মুন্সী প্রেমচন্দ:
এই গল্পটি মুন্সী প্রেমচন্দ-এর কলম থেকে বেরিয়ে আসা একটি জীবন্ত দৃষ্টান্ত, যেখানে গ্রামের কৃষক ঝিঙ্গুর এবং ভেড়াপালক বুদ্ধুর মধ্যে জমি এবং স্বাভিমানের সংঘাত অত্যন্ত মনোরম এবং গভীরভাবে তুলে ধরা হয়েছে। 'মুক্তি-মার্গ' শুধুমাত্র একটি গল্প নয়, বরং গ্রামীণ জীবনের সেই জটিলতার চিত্রায়ন, যেখানে অর্থনৈতিক স্বার্থ, অহংকার এবং ঐতিহ্যবাহী রীতিনীতি সাধারণ মানুষের জীবনকে প্রভাবিত করে।
ঝিঙ্গুরের জমি এবং তার অহংকারের ছায়া
ঝিঙ্গুর তার জমিগুলি নিয়ে অত্যন্ত গর্বিত ছিল। তার কাছে তিন বিঘা আখের ফসল ছিল, যা তার পরিশ্রম এবং নিষ্ঠার ফল। এই জমির কারণে তার অর্থনৈতিক অবস্থা খুব ভালো ছিল, এবং সে এই বিষয়ে বড়ো অহংকারী ছিল যে তার কখনো টাকার অভাব হয় না। গ্রামের বণিকরাও তার প্রশংসা করত, যার ফলে ঝিঙ্গুরের অহংকার আরও বেড়ে যেত। সে ভাবত যে তার সমান কেউ নেই এবং এই চিন্তাধারাই তাকে অন্যদের থেকে আলাদা করে রাখত।
কিন্তু ঝিঙ্গুরের এই গর্ব তার জন্য একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। সে গ্রামের অনেক মানুষের সাথে ঝগড়া করে রেখেছিল কারণ সে সবসময় নিজেকে সর্বোচ্চ মনে করত। তার কথা এবং আচরণে গ্রামবাসীরা তার প্রতি ক্রোধান্বিত হতে শুরু করেছিল। ঝিঙ্গুরের এই চিন্তাধারা যে সে সবচেয়ে ভালো, তাকে একাকী করে তুলছিল এবং মানুষ তাকে এড়িয়ে চলতে শুরু করেছিল। তার অহংকার ধীরে ধীরে তার এবং গ্রামের মধ্যে দূরত্ব বাড়াতে লাগল।
বুদ্ধুর ভেড়া এবং জমির সংঘাত
বুদ্ধু একজন গোয়াল, যার কাছে ১২ কোড়ি ভেড়া আছে। সে তার ভেড়াগুলিকে জমির মাঝখান দিয়ে পথ দিয়ে ঘাস খাওয়াত, কিন্তু ঝিঙ্গুর এটা একদম পছন্দ করত না। ঝিঙ্গুর চাইত ভেড়াগুলি জমির মেড় (জমির সীমানা) দিয়ে যাক, কিন্তু বুদ্ধুকে তাতে কোনো আপত্তি ছিল না। এই বিষয়ে দুজনের মধ্যে ঝগড়া হয়ে যায়। ঝিঙ্গুর রেগে গিয়ে তার লাঠি দিয়ে ভেড়াগুলিকে মারতে শুরু করে। বুদ্ধু চুপচাপ তার ভেড়াগুলিকে আঘাতপ্রাপ্ত হতে দেখে, কারণ সে জানে যদি সে কিছু বলে তাহলে ঝিঙ্গুরের রুষ্ট হওয়ার ফলে তার আরও বড় ক্ষতি হতে পারে। এভাবে দুজনের মধ্যে জমি এবং ভেড়া নিয়ে সংঘাত বেড়ে যেতে থাকে।
জমিতে আগুন এবং ধ্বংস
একদিন হঠাৎ ঝিঙ্গুরের জমিতে আগুন লেগে যায়। এই আগুন এত তীব্র ছিল যে পুরো আখের ফসল পুড়ে ছাই হয়ে যায়। শুধু ঝিঙ্গুরের ফসলই নষ্ট হয়নি, বরং এর ফলে গ্রামের অনেক কৃষকের আশাও চূর্ণ হয়ে যায়। গ্রামের লোকজন অত্যন্ত দুঃখিত এবং উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে।
তারা ভাবতে শুরু করে যে হয়তো ঝিঙ্গুর এবং বুদ্ধুর মধ্যে যা ঝগড়া এবং শত্রুতা ছিল, তার ফলেই এই আগুন লেগেছে। তাই তারা ঝিঙ্গুরকেই এই ধ্বংসের জন্য দায়ী মনে করতে শুরু করে। এই আগুন গোটা গ্রামে প্রচুর ক্ষতি ও উদ্বেগ ছড়িয়ে দিয়েছে।
অনুতাপ এবং মিলনের চেষ্টা
ঝিঙ্গুর তার ভুলের জন্য অনুতাপ করে, কিন্তু সে সরাসরি স্বীকার করতে দ্বিধা করে। তবুও, সে বুদ্ধুর বাড়িতে গিয়ে তার সাথে কথা বলার চেষ্টা করে। দুজনের মধ্যে আলাপ শুরু হয়, এবং ঝিঙ্গুর বলে যে সে যদি আগুন লাগানো ব্যক্তিকে ধরে ফেলে, তাহলে সে তার ধন্যবাদ জানাবে, কারণ সে তার অহংকার ভেঙে দিয়েছে। বুদ্ধুও এই বিষয়ে একমত হয় যে একে অপরের সাথে ঝগড়া করার কোনো লাভ নেই। তারা দুজনে মিলে তাদের ক্ষোভ ভুলে গিয়ে গ্রামে শান্তি বজায় রাখার চেষ্টা শুরু করে।
এই গল্পটি আমাদের বুঝিয়ে দেয় যে গ্রামীণ জীবনে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিরোধ কীভাবে বড় ধ্বংসের রূপ নিতে পারে। কৃষকের জীবনে কতটা সংগ্রাম ও ত্যাগ থাকে, এবং সেই সংগ্রামে যখন অহংকার ও প্রতিশোধের भावনা যুক্ত হয়, তখন ফলাফল হতে পারে বিধ্বংসাত্মক। প্রেমচন্দ এই গল্পের মাধ্যমে গ্রামীণ জীবনের সংগ্রাম, সামাজিক ঝগড়া এবং তাদের ফলাফল সহজ কিন্তু কার্যকর ভাষায় উপস্থাপন করেছেন।