২০২৫ সালের সোমবতী অমাবস্যা: তিথি, গুরুত্ব, পূজা পদ্ধতি ও দান

🎧 Listen in Audio
0:00

হিন্দু ধর্মে প্রতিটি অমাবস্যা তিথিকে বিশেষ আধ্যাত্মিক গুরুত্ব দেওয়া হয়, কিন্তু যখন অমাবস্যা সোমবারে পড়ে, তখন তাকে সোমবতী অমাবস্যা বলা হয়। ২০২৫ সালে এই শুভ তিথি ২৬ মে, সোমবার পড়ছে। এই দিনটি ভগবান শিবের আরাধনা, পবিত্র স্নান, দান এবং মন্ত্র জপের জন্য অত্যন্ত ফলদায়ক বলে মনে করা হয়। বিশ্বাস করা হয় যে এই দিনে করা পুণ্যকর্ম দ্বারা পিতৃদোষ শান্ত হয় এবং শিবের কৃপায় জীবনে শান্তি, সমৃদ্ধি এবং স্বাস্থ্যের প্রাপ্তি হয়।

সোমবতী অমাবস্যা ২০২৫: তিথি এবং গুরুত্ব

এই বছর সোমবতী অমাবস্যা ২৬ মে ২০২৫, সোমবার পড়ছে। এই তিথি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হয় কারণ যখন অমাবস্যার দিন সোমবারে আসে, তখন তাকে সোমবতী অমাবস্যা বলা হয়। এই দিনটি ভগবান শিবের পূজা, পবিত্র নদীতে স্নান, পিতৃদের জন্য তর্পণ, দান-পুণ্য এবং মন্ত্র জপের জন্য অত্যন্ত শুভ বলে মনে করা হয়। বিশেষ করে শিবভক্তদের জন্য এই দিনটি অত্যন্ত ফলদায়ক হয়।

ধর্মীয় বিশ্বাস অনুযায়ী, সোমবতী অমাবস্যায় করা সকল সৎ কাজ যেমন—স্নান, পূজা, দান ইত্যাদির ফল অনেক গুণ বেশি হয়। এই দিনটি পূর্বপুরুষদের আত্মার শান্তির জন্যও অত্যন্ত শুভ বলে মনে করা হয়। বলা হয় এই দিনে তর্পণ করলে পিতৃগণ প্রসন্ন হন এবং জীবনে সুখ-সমৃদ্ধির আশীর্বাদ দেন। এইজন্যই ভক্তরা এই দিনটি অত্যন্ত শ্রদ্ধা ও নিয়ম মেনে পালন করেন।

স্নান-দানের শুভ মুহূর্ত

পবিত্র নদী বা তীর্থস্থানে স্নান করে দান করা এই দিনে সবচেয়ে শুভ বলে মনে করা হয়। এই বার সোমবতী অমাবস্যার দিন নিম্নলিখিত মুহূর্ত বিশেষভাবে পবিত্র বলে মনে করা হচ্ছে:

  • ব্রহ্ম মুহূর্ত: সকাল ৪:০৩ মিনিট থেকে ৪:৪৪ মিনিট পর্যন্ত
  • প্রাতঃকালীন মুহূর্ত: সকাল ৪:২৪ মিনিট থেকে ৫:২৫ মিনিট পর্যন্ত
  • অভিজিৎ মুহূর্ত: দুপুর ১১:৫১ মিনিট থেকে ১২:৪৬ মিনিট পর্যন্ত

