কানশীराम: দলিত আন্দোলনের এক অম্লান নেতা

🎧 Listen in Audio
0:00

ভারতীয় রাজনীতি ও সামাজিক চেতনার ইতিহাসে কানশীराम এমন এক নাম যিনি শুধুমাত্র দলিত, পিছিয়ে পড়া ও শোষিত শ্রেণীর অধিকারের জন্য সংগ্রাম করেননি, বরং তাদের মধ্যে আত্মসম্মান ও আত্মশক্তির বিকাশ ঘটিয়েছেন। ডঃ ভীমরাও আম্বেদকরের পর যদি কেউ বহুজন সমাজকে রাজনৈতিক মঞ্চে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন, তিনি হলেন — কানশীराम। তার জীবন শুধু একজন রাজনীতিবিদের নয়, বরং একটা আদর্শের প্রতীক ছিল, যা দলিত সমাজকে অবহেলার অন্ধকার থেকে উত্তোলন করে ভারতের মুখ্যধারায় নিয়ে আসার স্বপ্ন দেখে জীবনযাপন করেছিল।

প্রাথমিক জীবন ও জাতিগত বৈষম্যের প্রথম সাক্ষাৎ

১৫ই মার্চ ১৯৩৪ সালে পাঞ্জাবের হোশিয়ারপুর জেলায় জন্মগ্রহণকারী কানশীराम একটি সাধারণ দলিত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি বিজ্ঞান বিষয়ে পড়াশোনা করেন এবং সরকারি চাকরিতে নির্বাচিত হয়ে পুণের বিস্ফোরক গবেষণা ও উন্নয়ন প্রতিষ্ঠান (DRDO) -তে কর্মরত হন। কিন্তু সেখানেই তিনি এমন জাতিগত বৈষম্যের সম্মুখীন হন যা তার জীবনের দিক পরিবর্তন করে দেয়। যখন তিনি দেখেন অফিসে ডঃ আম্বেদকরের জন্মদিন পালনকারীদের অপমান করা হচ্ছে, তখন তা তার জন্য চেতনার স্পার্ক হিসেবে কাজ করে।

'দি এনিহিলেশন অফ কাস্ট' থেকে পাওয়া দিকনির্দেশনা

ডঃ ভীমরাও আম্বেদকরের বিখ্যাত বই 'দি এনিহিলেশন অফ কাস্ট' (জাতি নির্মূল) পড়ার পর কানশীरामের চিন্তাভাবনা সম্পূর্ণরূপে বদলে যায়। এই বইটি তাকে জাতিগত বৈষম্যের মূল কারণ বুঝতে এবং তা নির্মূল করার পথ দেখায়। তিনি বুঝতে পারেন যে যদি সত্যিই সমাজকে বদলাতে হয়, তাহলে শুধু চাকরিতে থেকে নয়, বরং বাইরে এসে সামাজিক আন্দোলন করতে হবে। এই চিন্তাভাবনার সাথে তিনি তার সরকারি চাকরি ছেড়ে দেন এবং দলিত সমাজের অধিকার ও সম্মানের জন্য নিজেকে সম্পূর্ণভাবে নিবেদন করেন। এখান থেকেই তার সংগ্রামের আসল সূচনা হয়, যা পরবর্তীতে একটি সামাজিক বিপ্লবে রূপান্তরিত হয়।

BAMCEF-এর প্রতিষ্ঠা: সংগঠিত চেতনার সূচনা

১৯৭১ সালে তিনি সর্বভারতীয় SC, ST, OBC এবং সংখ্যালঘু কর্মচারী সংঘের প্রতিষ্ঠা করেন, যা পরবর্তীতে BAMCEF (Backward and Minority Communities Employees Federation) নামে পরিচিত হয়। এটি কোন রাজনৈতিক সংগঠন ছিল না, বরং একটি আদর্শিক আন্দোলন ছিল, যার উদ্দেশ্য ছিল সমাজের শিক্ষিত শ্রেণীকে আম্বেদকরবাদে যুক্ত করা। এই সংগঠনটি সেই শ্রেণীকে সচেতন করে তোলে যারা সরকারি চাকরিতে ছিল, কিন্তু তাদের সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল।

