আজকের যুগে জীবনযাত্রার রোগ, চাপ ও খাদ্যাভ্যাসের ভুলের ফলে মানুষের স্বাস্থ্যের উপর প্রভাব পড়ছে। এমন পরিস্থিতিতে আয়ুর্বেদ একটি প্রাচীন চিকিৎসা পদ্ধতি হিসেবে উঠে এসেছে যা শুধুমাত্র শারীরিক স্বাস্থ্যই নয়, মানসিক শান্তিও প্রদান করে। আয়ুর্বেদিক চিকিৎসার একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হল এটি সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক এবং এর কোনও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই।
আয়ুর্বেদের ভিত্তি: তিনটি দোষ – বাত, পিত্ত ও কফ
ডাঃ চঞ্চল শর্মা, আশা আয়ুর্বেদের পরিচালক ও স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ, জানান আয়ুর্বেদের মূল ভিত্তি তিনটি বিষয়ের উপর নির্ভর করে – বাত, পিত্ত ও কফ। এগুলিকে "ত্রিদোষ" বলা হয়। এগুলো আমাদের দেহের তিনটি ভিন্ন ধরণের শক্তি। এই তিনটি যদি ভারসাম্যে থাকে তাহলে মানুষ সম্পূর্ণ সুস্থ থাকে – শারীরিক ও মানসিক উভয় দিক থেকেই।
বাত দোষ – এটি দেহে বায়ুর সাথে সম্পর্কিত। এটি আমাদের চলাফেরা, এবং দেহের ভিতরে বিভিন্ন কাজকর্ম (যেমনঃ শ্বাস-প্রশ্বাস, রক্ত চলাচল) নিয়ন্ত্রণ করে।
পিত্ত দোষ – এই দোষ অগ্নি সাথে সম্পর্কিত। এটি আমাদের দেহের পরিপাক শক্তি এবং খাবার থেকে শক্তি উৎপাদনের প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করে।
কফ দোষ – এই দোষ জল ও মাটির সাথে সম্পর্কিত। এটি দেহকে শক্তি, স্থিরতা ও আর্দ্রতা প্রদান করে। যেমনঃ যৌথে স্নেহন প্রদান করা, দেহকে ঠান্ডা রাখা ইত্যাদি।
সুস্থ ও সবল থাকার জন্য গ্রহণ করুন এই সহজ আয়ুর্বেদিক উপায়
আজকের দ্রুতগতিসম্পন্ন জীবনে আমরা সবাই চাই আমাদের দেহ সুস্থ থাকুক, মন শান্ত থাকুক এবং আমাদের কোনও রোগ না হোক। এর জন্য অনেকেই জিম যান, ডায়েট করেন অথবা ওষুধের আশ্রয় নেন। কিন্তু আপনি যদি কিছু প্রাকৃতিক, পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া মুক্ত এবং স্থায়ী উপায় চান, তাহলে আয়ুর্বেদের দিকে ধাবমান হওয়া একটি বুদ্ধিমানের কাজ হতে পারে।
আপনাদেরকে এমন ৭টি সহজ আয়ুর্বেদিক উপায় বলা হচ্ছে, যা গ্রহণ করে আপনি আপনার জীবনকে সুস্থ, সুখী ও শক্তিশালী করে তুলতে পারেন।
১. ধ্যান (Meditation): মন ও দেহের ভারসাম্য
ধ্যান বা মেডিটেশন, আপনার মনকে শান্ত করার সর্বোত্তম উপায়। প্রতিদিন কয়েক মিনিট ধ্যান করা শুধুমাত্র মস্তিষ্ককে পরিষ্কার করে না, বরং চাপও কমায়। এর ফলে আপনার চিন্তাশক্তি বৃদ্ধি পায় এবং আপনি আবেগগুলিকে আরও ভালোভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন।
২. উপযুক্ত খাদ্য: দেহ অনুযায়ী খাবার নির্বাচন করুন