এই পদ্ধতিতে করুন ভগবান শিবের পূজা

  • সকালে তাড়াতাড়ি উঠে স্নান করুন: এই পবিত্র দিনের শুরু সকালে তাড়াতাড়ি উঠে করুন। সূর্য উঠার আগে উঠলে উত্তম বলে মনে করা হয়। স্নানের জন্য গঙ্গাজল অথবা তুলসী পাতা মিশিয়ে জল ব্যবহার করুন। এতে শরীর ও মন উভয়ই পরিশুদ্ধ হয়। স্নানের পর পরিষ্কার ও হালকা রঙের পোশাক পরুন। সাদা বা হলুদ রঙ সবচেয়ে শুভ বলে মনে করা হয়।
  • শিব মন্দিরে যান অথবা ঘরে পূজা করুন: যদি আপনার কাছে কোনও নিকটবর্তী শিব মন্দির থাকে, তাহলে সেখানে গিয়ে পূজা করুন। যদি মন্দিরে যেতে না পারেন তাহলে ঘরে পরিষ্কার স্থানে শিবলিঙ্গ স্থাপন করে সেখানেই পূজা করতে পারেন। স্থানটি আগে জল দিয়ে পবিত্র করুন এবং তারপর পূজার প্রস্তুতি করুন।
  • শিবলিঙ্গের পঞ্চামৃত অভিষেক করুন: পূজার শুরু শিবলিঙ্গে জল দিয়ে করুন। গঙ্গাজল হলে সবচেয়ে ভালো, না হলে পরিষ্কার জলও চলবে। তারপর দুধ, দই, ঘি, মধু এবং চিনি দিয়ে শিবলিঙ্গের অভিষেক করুন। একে ‘পঞ্চামৃত অভিষেক’ বলা হয়। শেষে আবার পরিষ্কার জল দিয়ে শিবলিঙ্গ ধুয়ে দিন।
  • ভগবান শিবকে প্রিয় জিনিসপত্র অর্পণ করুন: এবার ভগবান শিবকে বেলপাতা অর্পণ করুন। মনে রাখবেন বেলপাতা পরিষ্কার হবে এবং উল্টো হবে না। এর সাথে সাথে ধতুরা, আকন্দ, সাদা ফুল, ভস্ম এবং ভাংও অর্পণ করুন। এই সকল জিনিস শিবজি কে অত্যন্ত প্রিয় বলে মনে করা হয়।
  • দীপক এবং ধূপ জ্বালান: পূজার সময় একটি দীপক অবশ্যই জ্বালান যাতে দেশী গরুর ঘি থাকবে। সাথে ধূপ বা আগরবাতিও জ্বালান। এতে পূজার পরিবেশ পবিত্র এবং শান্ত হয় এবং মন একাগ্র হয়।
  • মন্ত্র জপ এবং পাঠ করুন: এবার ভগবান শিবের প্রিয় মন্ত্রের জপ করুন। “ॐ নমঃ শিবায়” মন্ত্রটি কমপক্ষে ১০৮ বার বলুন। আপনি চাইলে শিব চালিসা, মহামৃত্যুঞ্জয় মন্ত্র অথবা গায়ত্রী মন্ত্রও পড়তে পারেন। মন্ত্র জপে ইতিবাচক শক্তি আসে এবং মনে শান্তি আসে।
  • ভোগ অর্পণ করুন: ভগবান শিবকে খুশি করার জন্য তাঁকে খির, গুড়, অথবা দুধ দিয়ে তৈরি মিষ্টান্ন অর্পণ করুন। এর সাথে কলা, আপেল ইত্যাদি ফলও অর্পণ করুন। ভোগ অর্পণ করার পর কিছুটা জল অর্পণ করে পূজা সম্পন্ন করুন।
  • মা পার্বতীরও পূজা করুন: শিবজির পূজার সাথে সাথে মা পার্বতীর আরাধনা করাও জরুরি। তাঁকে চন্দন, ফুল, সিন্দুর এবং লাল চুড়ি অর্পণ করুন। এতে দাম্পত্য জীবনে সুখ-শান্তি বজায় থাকে এবং মায়ের কৃপাও লাভ হয়।
  • ধ্যান এবং প্রার্থনা করুন: পূজার শেষে কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে ভগবান শিবের ধ্যান করুন। আপনার মনের কথা প্রভুকে বলুন—যে কোনও মনোকামনা হোক না কেন, তা শ্রদ্ধা সহকারে প্রকাশ করুন। তারপর ভগবানের কাছে আশীর্বাদ চান এবং শান্তি ও সমৃদ্ধির প্রার্থনা করুন।

কি দান করবেন এই দিন?

সোমবতী অমাবস্যার দিন দান করা অত্যন্ত শুভ বলে মনে করা হয়। বিশেষ করে যারা পিতৃদোষ, অর্থের অভাব, অথবা জীবনে বারবার আসা সমস্যার সাথে লড়াই করছেন, তাদের এই দিনে বিশেষ করে দান অবশ্যই করা উচিত। এতে ভগবান শিব ও পিতৃদের কৃপা লাভ হয়।

