৭ই এপ্রিল ১৯২০ সালে বনারসে (বর্তমানে বারাণসী) জন্মগ্রহণকারী রবি শঙ্কর, যার পুরো নাম রবীন্দ্র শঙ্কর চৌধুরী, ২০শ শতাব্দীর অন্যতম সেরা ভারতীয় সিতার বাদক ও সঙ্গীতজ্ঞ হিসেবে পরিচিত। তিনি বিশ্বজুড়ে ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতকে পরিচিতি এনে দেওয়ার জন্য স্মরণীয়। তিনি কেবল ভারতেই নয়, আমেরিকা ও ইউরোপেও শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের প্রতি আগ্রহ জাগ্রত করেছিলেন।
শৈশব ও প্রারম্ভিক জীবন
রবি শঙ্করের জন্ম একটি বাঙালি হিন্দু পরিবারে। তার পিতা শ্যাম শঙ্কর চৌধুরী একজন বিখ্যাত আইনজীবী ও রাজনীতিবিদ ছিলেন, যিনি মূলত বর্তমান বাংলাদেশের নারায়েল জেলার বাসিন্দা ছিলেন। রবি শঙ্কর তার সাত ভাইবোনের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ ছিলেন। দশ বছর বয়সে তিনি তার বড় ভাই উদয় শঙ্করের নৃত্যদলের সাথে প্যারিস চলে যান। সেখান থেকেই তার কলা ও সংস্কৃতির সাথে গভীর সম্পর্ক গড়ে ওঠে।
উদয় শঙ্করের সাথে থাকাকালীন তিনি নৃত্য শিখেন এবং ইউরোপ-আমেরিকা ভ্রমণ করেন। এই সময় তিনি পাশ্চাত্য সঙ্গীত, চলচ্চিত্র ও ফরাসি ভাষার সাথে পরিচিত হন। কিন্তু তার জীবনের আসল দিকনির্দেশনা বদলে যায় যখন তিনি ১৩ বছর বয়সে কলকাতায় এক সংগীত সম্মেলনে উস্তাদ আলাউদ্দিন খানকে সিতার বাজাতে শুনেন।
গুরু আলাউদ্দিন খানের কাছ থেকে শিক্ষা
১৮ বছর বয়সে রবি শঙ্কর নৃত্য ত্যাগ করেন এবং মেহের গিয়ে উস্তাদ আলাউদ্দিন খানের কাছ থেকে সাত বছর ধরে কঠোর প্রশিক্ষণ নেন। এই প্রশিক্ষণ ছিল ঐতিহ্যগত গুরুকুল পদ্ধতিতে, যেখানে তিনি খান সাহেবের পরিবারের সাথে থাকতেন। তিনি সিতার ও সুরবাহারের মতো বাদ্যযন্ত্রে দক্ষতা অর্জন করেন, পাশাপাশি ধ্রুপদ, ধামার, খিয়ালের মতো সঙ্গীত শৈলী অধ্যয়ন করেন। তিনি রুদ্র বীণা, রুবাব ও সুরসিংহারের মতো অন্যান্য বাদ্যযন্ত্রের কৌশলও শিখেন। ১৯৩৯ সালে তিনি প্রথমবারের মতো জনসম্মুখে সিতারে পারফর্ম করেন এবং ১৯৪৪ সালে তার আনুষ্ঠানিক শিক্ষা সম্পূর্ণ করেন।
চলচ্চিত্র ও রেডিওতে সঙ্গীতের যাত্রা
১৯৪০-এর দশকে তিনি মুম্বাই চলে যান এবং ইন্ডিয়ান পিপলস থিয়েটার অ্যাসোসিয়েশনের সাথে যুক্ত হন। এখানেই তিনি বিখ্যাত গান "সারে জাহান সে আচ্ছা"-র জন্য সুরারোপ করেন। ১৯৪৯ থেকে ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত তিনি অল ইন্ডিয়া রেডিও (AIR), নয়াদিল্লীর সঙ্গীত পরিচালক ছিলেন। তিনি AIR-এর জন্য ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল অর্কেস্ট্রার স্থাপনা করেন এবং অনেক চলচ্চিত্রের সঙ্গীতে অবদান রাখেন, যার মধ্যে গোদান ও অনুরাধা উল্লেখযোগ্য।
আন্তর্জাতিক মঞ্চে পরিচিতি
১৯৫৬ সালে রবি শঙ্কর বিদেশে ভারতীয় সঙ্গীত নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি ইউরোপ ও আমেরিকা ভ্রমণ শুরু করেন, যেখানে তিনি কেবল পারফর্ম করেননি বরং শ্রোতাদের ভারতীয় রাগের গভীরতা সম্পর্কে পরিচিত করে তোলেন। ১৯৬০-এর দশকে তিনি বিখ্যাত ভায়োলিন বাদক ইয়েহুদি মেনুহিন এবং বিটলসের গিটারিস্ট জর্জ হ্যারিসনের সাথে মিলে ভারতীয় সঙ্গীতকে পাশ্চাত্য বিশ্বে জনপ্রিয় করে তোলেন।
