মহররম: শোক, ত্যাগ ও ইসলামী নববর্ষের তাৎপর্য

মহররম: শোক, ত্যাগ ও ইসলামী নববর্ষের তাৎপর্য
সর্বশেষ আপডেট: 7 ঘণ্টা আগে

হিজরি ক্যালেন্ডার অনুসারে, মহররম মাস ইসলামিক বর্ষের প্রথম মাস এবং এটিকে চারটি পবিত্র মাসের মধ্যে গণনা করা হয়, যেখানে ঝগড়া ও যুদ্ধকে হারাম হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। এবার ভারত সহ বিভিন্ন দেশে ২৬ জুন ২০২৫ সন্ধ্যায় মহররমের নতুন চাঁদ দেখা যায়, যার সাথে ১৪৪৭ হিজরি ইসলামী নববর্ষের সূচনা হয়। 

যদিও বিশ্বের অনেক অংশে মানুষ এটিকে 'নতুন বছর' হিসেবে উদযাপন করে, আতশবাজি করে, বিভিন্ন পদ রান্না করে, তবে ইসলামী শিক্ষার আলোকে মহররমের গুরুত্ব এর চেয়ে অনেক গভীর এবং তাৎপর্যপূর্ণ। মহররম মাস শুধু ইসলামিক নতুন বছর নয়, বরং এটি হযরত ইমাম হোসেন (রা.) এবং তাঁর পরিবারের কারবালায় দেওয়া মহান শাহাদাতের স্মৃতি বহন করে। 

এই কারণেই এই মাসটিকে শোক, ধৈর্য, আত্মত্যাগ এবং আল্লাহর পথে উৎসর্গের প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এই কারণে, মুসলমানরা সাধারণত এই মাসে 'হ্যাপি নিউ ইয়ার' বা 'মহররম মোবারক' বলেন না, কারণ এটি উদযাপন বা আনন্দের সময় নয়, বরং ইবাদত, সহানুভূতি এবং মানবিক সাহায্যের সময়।

কেন 'হ্যাপি মহররম' বলা হয় না?

মানুষের মনে এই প্রশ্ন আসে যে, যখন নতুন বছর শুরু হচ্ছে, তখন কেন একে অপরকে শুভ নববর্ষ জানানো হবে না। আসলে, ইমাম হোসেন (রা.) এবং তাঁর সঙ্গীদের শাহাদাতের কারণে মহররম মাস অত্যন্ত দুঃখজনক এবং সংবেদনশীল হিসেবে বিবেচিত হয়। কারবালার ঘটনায় ন্যায়বিচার, মানবতা ও ধর্ম রক্ষার জন্য তাঁদের আত্মত্যাগ সারা বিশ্বের জন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। তাই মুসলমানরা এই মাসটিকে আনন্দ ও উল্লাসের সাথে নয়, বরং শোক ও ইবাদতের সাথে যুক্ত করেন।

যদিও, কিছু লোক মাসের প্রথম দিন একে অপরের সাথে নববর্ষের শুভেচ্ছা বিনিময় করতে পারে, তবে মাসটি যত এগিয়ে যায় এবং ১০ তারিখ অর্থাৎ আশুরার দিন যত কাছে আসে, তত পরিবেশ আরও শোকপূর্ণ হয়ে ওঠে। তাই পরবর্তী দিনগুলোতে শুভেচ্ছা জানানো থেকে বিরত থাকা হয়।

ইসলামিক নববর্ষে আপনার চিন্তা কেমন হওয়া উচিত?

