশ্বাস ও ভক্তির উৎসব, যেখানে সকলের অংশগ্রহণ করা উচিত এবং মহাপ্রভুর দর্শন করে তাঁর আশীর্বাদ লাভ করা উচিত। পুরীর বাজার, গলি এবং রাস্তার পাশে মেলার মতো দৃশ্য দেখা যাচ্ছে।
রঙিন পতাকা, ঐতিহ্যবাহী বাদ্যযন্ত্রের আওয়াজ এবং হাজার হাজার ভক্তের ভিড় পুরীকে একটি জীবন্ত তীর্থনগরে পরিণত করছে। হোটেল, ধর্মশালা, আশ্রম এবং গেস্ট হাউস তীর্থযাত্রীদের দ্বারা পরিপূর্ণ।
সাংস্কৃতিক এবং সামাজিক গুরুত্ব
রথযাত্রা কেবল ধর্মীয় দিক থেকে নয়, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক দিক থেকেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হয়। এই উৎসব ভ্রাতৃত্ব, সহযোগিতা এবং সকলের প্রতি উৎসর্গের প্রতীক। এই সময়ে জাতি, শ্রেণি, ভাষা, ধর্ম—এসব বিভেদ দূর হয়ে যায় এবং সবাই মহাপ্রভুর রথ টানার সৌভাগ্য অর্জনের চেষ্টা করে।
পুরীর রথযাত্রার উল্লেখ দ্বাদশ শতাব্দীর গ্রন্থগুলিতেও পাওয়া যায় এবং এটি বহু শতাব্দী ধরে ওড়িশার সাংস্কৃতিক পরিচয়ের অংশ। এর বিশালতা এবং জনগণের অংশগ্রহণ বিশ্বজুড়ে অতুলনীয় হিসাবে বিবেচিত হয়।