জর্জ হ্যারিসনের সাথে তার বন্ধুত্ব ভারতীয় বাদ্যযন্ত্রকে পপ সঙ্গীতে স্থান দিয়েছিল। রবি শঙ্কর পাশ্চাত্য সঙ্গীতের সাথে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে সিতার ও অর্কেস্ট্রার জন্য অনেক রচনাও করেন।
প্রতিষ্ঠান স্থাপন ও সম্মাননা
১৯৬২ সালে তিনি মুম্বাইতে কিন্নরা স্কুল অফ মিউজিক প্রতিষ্ঠা করেন এবং শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের শিক্ষাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেন। এছাড়াও তিনি ১৯৮৬ থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত রাজ্যসভার মনোনীত সদস্য ছিলেন।
রবি শঙ্করকে ১৯৯৯ সালে ভারতের সর্বোচ্চ नागरिक সম্মান ভারত রত্ন প্রদান করা হয়। এছাড়াও তিনি চারটি গ্র্যামি অ্যাওয়ার্ড, পোলার মিউজিক প্রাইজ এবং অস্কার মনোনয়ন (চলচ্চিত্র গান্ধীর জন্য) সহ আরও অনেক আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেয়েছেন।
ব্যক্তিগত জীবন ও পরিবার
রবি শঙ্করের ব্যক্তিগত জীবনও তার সঙ্গীত জীবনের মতোই আকর্ষণীয় ছিল। তিনি একবার নয়, বহুবার বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন এবং জীবনের বিভিন্ন সময়ে ভারত, আমেরিকা ও ইউরোপের মতো দেশে সময় কাটান। তার পরিবারেও সঙ্গীতের ঐতিহ্য অব্যাহত ছিল। তার কন্যারা – অনুষ্কা শঙ্কর ও নোরা জোন্স – উভয়ই আন্তর্জাতিকভাবে বিখ্যাত শিল্পী। অনুষ্কা শঙ্কর একজন বিখ্যাত সিতার বাদক, যিনি তার পিতার কাছ থেকেই প্রশিক্ষণ নিয়েছেন, অন্যদিকে নোরা জোন্স একজন গ্র্যামি অ্যাওয়ার্ড বিজয়ী গায়িকা, যিনি পপ, জ্যাজ ও সোল সঙ্গীতে বিশেষ পরিচিতি অর্জন করেছেন। রবি শঙ্কর তার জীবনে সঙ্গীত ও পরিবার উভয়কেই সমান গুরুত্ব দিয়েছেন।
সঙ্গীতে অবদান
রবি শঙ্করের সবচেয়ে বড় অবদান হল ভারতীয় সঙ্গীতকে বিশ্বব্যাপী পরিচিতি এনে দেওয়া। তিনি পাশ্চাত্য সঙ্গীতের সাথে ভারতীয় রাগের মিশ্রণ করে নতুন রচনা তৈরি করেছেন। তার সঙ্গীত গভীরতা, সাধনা ও নির্মলতার প্রতীক। তার উপস্থাপনায় কেবলমাত্র কারিগরি দক্ষতা নয়, আধ্যাত্মিক শান্তি ও ভারতীয়তার ছোঁয়াও পাওয়া যেত।
তার রচনা – যেমন 'Raga Jog', 'Raga Hamsadhwani', 'West Meets East' – আজও বিশ্বজুড়ে সঙ্গীতপ্রেমীদের দ্বারা প্রশংসিত হয়।
শেষ জীবন ও উত্তরাধিকার
রবি শঙ্কর তার জীবনের শেষ পর্যন্ত পারফর্ম করা চালিয়ে গেছেন। ১১ই ডিসেম্বর ২০১২ সালে আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়ায় তিনি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। কিন্তু তার মৃত্যুর পরেও তার সঙ্গীত যাত্রা আজও বিশ্বজুড়ে জীবন্ত। তার শিষ্য ও কন্যারা তার উত্তরাধিকার বহন করে চলেছেন।
রবি শঙ্কর কেবলমাত্র একজন মহান সঙ্গীতজ্ঞই ছিলেন না, বরং একজন সাংস্কৃতিক রাষ্ট্রদূত ছিলেন, যিনি ভারতীয় সঙ্গীতকে বিশ্বমঞ্চে নিয়ে গেছেন। তার অবদান ভারতকে বিশ্ব সঙ্গীত মানচিত্রে প্রতিষ্ঠিত করেছে। তিনি আগামী প্রজন্মের জন্য একজন অনুপ্রেরণা, যিনি শেখান যে কলা সীমা চেনে না – সে হৃদয়কে একত্র করে।