গোস্বামী তুলসীদাসের জীবনের রূপান্তর: রামবোলা থেকে মহান সন্ত

🎧 Listen in Audio
0:00

গোস্বামী তুলসীদাসের নাম শুনলেই আমাদের চোখের সামনে ভক্তি, ত্যাগ ও সাহিত্যের এমন এক ছবি ভেসে ওঠে যা ভারতীয় সংস্কৃতিকে এক নতুন মাত্রা দিয়েছে। কিন্তু জানেন কি, এই মহান সন্তের জীবন এক সময় সাংসারিক মোহে ডুবে ছিল? তাঁর বৈরাগ্যের পথের সূচনা হয়েছিল এমন এক ঘটনার মাধ্যমে যা তাঁর সমগ্র জীবনের দিকই বদলে দিয়েছিল। এটাই সেই ঘটনা যা ‘রামবোলা’কে গোস্বামী তুলসীদাসে রূপান্তরিত করেছিল।

জন্ম ও প্রারম্ভিক জীবন

তুলসীদাসের জন্ম ৪ আগস্ট উত্তরপ্রদেশের চিত্রকুট জেলার রাজাপুর গ্রামে হয়েছিল। তাঁর জন্ম নিয়ে একটি রোমাঞ্চকর কিংবদন্তী প্রচলিত আছে যে, তিনি জন্মগ্রহণের পর মুখে প্রথম শব্দ হিসেবে ‘রাম’ উচ্চারণ করেছিলেন। এই কারণেই তাঁর নাম ‘রামবোলা’ রাখা হয়েছিল। তাঁর শৈশব ছিল অত্যন্ত দুঃখময়। খুব ছোট বয়সেই তাঁর পিতামাতার মৃত্যু হয়। অনাথ হয়ে তাঁকে নানা কষ্ট ও অভাবের মধ্যে জীবনযাপন করতে হয়েছিল। কিন্তু এই দুঃখের মধ্যেও তাঁর মনে ভগবান রামের প্রতি গভীর ভক্তি বজায় ছিল।

অল্প বয়সেই তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে তাঁর জীবনের উদ্দেশ্য হল রামভক্তি। বাল্যকালে যা তাঁর হৃদয়ে ভগবান রামের প্রতি প্রেম জেগেছিল, তাই পরবর্তীকালে তাঁর জীবনের দিক নির্দেশ করেছিল। কঠিন পরিস্থিতির মধ্যেও তিনি ভগবান রামের নাম ত্যাগ করেননি এবং এই ভাবনাই পরবর্তীকালে তাঁকে একজন মহান সন্ত ও কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে সাহায্য করেছিল।

সাংসারিক প্রেমে ডুবে এক ভক্ত

তুলসীদাস যখন যুবক ছিলেন, তখন তাঁর বিয়ে হয় রত্নাবলী নামক এক অত্যন্ত সুন্দরী, বুদ্ধিমান ও ধর্মপ্রাণ মহিলার সাথে। রত্নাবলীর স্বভাব যতটা শান্ত ছিল, ততটাই তিনি ছিলেন সংস্কৃত। তুলসীদাস তাঁর স্ত্রীর প্রতি অপার ভালোবাসা করতেন। তিনি তাঁর ছাড়া এক মুহূর্তও থাকতে পারতেন না এবং সর্বদা তাঁর কথাই ভাবতেন। তাঁর জীবনে ভগবানের চেয়ে স্ত্রীর গুরুত্ব বেশি হয়ে উঠেছিল। তিনি তাঁর রূপ, বাক্য ও সঙ্গে এতটাই মগ্ন হয়ে পড়েছিলেন যে, তাঁর কাছে পৃথিবীর অন্যান্য জিনিস অর্থহীন মনে হতে শুরু করেছিল। কিন্তু এই প্রেম যা প্রথমে আনন্দের ছিল, ধীরে ধীরে তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড় পরীক্ষা হয়ে দাঁড়ায়।

রত্নাবলী জানতেন যে তুলসীদাসের মধ্যে কিছু বড়ো করার ক্ষমতা আছে, কিন্তু এই অন্ধ প্রেম তাঁকে তাঁর পথ থেকে বিচ্যুত করছে। তাঁর চিন্তা ছিল যে, কখনো তুলসীদাস তাঁর জীবনের উদ্দেশ্য ভুলে না যান, এবং এই চিন্তাই একদিন ইতিহাস বদলে দিয়েছিল।

সেই রাত যা সবকিছু বদলে দিয়েছিল

একবারের কথা, তুলসীদাসের স্ত্রী রত্নাবলী কয়েকদিনের জন্য তাঁর বাপের বাড়ি গিয়েছিলেন। তুলসীদাস তাঁর প্রতি এত ভালোবাসা করতেন যে, তিনি তাঁর ছাড়া এক মুহূর্তও থাকতে পারছিলেন না। কয়েকদিনের মধ্যেই তাঁর মন খুব অস্থির হয়ে উঠল। তখন শ্রাবণ মাস, আকাশে প্রবল বৃষ্টি হচ্ছিল এবং নদীতে বন্যা চলছিল। এমন আবহাওয়ায় কোনো বুদ্ধিমান মানুষ ঘর থেকে বের হবে না, কিন্তু প্রেমে মত্ত তুলসীদাস কোনো বিপদের কথা ভাবেননি। তিনি যত্ন করেই হোক না কেন, রত্নাবলীর সাথে দেখা করার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠলেন।