মহররম এবং ইসলামিক নববর্ষের সময় এটা জরুরি যে, মানুষ যেন নাচ-গান, পটকা ফাটানো, লোক দেখানো বা অপ্রয়োজনীয় খরচ করে এটি উদযাপন না করে। ইসলামে অপচয় ও প্রদর্শনের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। এর পরিবর্তে, মানুষ তাদের সময় ইবাদতে ব্যয় করুক, কোরআন তেলাওয়াত করুক, মসজিদে যাক এবং আল্লাহর কাছে দোয়া করুক যেন নতুন বছর তাদের জন্য নেকি, বরকত ও শান্তির বার্তা নিয়ে আসে।

এছাড়াও, গরীব, অভাবী, এতিম, বিধবা ও অসুস্থ মানুষের সাহায্য করে মানবতা রক্ষা করা উচিত। আল্লাহ তাদের বেশি ভালোবাসেন যারা অন্যদের সাহায্য করে এবং তাদের কষ্ট দূর করার চেষ্টা করে।

এই ভালো কাজগুলো করুন, সাওয়াব পাবেন

  1. গোপনে গরীবদের দান করুন: কোনো প্রকার লোক দেখানো ছাড়াই অভাবীদের কাছে সাহায্য পৌঁছে দিন।
  2. এতিম শিশুদের আশ্রয় দিন: তাদের পড়াশোনা, পোশাক বা খাদ্যে অবদান রাখুন।
  3. বয়স্কদের সম্মান করুন: তাদের সেবা করুন এবং দোয়া নিন।
  4. অসুস্থদের দেখাশোনা করুন: হাসপাতালে গিয়ে তাদের খোঁজ নিন অথবা তাদের ঔষধের ব্যবস্থা করুন।
  5. মিলেমিশে থাকুন: পরিবার ও সমাজে ভ্রাতৃত্ব বৃদ্ধি করুন।
  6. আল্লাহর ইবাদত করুন: কোরআন পড়ুন, নামাজ পড়ুন এবং আল্লাহর কাছে গুনাহের ক্ষমা চান।

এই ভালো কাজগুলো করলে শুধু আপনি শান্তি পাবেন তা নয়, সারা বছর আল্লাহর রহমতও আপনার সাথে থাকবে।

ছোটদেরও শেখান সঠিক পদ্ধতি

বর্তমানে শিশুদের মধ্যেও নতুন বছর নিয়ে পশ্চিমা সংস্কৃতির প্রভাব বাড়ছে। তাই বাবা-মায়ের দায়িত্ব হলো তাদের সন্তানদের মহররম ও ইসলামী নববর্ষের সঠিক তাৎপর্য জানানো। তাদের কারবালার শহীদদের গল্প শোনান এবং বলুন যে এই মাসে উদযাপন নয়, বরং মানবতা ও ধৈর্যের বার্তা লুকিয়ে আছে। মহররমের শুরু থেকে ইসলামী বছরের নতুন ভোর হয়, যেখানে আল্লাহর কাছে গুনাহ মাফ চাওয়া, ভালো কাজ করার এবং খারাপ অভ্যাস ত্যাগ করার শপথ নিতে হয়। 

এই মাসটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, ধর্ম ও ন্যায়বিচারের জন্য যেকোনো মূল্যে লড়াই করা যেতে পারে, তবে মানবিক মূল্যবোধের সাথে আপস করা যায় না। আজ যখন সারা বিশ্বে সহিংসতা ও ঘৃণার পরিবেশ বাড়ছে, তখন মহররমের বার্তা আমাদের বলে যে, সবচেয়ে বড় বীরত্ব মানবতা, ধৈর্য এবং আত্মত্যাগে। এই কারণেই মুসলমানরা ইসলামিক নববর্ষে শান্তি, ইবাদত, মানবতা এবং ভালো কাজের মাধ্যমে তাদের বছরের সূচনা করে এবং দোয়া করে যে, আগত বছরটি সবার জন্য নিরাপত্তা ও শান্তির বছর হোক।

এই চিন্তা নিয়ে যদি আপনিও এই মহররমে নতুন বছর শুরু করেন, তাহলে শুধু আপনি শান্তি পাবেন না, বরং আল্লাহর বরকত ও রহমতও আপনার জীবনে নেমে আসবে।

Leave a comment