DS4 থেকে BSP পর্যন্ত: বহুজন সমাজের রাজনৈতিক শক্তি

১৯৭৮ সালে তিনি DS4 (দলিত শোষিত সমাজ সংগ্রাম সমিতি) প্রতিষ্ঠা করেন এবং ১৯৮৪ সালে বহুজন সমাজ পার্টি (BSP) -র ভিত্তি স্থাপন করেন। তিনি স্পষ্টভাবে বলেছিলেন যে 'আমরা প্রথম নির্বাচন হারার জন্য, দ্বিতীয় পরিচয় সৃষ্টির জন্য এবং তৃতীয় জয়ের জন্য লড়াই করব।' এই আত্মবিশ্বাসই দলিত রাজনীতিকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যায়।

BSP-র রাজনীতি শুধুমাত্র ক্ষমতার জন্য ছিল না, বরং এটি একটি সামাজিক বিপ্লব ছিল। তিনি তার 'দ্য চামচা এজ' শীর্ষক লেখায় কংগ্রেস ও বিজেপি-র মতো দলের 'সহযোগী' হয়ে থাকা দলিত নেতাদের তীব্র সমালোচনা করেছেন। তিনি তাদের 'চামচা' (stooge) বলে অভিহিত করেছেন এবং দলিতদের প্রতি আবেদন জানিয়েছেন যে তারা নিজেদের রাজনৈতিক শক্তি গঠন করুক, কারোরও দাসত্ব করুক না।

লোকসভার যাত্রা ও মায়াবতীকে উত্তরাধিকারী নির্বাচন

১৯৮৪ সালে তিনি জান্জগির-চম্পা থেকে লোকসভা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। যদিও তিনি জয়ী হননি, তবে BSP উত্তরপ্রদেশে নিজের ভিত্তি স্থাপন শুরু করেছিল। ১৯৯১ সালে ইটাওয়া থেকে তিনি জয়ী হন এবং লোকসভায় প্রবেশ করেন। ১৯৯৬ সালে তিনি আবার হোশিয়ারপুর থেকে লোকসভায় প্রবেশ করেন।

২০০১ সালে তিনি জনসমক্ষে মায়াবতীকে তার উত্তরাধিকারী ঘোষণা করেন। এই সিদ্ধান্ত তিনি সুচিন্তিতভাবে নিয়েছিলেন কারণ তিনি জানতেন যে বহুজন আন্দোলনের ধারাবাহিকতা প্রয়োজন এবং নেতৃত্বে স্পষ্টতা থাকতে হবে।

ধর্ম পরিবর্তনের ইচ্ছা ও অসম্পূর্ণ স্বপ্ন

২০০২ সালে তিনি ঘোষণা করেন যে ১৪ অক্টোবর ২০০৬ সালে ডঃ আম্বেদকরের বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণের ৫০ বছর পূর্ণ হওয়ার দিন তিনি নিজেও বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করবেন এবং তার সাথে ৫ কোটি সমর্থকও বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করবেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত ৯ই অক্টোবর ২০০৬ সালে তার মৃত্যু হয় এবং এই ঐতিহাসিক মুহূর্ত অসম্পূর্ণ থেকে যায়।

পরে মায়াবতী স্পষ্ট করেছেন যে ধর্ম পরিবর্তনের স্বপ্ন তিনি ক্ষমতার সাথে জড়িত করে রেখেছিলেন — 'ক্ষমতা আমাদের হাতে থাকলেই ধর্ম পরিবর্তন করবো যাতে একটি বিপ্লবী পরিবর্তন আসতে পারে।'

কানশীरामের সাহিত্যিক অবদান

তিনি 'দ্য চামচা এজ' এবং 'বার্থ অফ BAMCEF' এর মতো বিপ্লবী বই লিখেছেন। তার বক্তৃতা ও চিন্তাধারা অনেক লেখক সংগ্রহ করেছেন, যার মধ্যে 'বহুজন নায়ক কানশীरामের অবিস্মরণীয় বক্তৃতা' এবং 'কানশীराम: দলিতদের নেতা' উল্লেখযোগ্য।

কানশীरामের জীবন শুধু একজন ব্যক্তির গল্প নয়, বরং কোটি কোটি মানুষের আশা ও সংগ্রামের কাহিনী। তিনি ডঃ আম্বেদকরের পর বহুজন আন্দোলনে যা শূন্যতা ছিল, তা শুধুমাত্র পূরণ করেননি, বরং তাতে নতুন শক্তিও যোগ করেছেন। আজ ভারতে যদি বহুজন সমাজ নিজের কথা খোলাখুলিভাবে বলতে পারে, তার পিছনে কানশীरामের অমূল্য অবদান রয়েছে।

```

Leave a comment