যখন তিনি নদীর ধারে পৌঁছলেন, তখন একজন নাবিক তাঁকে পারাপার করতে অস্বীকার করলেন। তখন তিনি যা দেখলেন তা ছিল চমকপ্রদ। একটা মৃতদেহ নদীতে ভেসে যাচ্ছিল, এবং তুলসীদাস তা কাঠ ভেবে তার সাহায্যে নদী পার হয়ে গেলেন। কষ্ট করে তিনি তাঁর শ্বশুরবাড়িতে পৌঁছালেন এবং সেখানেও তিনি একটা সাপকে রশি ভেবে ধরেছিলেন যাতে করে দেওয়ালে উঠে ভেতরে যেতে পারেন। এমনকি, দেওয়ালে ওঠার জন্য যাকে তিনি বাঁশ ভেবেছিলেন, সেটি আসলে কোনো প্রাণীর শুষ্ক হাড় ছিল।

যখন তিনি রাতের অন্ধকারে তাঁর স্ত্রীর ঘরে পৌঁছলেন এবং রত্নাবলী তাঁকে এ অবস্থায় দেখলেন, তখন তিনি অবাক হয়ে গেলেন। যখন তুলসীদাস তাঁকে সব কথা বললেন, তখন একজন স্ত্রী হিসেবে নয়, বরং একজন বুদ্ধিমান নারী হিসেবে রত্নাবলী তাঁকে বুঝিয়ে দিলেন। তিনি বললেন, “যদি তুমি আমার হাড়-মাংসের দেহের সাথে এত ভালোবাসা করো, তাহলে একটু ভেবে দেখো, যদি এতটুকু ভালোবাসা ভগবান রামের প্রতি করতে, তাহলে তোমার জীবন ধন্য হতো।” রত্নাবলীর এই কথা তুলসীদাসের হৃদয়ে এমন প্রভাব ফেলেছিল যে, সেই মুহূর্ত থেকেই তাঁর মন বৈরাগ্যের দিকে ঘুরে গেল। এটাই সেই রাত যা ‘রামবোলা’কে গোস্বামী তুলসীদাসে পরিণত করেছিল।

স্ত্রীর তিরস্কার জীবনের দিক নির্দেশ করেছিল

রত্নাবলী যখন দেখলেন যে তুলসীদাস তাঁর প্রেমে এত অন্ধ হয়ে গেছেন যে, দিন-রাত শুধু তাঁকেই স্মরণ করেন, তখন একদিন তিনি ক্রোধে, কিন্তু খুব গভীর শব্দে তুলসীদাসকে চমকে দিলেন। তিনি বললেন, যদি তুমি আমার এই নাশ্বর দেহের সাথে এত ভালোবাসা করো, তাহলে ভেবে দেখো, যদি এই ভালোবাসা ভগবান রামের প্রতি করতে, তাহলে এতদিনে তুমি সংসারের বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে যেতে পারতে। তাঁর এই কথা সরাসরি তুলসীদাসের অন্তরে প্রবেশ করল। যেন কোনো একজন ঘুমন্ত মানুষকে হঠাৎ জাগ্রত করে দিল। সেই মুহূর্তেই তুলসীদাস তাঁর জীবনের সত্য বুঝতে পারলেন।

তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন যে, এখন তিনি স্ত্রী, পরিবার ও সংসারের অন্যান্য বন্ধন ত্যাগ করে সম্পূর্ণরূপে ভগবান রামের ভক্তিতে নিজেকে নিয়োজিত করবেন। রত্নাবলীর একটা তিরস্কার তাঁর জীবনের দিক বদলে দিল এবং একজন সাধারণ গৃহস্থ থেকে তিনি মহান সন্ত হয়ে উঠলেন, যিনি পরবর্তীকালে ‘রামচরিতমানস’ এর মতো অমর গ্রন্থ রচনা করেন।

বৈরাগ্যের দিকে প্রথম পদক্ষেপ

রত্নাবলীর সেই একটা সত্য ও তীব্র কথা তুলসীদাসের অন্তরকে গভীরভাবে স্পর্শ করেছিল এবং তাঁকে ভেতর থেকে নাড়িয়ে দিয়েছিল। পরদিনই তিনি তাঁর বাড়ি ছেড়ে সম্পূর্ণভাবে বৈরাগ্যের পথে পা বাড়ালেন। এখন তাঁর মন সাংসারিক মোহ-মায়া থেকে দূরে সরে ভগবান রামের ভক্তিতে মগ্ন হয়ে গেল। তিনি গ্রামে গ্রামে ও শহরে শহরে ঘুরে বেড়াতেন, সর্বত্র রামের নাম জপ করতেন এবং ভগবানের এক ঝলক পেতে প্রার্থনা করতেন। তাঁর হৃদয়ে যা ভক্তির আগুন জ্বলে উঠেছিল, তা দিন দিন আরও প্রজ্জ্বলিত হতে লাগল। এই ভক্তিই তাঁকে সেই মহান সন্ত করে তুলেছিল, যিনি পরে ‘রামচরিতমানস’ এর মতো অমর রচনা করেছিলেন। তুলসীদাসের এই যাত্রা ছিল বৈরাগ্য ও ভক্তির প্রথম সোপান, যা তাঁকে আধ্যাত্মিকতার উচ্চ শিখরে পৌঁছে দিয়েছিল।

