সেঠ মনোহরদাসের শেষ শিক্ষা ও তার অর্থ

🎧 Listen in Audio
0:00

দিল্লির খ্যাতনামা ব্যবসায়ী সেঠ মনোহরদাস নিজের পরিশ্রম ও বুদ্ধিমত্তার বলে বিশাল এক ব্যবসা গড়ে তুলেছিলেন। তার কারখানায় হাজার হাজার লোক কাজ করত, ঘরে আয়েশের কোনও অভাব ছিল না, কিন্তু তার জীবনে একটা অসম্পূর্ণ অনুভূতি ছিল—তার স্ত্রীর মৃত্যু অনেক আগেই হয়েছিল। তার একমাত্র ছেলে, দুষ্যন্তকে, তিনি ইংল্যান্ডে পড়াশোনার জন্য পাঠিয়েছিলেন যাতে সেও বুদ্ধিমান ও যোগ্য হয়।

শেষ বাক্য

সময় কারো জন্য থেমে থাকে না। হঠাৎ একদিন সেঠ মনোহরদাসের অবস্থা গুরুতর হয়ে পড়ল। ডাক্তাররা হাত তুলে দিলেন। তিনি অবিলম্বে তার সবচেয়ে বিশ্বস্ত বন্ধু জানকীদাসকে ডাকলেন।

"বন্ধু, আমার সময় শেষ হয়ে আসছে," মনোহরদাস দুর্বল কণ্ঠে বললেন।
"এমন কথা বলো না, তুমি ভালো হয়ে যাবে!" জানকীদাস সান্ত্বনা দিলেন।
"না, এখন শুধুমাত্র একটি শেষ ইচ্ছা আছে। যতই হোক না কেন, আমার ছেলেকে ডেকে আনো। আমি তাকে একবার দেখতে চাই এবং তাকে আমার শেষ শিক্ষা দিতে চাই।"

শীঘ্রই দুষ্যন্ত এল। যখন সে তার বাবার হাত ধরল, মনোহরদাসের চোখে শান্তি এল।
"ছেলে, আমি তোমাকে তিনটি কথা শেখাতে চাই, এগুলো সবসময় মনে রাখবে," কাঁপা কণ্ঠে তিনি বললেন।
কখনো কোনও গরিবের উপর দয়া করো না।
কখনো কোনও ধনী ব্যক্তির সাথে বন্ধুত্ব করো না।
অন্ধকারে বাড়ির বাইরে বেরো না।

এতো বলে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন। ঘরে শোকের পরিবেশ ছড়িয়ে পড়ল।

পিতার শিক্ষার প্রথম অর্থ

সময় কেটে গেল, এবং জানকীদাস দুষ্যন্তকে সামলাতে সর্বাত্মক চেষ্টা করলেন। তিনি তাকে ব্যবসা শিখিয়ে দিলেন, এবং শীঘ্রই দুষ্যন্ত ব্যবসা সামলাতে শুরু করল।
কিছুদিন পর দীপাবলির সময় এল। কারখানার শ্রমিকদের প্রতি বছরের মতো বোনাস পাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু দুষ্যন্ত তার বাবার কথা মনে পড়ল—গরিবদের উপর দয়া করো না।

"আমি যদি তাদের বোনাস দেই, তাহলে এটা দয়া দেখানোর মতো হবে," সে ভাবল।
সে বোনাস দেওয়া থেকে বিরত থাকল। শ্রমিকদের মনে হল নতুন মালিক নিষ্ঠুর। তারা কাজে অবহেলা করতে লাগল, এবং ধীরে ধীরে উৎপাদন কমতে লাগল।

দ্বিতীয় শিক্ষার ভুল অর্থ

মাত্র কয়েক মাসের মধ্যে, ব্যবসায়ীদের একটি দল দুষ্যন্তের সাথে দেখা করতে এল। তারা তার বাবার সময় থেকেই ব্যবসায়িক অংশীদার ছিল।
কিন্তু দুষ্যন্ত তার বাবার দ্বিতীয় কথা মনে পড়ল—ধনীর সাথে বন্ধুত্ব করো না।

"বাবা বলেছিলেন ধনীদের থেকে দূরে থাকতে, তারা নিজেদের সুবিধা নেয়," সে ভাবল এবং সেই ব্যবসায়ীদের অপমান করে বের করে দিল।
ফলাফল হল বড় অর্ডার বন্ধ হয়ে গেল এবং ব্যবসা নীচে নেমে যেতে লাগল।