  • সাদা জিনিসপত্র দান করুন: এই দিনে চাল, দই, মিশ্রি, সাদা তিল, খির এবং চিনি ইত্যাদি সাদা জিনিসপত্র অবশ্যই দান করুন। সাদা রঙ শান্তি ও পবিত্রতার প্রতীক। এটি ভগবান শিব ও চন্দ্রমার সাথে যুক্ত, যা মনে শান্তি দেয়। এই জিনিসপত্র দান করলে পিতৃদের কৃপা লাভ হয় এবং জীবনে ইতিবাচক শক্তি আসে।
  • সাদা বস্ত্র দান করা অত্যন্ত শুভ: আপনি যদি কোনও দরিদ্র ব্যক্তিকে সাদা কাপড় দান করেন, তাহলে তা অত্যন্ত পুণ্যকর বলে মনে করা হয়। মনে রাখবেন কাপড় নতুন এবং পরিষ্কার হবে, ছিড়ে যাওয়া পুরানো কাপড় কখনোই দান করবেন না। এই দান ব্রাহ্মণ, বিধবা অথবা কোনও দরিদ্র মহিলাকে করুন। এতে আপনার পূর্বপুরুষরা প্রসন্ন হন এবং ঘরে সুখ-শান্তি বজায় থাকে।
  • তামার পাত্র এবং ঘি দান করুন: এই দিনে তামার লোটা, কটোরি অথবা থালাও দান করা যেতে পারে। এর সাথে যদি আপনি দেশী গরুর ঘি দান করেন তাহলে তা আরও শুভ বলে মনে করা হয়। ঘি দ্বারা যজ্ঞ এবং পূজায় পবিত্রতা আসে। সাথে পঞ্চমেবা—যেমন বাদাম, কিশমিশ, কাজু, খুরমা এবং নারকেল—ও দান করতে পারেন।
  • অন্ন এবং দক্ষিণা দান করুন: দরিদ্রদের আটা, চাল, গম, ডাল ইত্যাদি প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র দান করা অত্যন্ত পুণ্যকর। যদি সম্ভব হয়, তাহলে নিজে রান্না করে তাদের ভোজনও করাতে পারেন। এর সাথে কিছু টাকা অর্থাৎ দক্ষিণাও দিন। এতে আপনার দান পূর্ণ বলে মনে করা হয় এবং দানের ফল অনেক গুণ বেড়ে যায়।
  • ফল এবং মিষ্টান্নও দান করুন: এই দিনে আপনি কলা, আপেল, খেজুর ইত্যাদি ফল এবং গুড় অথবা মিষ্টান্নও দান করতে পারেন। এতে শুধু সামনে ওয়ালাই খুশি হয় না, বরং এটি ভগবানকেও প্রিয় হয়। মিষ্টান্ন দান করলে জীবনে মধুরতা আসে এবং পরিবারে প্রেম বজায় থাকে।

করুন এই মন্ত্র জপ

সোমবতী অমাবস্যায় মন্ত্র জপ দ্বারা সাধনা সিদ্ধ হয় এবং মনোবাসিত ফলের প্রাপ্তি হয়। এই দিনে নিম্নলিখিত মন্ত্রগুলির জপ অবশ্যই করুন:

  • ॐ কুল দেবতাভ্যো নমঃ
  • ॐ গ্রাম দেবতাভ্যো নমঃ
  • ॐ গ্রহ দেবতাভ্যো নমঃ
  • ॐ লক্ষ্মীপতি দেবতাভ্যো নমঃ
  • ॐ বিঘ্নবিধ্বংসক দেবতাভ্যো নমঃ
  • ॐ নমো ভগবতে বাসুদেবায়

এছাড়াও এই শ্লোকটিও পড়ুন

অযোধ্যায়, মথুরায়, মাযায়, কাশী, কাঞ্চী, অবন্তীকা
পুরী দ্বারাবতী জ্ঞেয়া: সপ্তৈতা মোক্ষ দায়িকা।

গঙ্গে চ যমুনে চৈব গোদাবরী সরস্বতী,
নর্মদা সিন্ধু কাভেরী জলেস্মিন সন্নিধিং কুরু।

গায়ত্রী মন্ত্র:

ॐ ভূর্বুঃ স্বঃ তৎসবিতুর্বরেণ্যং
ভর্গো দেবস্য ধীমহি
ধিয়ো যো নঃ প্রচোদয়াত্।

পিতৃ শান্তি মন্ত্র:
ॐ পিতৃভ্যো নমঃ

সোমবতী অমাবস্যার দিন শুধুমাত্র একটি তিথি নয়, বরং একটি সুযোগ—শিব ভক্তি, পিতৃ শান্তি এবং পুণ্য সংগ্রহের। এই দিনে নিয়মিত স্নান, পূজা, দান এবং মন্ত্র জপ করে ব্যক্তি তার জীবনের বাধাগুলি দূর করতে পারে এবং আধ্যাত্মিক উন্নতির দিকে অগ্রসর হতে পারে।

Leave a comment