ঘরোয়া প্রতিকারে দাঁতের কীড়া ও ব্যথা থেকে মুক্তি

🎧 Listen in Audio
0:00

এই ঘরোয়া প্রতিকারগুলি শুধুমাত্র দাঁতের ব্যথা ও প্রদাহ দূর করে না, বরং দাঁতকে সুস্থ রাখতেও সাহায্য করে। এই প্রবন্ধে, আমরা জানবো কিভাবে এই উপায়গুলি দাঁতের পরিষ্কারতা ও শক্তি বৃদ্ধিতে সহায়ক হতে পারে।

দাঁতে কীড়া লাগা বা ক্যালভিটি হওয়া একটি সাধারণ কিন্তু বিরক্তিকর সমস্যা। যখন আমরা মিষ্টি খাবার, সফট ড্রিঙ্কস বা অতিরিক্ত জাঙ্ক ফুড খাই এবং সঠিকভাবে ব্রাশ করি না, তখন মুখে ব্যাকটেরিয়া জমা হতে থাকে। এই ব্যাকটেরিয়াগুলি ধীরে ধীরে দাঁতের উপরের স্তর বা ইনামেলকে ক্ষতিগ্রস্ত করে এবং তাতে ছিদ্র তৈরি করে। এই ছিদ্রকেই সাধারণ ভাষায় ‘দাঁতে কীড়া লাগা’ বলে।

এই সমস্যাটি শিশু থেকে বয়স্ক যে কারও হতে পারে। যদি সময়মতো এর চিকিৎসা না করা হয়, তাহলে দাঁত সম্পূর্ণরূপে পচে যেতে পারে এবং তখন তা উঠিয়ে ফেলতে হতে পারে। কিন্তু স্বস্তির বিষয় হলো, কিছু ঘরোয়া উপায় অবলম্বন করে এই সমস্যাকে প্রাথমিক পর্যায়েই রোধ করা যায় এবং দাঁতকে শক্তিশালী রাখা যায়।

দাঁতে কীড়া লাগার প্রধান কারণ

দাঁতে কীড়া লাগা বা ক্যালভিটি হওয়া একটি ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাওয়া সমস্যা, যা আমাদের দৈনন্দিন কিছু অভ্যাসের কারণে হয়। যদি সময়মতো যত্ন না নেওয়া হয়, তাহলে এটি দাঁত পচিয়ে ফেলে এবং প্রচণ্ড ব্যথাও হয়।

  • অতিরিক্ত মিষ্টি খাওয়া: যদি আপনি সারাদিন চকলেট, টফি, মিষ্টান্ন, কেক, বিস্কুট, কোল্ড ড্রিঙ্কস বা মিষ্টি জিনিসপত্র খেতে থাকেন, তাহলে আপনার দাঁতে মিষ্টির আস্তরণ জমে যায়। তার উপর ব্যাকটেরিয়া জমা হয়। এই ব্যাকটেরিয়াগুলি ধীরে ধীরে অ্যাসিড তৈরি করে, যা দাঁতের উপরের স্তর (ইনামেল) কে ক্ষতিগ্রস্ত করে। এখান থেকেই দাঁতে কীড়া লাগার শুরু হয়।
  • ভুলভাবে ব্রাশ করা বা ব্রাশ না করা: অনেকেই অতি দ্রুত ব্রাশ করে নেন অথবা সঠিকভাবে করেন না। অনেকে রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে ব্রাশ করা বাদ দেন, যার ফলে দাঁতে সারাদিনের ময়লা থেকে যায়। এর ফলে দাঁতে পচন শুরু হয় এবং ধীরে ধীরে কীড়া লাগে।
  • মুখের পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা (ওরাল হাইজিন) এর অভাব: শুধু ব্রাশ করা যথেষ্ট নয়। অনেক সময় দাঁতের মাঝখানের ময়লা ব্রাশ দিয়ে বের হয় না। যদি আপনি মাউথওয়াশ বা ডেন্টাল ফ্লস ব্যবহার না করেন, তাহলে এই লুকানো ময়লা পরে ব্যাকটেরিয়ার আবাসস্থল হয়ে ওঠে এবং কীড়া লাগতে শুরু করে। তাই দাঁতের পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা শুধু উপর থেকে নয়, ভেতর থেকেও প্রয়োজন।
  • অ্যাসিডিক ও ঠান্ডা পানীয়ের অধিক সেবন: কোল্ড ড্রিঙ্কস, সোডা, প্যাকেটজাত রস এবং অতিরিক্ত লেবুযুক্ত পানি – এই সকল জিনিস অত্যন্ত অ্যাসিডিক। এগুলি দাঁতের স্তরকে দুর্বল করে দেয়। যখন স্তর দুর্বল হয়, তখন ব্যাকটেরিয়ার দাঁতের ভেতরে প্রবেশের পথ পায়। এর ফলে কীড়া লাগা আরও তীব্র হয়।