তৃতীয় শিক্ষার প্রভাব

এখন ব্যবসায় লোকসান হতে লাগল। দুষ্যন্তকে ক্রমাগত মিটিং এবং কাজের জন্য বাইরে যেতে হচ্ছিল। কিন্তু সে তার বাবার তৃতীয় শিক্ষা মনে পড়ল—অন্ধকারে বাইরে বেরো না।

তাই সে শুধুমাত্র দিনের বেলায় ব্যবসায়িক ভ্রমণ করত এবং সন্ধ্যা হলেই বাড়ি ফিরে আসত। অনেক বড় চুক্তি যা রাতের বেলায় সম্পন্ন হত, সেগুলো সে হারাতে লাগল। ধীরে ধীরে ব্যবসার অবস্থা খারাপ হতে লাগল।

সত্যের আলো

এখন দুষ্যন্ত ভয় পেয়ে গেল। সে জানকীদাসকে ডেকে পাঠাল এবং সব খবর বলল।
"চাচাজি, আমি বাবার প্রতিটি শিক্ষা মানি, কিন্তু তারপরও সব কিছু নষ্ট হচ্ছে।"
জানকীদাস হাসল এবং বলল, "ছেলে, তুমি কথাগুলো বুঝোনি, শুধু শব্দগুলোতে মনোযোগ দিয়েছ। চলো, আমি তোমাকে এর আসল অর্থ বুঝিয়ে দিচ্ছি।"

তিনি তাকে একটি গলির দিকে নিয়ে গেলেন, যেখানে কিছু গরিব লোক বসে ছিল। পাশে একজন লোক সমুসা বিক্রি করছিল।
"তুমি যদি এই গরিবদের সমুসা কিনে খাওয়াও, তাহলে তারা প্রতিদিন ভিক্ষা চাইতে আসবে। কিন্তু তুমি যদি তাদের সমুসা বানাতে শেখাও, তাহলে তারা পরিশ্রম করে উপার্জন করতে পারবে। তোমার বাবার মানে ছিল গরিবদের দয়া নয়, সুযোগ দাও।"
দুষ্যন্ত প্রথম শিক্ষার সঠিক অর্থ বুঝতে পারল।

দ্বিতীয় শিক্ষার রহস্য

"এখন দ্বিতীয় শিক্ষা বুঝো," জানকীদাস বললেন।
"তোমার বাবার মানে ছিল ব্যবসা করো, কিন্তু তোমার গোপনীয়তা রক্ষা করো। ব্যবসায়ীদের শত্রু করো না, কিন্তু এতটা কাছাকাছিও যেও না যাতে তারা তোমার কৌশল জানতে পারে।"
দুষ্যন্ত এখন তার ভুলের অনুভব করল।

তৃতীয় শিক্ষার সত্য

"এবং তৃতীয় কথা," জানকীদাস বললেন, "তোমার বাবার মানে ছিল অন্ধকারে বাড়ির বাইরে বেরো না অর্থাৎ পরিবার এবং স্বাস্থ্যকে সময় দাও। তুমি যদি প্রতি রাতে ব্যবসায় ব্যস্ত থাকো, তাহলে তুমি তোমার প্রিয়জনদের থেকে দূরে চলে যাবে এবং শত্রুদের জন্য সহজ লক্ষ্যবস্তু হয়ে উঠবে।"
এখন দুষ্যন্ত তার বাবার শিক্ষার আসল অর্থ বুঝতে পারল।

নতুন সূচনা

পরের দিন থেকে দুষ্যন্ত ব্যবসার সব সিদ্ধান্ত সঠিকভাবে নিতে শুরু করল। শ্রমিকদের বোনাস দিল, ফলে তারা আবার পরিশ্রম করে কাজ করতে লাগল। ব্যবসায়ীদের সাথে ভারসাম্য বজায় রেখে চুক্তি করল, এবং ধীরে ধীরে ব্যবসা আবার ফলপ্রসূ হতে লাগল।
কিছুদিনের মধ্যে, দুষ্যন্ত শুধুমাত্র একজন সফল ব্যবসায়ীই হল না, একজন ভালো মানুষও হল।
শিক্ষা: শব্দের নয়, তাদের সঠিক অর্থের অনুসরণ করো, তবেই সাফল্য এবং সুখ উভয়ই তোমার হবে।

```

Leave a comment