রামচরিতমানসের রচনা

তুলসীদাস যখন বৈরাগ্যের পথে পা বাড়ালেন, তখন তিনি অনেক তীর্থস্থান ভ্রমণ করতে শুরু করলেন। তিনি কাশী, অযোধ্যা ও চিত্রকুটের মতো পবিত্র স্থানে গভীর সাধনা করেছিলেন। তাঁর ভক্তি ও তপস্যায় প্রসন্ন হয়ে ভগবান শিব তাঁকে আশীর্বাদ করেছিলেন। এরপর তিনি হনুমানজীর দর্শন পেয়েছিলেন, যিনি তাঁকে অযোধ্যায় ভগবান রামের দর্শন করিয়েছিলেন। এটাই সেই গুরুত্বপূর্ণ মোড় যা তুলসীদাসের জীবনে নতুন শক্তি এনেছিল এবং তিনি ভগবান রামের চরিত্রের গভীর অধ্যয়ন করেছিলেন। এই আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতার পর তিনি ‘রামচরিতমানস’ রচনা শুরু করেন, যা তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত রচনা হয়ে ওঠে।

রামচরিতমানস তুলসীদাস অবধি ভাষায় লিখেছিলেন যাতে সাধারণ মানুষের কাছেও সহজে পৌঁছে যায় এবং মানুষ ভগবান রামের মহিমাকে বুঝতে পারে। এই কাব্য শুধুমাত্র একটা ধর্মগ্রন্থ নয়, বরং ভারতীয় সংস্কৃতি ও সমাজের আত্মাও। এছাড়াও তুলসীদাস হনুমান চালীসা, বিনয় পত্রিকা, দোহাবলী ও কবিতাবলীর মতো আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ ও জনপ্রিয় কাব্য রচনা করেছেন। তাঁর এই রচনাগুলি আজও মানুষের কাছে অত্যন্ত প্রিয় এবং তাঁদের ভক্তিভাবনাকে জাগ্রত করে। তুলসীদাসের এই সাহিত্যিক অবদান শতাব্দী ধরে ভারতীয় সমাজের জন্য मार्गदर्शन ও প্রেরণার উৎস হয়ে আছে।

তুলসীদাসের জীবনের প্রেরণা

গোস্বামী তুলসীদাসের জীবন আমাদের শিক্ষা দেয় যে, যদি কোনো ব্যক্তি উপযুক্ত সময়ে তাঁর ভেতরের সত্য বুঝতে পারে এবং আত্মবোধ করতে পারে, তাহলে তিনি তাঁর জীবনকে অত্যন্ত সফল ও উন্নত করতে পারেন। তুলসীদাসের প্রেরণার উৎস ছিল তাঁর স্ত্রী রত্নাবলীর সেই সত্য ও কঠোর শিক্ষা, যা তাঁকে সাংসারিক প্রেম থেকে উত্তোলন করে ভগবান রামের ভক্তিতে নিয়োজিত করেছিল। তুলসীদাস শুধুমাত্র একজন ভক্ত বা কবিই ছিলেন না, বরং তিনি ছিলেন একজন মহৎ সমাজ সংস্কারক।

তাঁর লেখন ও কাব্যের মাধ্যমে তিনি মানুষের অন্তরে প্রেম, ভক্তি, ত্যাগ ও নীতিবোধের भावना জাগ্রত করেছেন। তাঁর রচনাগুলি আজও সমাজকে সঠিক পথ দেখানোর কাজ করে এবং আমাদের জীবনে সত্যতা, সততা ও নিষ্ঠার গুরুত্ব বুঝিয়ে দেয়। এইভাবে তাঁর জীবন ও কাব্য উভয়ই আমাদেরকে প্রেরণা দেয় যাতে আমরাও আমাদের জীবনে উচ্চ আদর্শ গ্রহণ করি এবং আমাদের কর্তব্যগুলি সততায় পালন করি।

‘রামবোলা’ থেকে ‘গোস্বামী তুলসীদাস’ হওয়ার এই যাত্রা শুধুমাত্র একজন ব্যক্তির গল্প নয়, বরং এটি বলে যে, জীবনে পরিবর্তন সর্বদা সম্ভব—পরিস্থিতি যাই হোক না কেন। যদি ভেতরে জাগ্রতি হয়, তাহলে সাংসারিক মোহও ঈশ্বরের কাছে পৌঁছানোর এক সোপান হতে পারে।

Leave a comment