দাঁতের কীড়া ও ব্যথার জন্য কার্যকর ঘরোয়া প্রতিকার

দাঁতে কীড়া লাগা বা ক্যালভিটি হওয়া অত্যন্ত কষ্টদায়ক। এতে দাঁতে তীব্র ব্যথা, প্রদাহ এবং খাওয়া-দাওয়ায় অসুবিধা হয়। যদিও প্রাথমিক পর্যায়ে কিছু ঘরোয়া উপায় অবলম্বন করে এই সমস্যাটি অনেকটাই কমানো যায়।

  • রসুন ও লবঙ্গের পেস্ট: রসুন ও লবঙ্গ উভয়ই তাদের অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল গুণাবলীর জন্য পরিচিত। একটি রসুন কলি এবং দুটি লবঙ্গ নিন এবং ভালো করে পিষে পেস্ট তৈরি করুন। এবার এই পেস্টটি সেই দাঁতে লাগান যেখানে কীড়া লেগেছে বা ব্যথা হচ্ছে। এই প্রতিকার ব্যাকটেরিয়া ধ্বংস করতে সাহায্য করে এবং ব্যথা উপশম করে। দিনে একবার ব্যবহার করলে কার্যকর হতে পারে।
  • হলুদ ও নারকেল তেল: হলুদ একটি প্রাকৃতিক অ্যান্টিসেপটিক এবং নারকেল তেল মুখের ব্যাকটেরিয়া ধ্বংস করতে সাহায্য করে। আধা চা-চামচ হলুদ গুঁড়ো নিন এবং তাতে কিছুটা নারকেল তেল মিশিয়ে পেস্ট তৈরি করুন। এই পেস্টটি আঙুল বা তুলা দিয়ে দাঁতে লাগান। এতে প্রদাহ কমবে, ব্যথা উপশম হবে এবং দাঁতের সুরক্ষা বৃদ্ধি পাবে।
  • লবণ ও সরিষার তেল: এই প্রতিকার প্রাচীনকাল থেকে চলে আসছে এবং এখনও ততটাই কার্যকর। এক চিমটি লবণে ২-৩ ফোঁটা সরিষার তেল মিশিয়ে মজ্জায় ধীরে ধীরে মালিশ করুন। এটি মজ্জাকে শক্তিশালী করে, দাঁত পরিষ্কার করে এবং কীড়া বৃদ্ধি রোধ করে। এটি প্রতিদিন একবার সকালে অথবা রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে করুন।
  • নিম পাতার কুল্লা: নিমে প্রাকৃতিক অ্যান্টিসেপটিক ও অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল গুণ রয়েছে। কিছু তাজা নিম পাতা নিন এবং পানিতে ফুটিয়ে নিন। যখন পানি কিছুটা গরম হয়ে যায়, তখন তা দিয়ে কুল্লা করুন। এই উপায় দাঁতে কীড়া এবং মুখের দুর্গন্ধ দূর করতে বেশ সাহায্য করে।
  • জবা ফুলের পেস্ট: জবা ফুল দাঁতের ব্যথার জন্য ঐতিহ্যবাহী প্রতিকার হিসেবে বিবেচিত। এক-দুটি জবা ফুল নিন এবং পিষে পেস্ট তৈরি করুন। এই পেস্টটি সেই দাঁতে লাগান যেখানে ব্যথা বা পচন হচ্ছে। এতে ব্যথা উপশম হয় এবং দাঁত শক্তিশালী করতে সাহায্য করে।

দাঁতের সঠিক যত্ন কেন প্রয়োজন?

দাঁত আমাদের শরীরের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশ। যদি এর যত্ন সঠিকভাবে না করা হয়, তাহলে দাঁতে কীড়া লাগা, ব্যথা, প্রদাহ এবং শ্বাসের দুর্গন্ধের মতো সমস্যা হতে পারে। দাঁতকে সুস্থ রাখার জন্য প্রতিদিন ব্রাশ করা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। সকালে ঘুম থেকে উঠে এবং রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে দুইবার ব্রাশ করা উচিত। এর সাথে সাথে ফ্লস ব্যবহার করাও প্রয়োজন, যাতে দাঁতের মাঝখানে আটকে থাকা ময়লা বের করা যায়। যদি আপনি মিষ্টি বা স্টিকি কিছু খান, তাহলে তার পর কুল্লা করা অত্যন্ত জরুরী, কারণ চিনি দাঁত পচার সবচেয়ে বড় কারণ।