প্রত্যেক ব্যক্তির দেহ ভিন্ন, এবং আয়ুর্বেদ এই ভিত্তিতেই খাবার নির্বাচনের পরামর্শ দেয়। মনে করা হয় প্রত্যেক মানুষের মধ্যে তিনটি দোষ – বাত, পিত্ত ও কফ – এর ভিন্ন ভারসাম্য রয়েছে। সে অনুযায়ী খাবার-দাবারের জিনিসপত্র নির্ধারণ করা হয়।
৩. পঞ্চকর্ম: দেহ পরিষ্কার ও ডিটক্স প্রক্রিয়া
পঞ্চকর্ম আয়ুর্বেদের একটি বিশেষ পদ্ধতি, যার মাধ্যমে দেহের ভিতরে জমা বিষাক্ত পদার্থ প্রাকৃতিকভাবে বের করে দেওয়া হয়। এটি এক ধরণের ডিটক্স যা শুধুমাত্র দেহ পরিষ্কার করে না, বরং আপনার শক্তি এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও বাড়ায়।
৪. দৈনিক রুটিন: সঠিক রুটিন গ্রহণ করুন
আয়ুর্বেদে সময়ের অনেক গুরুত্ব আছে। কখন দিন শুরু করতে হবে, কখন খাবার খেতে হবে, কখন ঘুমাতে হবে – এগুলো সব নির্দিষ্ট সময়ে হওয়া উচিত। যদি আপনি নিয়মিত রুটিন গ্রহণ করেন তাহলে শুধুমাত্র পরিপাক ভালো থাকে না, বরং মন ও দেহ উভয়ের ভারসাম্য বজায় থাকে।
৫. চাপ ব্যবস্থাপনা: যোগ ও প্রাকৃতিক উপায়ের মাধ্যমে চাপ দূর করুন
আজকাল চাপ প্রত্যেকের জীবনের অংশ হয়ে উঠেছে। কিন্তু যদি এটি সময়মতো নিয়ন্ত্রণ না করা হয় তাহলে এটি অনেক রোগের কারণ হতে পারে। যোগ, প্রাণায়াম, মেডিটেশন ও আয়ুর্বেদিক ম্যাসাজের মতো উপায় চাপ কমাতে অত্যন্ত কার্যকর।
৬. পর্যাপ্ত ঘুম: দেহকে বিশ্রাম দেওয়া জরুরী
ঘুম শুধুমাত্র ক্লান্তি দূর করার মাধ্যম নয়, বরং দেহের মেরামত ও পুনরায় শক্তি লাভের সর্বোত্তম উপায়। যদি আপনার ঘুম পুরোপুরি না হয়, তাহলে তার প্রভাব আপনার মুড, দেহ ও মস্তিষ্ক – তিনটিতেই পড়ে।
৭. ভেষজ চিকিৎসা: আয়ুর্বেদিক ঔষধিগুলির কার্যকারিতা
আয়ুর্বেদে অনেক এমন ঔষধি রয়েছে যা শুধুমাত্র দেহকে সুস্থ রাখে না, বরং রোগ থেকে রক্ষা করতেও সাহায্য করে।
তুলসী – সর্দি-কাশি ও জ্বরে উপকারী, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে।
অশ্বগন্ধা – চাপ কমায় এবং দেহকে শক্তিশালী করে।
হলুদ – দেহের প্রদাহ কমায় এবং আঘাত বা সংক্রমণে কাজে লাগে।
আমলা – ভিটামিন সি-র প্রাকৃতিক উৎস, পরিপাক ও ত্বকের জন্য উপকারী।
নিম – রক্ত পরিষ্কার করে এবং ত্বকের সমস্যায় সাহায্য করে।
শতাবারী ও গুডুচি – মহিলাদের স্বাস্থ্য ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা মজবুত করার জন্য উপকারী।
আয়ুর্বেদ শুধুমাত্র একটি চিকিৎসা পদ্ধতি নয়, বরং একটি সম্পূর্ণ জীবনধারা। এর অনুসরণ করে আপনি শুধুমাত্র রোগ থেকে দূরে থাকতে পারবেন না, বরং একটি উর্জ্জাশালী ও সুখী জীবনও যাপন করতে পারবেন। আপনি যদি সুস্থ ও সবল থাকতে চান, তাহলে আজই থেকে আপনার দৈনন্দিন জীবনে এই আয়ুর্বেদিক উপায়গুলি অন্তর্ভুক্ত করুন।