ছোটো পরিবর্তন, বড় সুরক্ষা

মাউথওয়াশের নিয়মিত ব্যবহার মুখের ব্যাকটেরিয়া ধ্বংস করতে সাহায্য করে, যার ফলে দাঁত ও মজ্জা উভয়ই সুরক্ষিত থাকে। এছাড়া বছরে অন্তত দুইবার ডেন্টিস্টের কাছে চেকআপ করানো প্রয়োজন, যাতে যদি কোনো ছোটো সমস্যা হয়, তাহলে তা সময়মতো ঠিক করা যায়। সারাদিন পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পান করাও অত্যন্ত উপকারী, কারণ পানি মুখকে হাইড্রেট রাখে এবং খাওয়ার পর মুখে জমে থাকা ব্যাকটেরিয়া বের করে দেয়। দাঁতের ভালো যত্ন নেওয়া কঠিন নয়, শুধু थोड़া सावधानी এবং নিয়মিততা দিয়ে আপনি জীবনভর আপনার দাঁতকে সুস্থ রাখতে পারেন।

দাঁতকে সুস্থ রাখার সহজ টিপস

যদি আপনি চান আপনার দাঁত দীর্ঘদিন শক্তিশালী ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকুক, তাহলে কিছু সহজ অভ্যাস গ্রহণ করা অত্যন্ত জরুরী। প্রথমত, দিনে দুইবার ব্রাশ করা ভুলবেন না – সকালে ও রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে। ব্রাশ করার সাথে সাথে প্রতিদিন ডেন্টাল ফ্লস ব্যবহার করুন, যাতে দাঁতের মাঝখানে আটকে থাকা কণা বেরিয়ে যায়।

যখনই আপনি মিষ্টি খান যেমন চকলেট বা মিষ্টান্ন, তার পর কুল্লা অবশ্যই করুন যাতে ব্যাকটেরিয়া জন্মাতে না পারে। সপ্তাহে একবার মাউথওয়াশ দিয়ে কুল্লা করা আপনার মুখে তাজাভাব আনার সাথে সাথে জীবাণুও ধ্বংস করে। বছরে অন্তত দুইবার ডেন্টিস্টের কাছে গিয়ে পরীক্ষা করান, যাতে কোনো বড় সমস্যা শুরু হওয়ার আগেই ধরা পড়ে। সাথে সাথে, ধূমপান এবং অতিরিক্ত চা বা কফি পান করা থেকে বিরত থাকুন কারণ এগুলি দাঁতকে হলুদ ও দুর্বল করে তুলতে পারে। প্রতিদিনের এই ছোটো ছোটো অভ্যাসগুলি আপনার দাঁতকে দীর্ঘদিন সুস্থ রাখবে।

ডাক্তারের কাছে কখন যেতে হবে?

যদি আপনার দাঁতে ক্রমাগত ব্যথা থাকে, প্রদাহ কমে না অথবা দাঁত থেকে পুঁজ বের হয়, তাহলে ঘরোয়া প্রতিকারে আরাম পাওয়া যাবে না। এমন পরিস্থিতিতে দেরি করা ক্ষতিকারক হতে পারে। আপনাকে অবিলম্বে কোনো দন্ত চিকিৎসক (ডেন্টিস্ট) এর সাথে দেখা করা উচিত। ডাক্তার আপনার দাঁতের ভালো করে পরীক্ষা করবেন এবং প্রয়োজন অনুযায়ী দাঁতের পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা, ভরাট (ফিলিং) অথবা রুট ক্যানেলের মতো চিকিৎসা করতে পারেন। সময়মতো চিকিৎসা করালে দাঁত রক্ষা করা যায় এবং ভবিষ্যতের সমস্যাও এড়ানো যায়।

দাঁতে কীড়া লাগা শোনার সাথে সাথে সাধারণ মনে হলেও, যদি এটিকে উপেক্ষা করা হয় তাহলে এটি বড় সমস্যা হতে পারে। ঘরোয়া প্রতিকার প্রাথমিক পর্যায়ে বেশ কার্যকর, তবে সঠিক ওরাল হাইজিন বজায় রাখা সবচেয়ে জরুরি। সময়মতো ব্রাশ, ফ্লস এবং ডেন্টাল চেকআপের অভ্যাসই আপনার দাঁতকে দীর্ঘদিন সুস্থ রাখতে পারে।

Leave a comment