জয়পাল সিংহ মুন্ডার জন্মদিন ৩ জানুয়ারি। তিনি ১৯০৩ সালের ৩ জানুয়ারি রাঁচি জেলার পাহান টোলি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। এই দিনে তাঁর অবদান স্মরণ করা হয়, বিশেষ করে আদিবাসী সম্প্রদায়ের জন্য তাঁর সংগ্রাম এবং ভারতীয় ক্রীড়া জগতে তাঁর অবদানকে সম্মান জানানোর জন্য বিভিন্ন অনুষ্ঠান ও সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়।
এই দিনটি বিশেষ করে ঝাড়খণ্ড এবং ভারতের অন্যান্য অংশে তাঁর ঐতিহ্য এবং আদিবাসী সমাজের জন্য তাঁর কাজ স্মরণ করে পালিত হয়।
প্রাথমিক জীবন এবং শিক্ষা
১৯০৩ সালের ৩ জানুয়ারি রাঁচি জেলার পাহান টোলি গ্রামে জন্মগ্রহণকারী জয়পাল সিংহ মুন্ডা ভারতীয় রাজনীতি, ক্রীড়া এবং সামাজিক কাজে একজন অনুপ্রেরণা হয়ে উঠেছিলেন। মুন্ডার পরিবার মুন্ডা আদিবাসী সম্প্রদায়ের ছিল, এবং তাঁর জীবন সংগ্রাম ও সমর্পণের গল্পে ভরা ছিল। তিনি তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা রাঁচির সেন্ট পল স্কুল থেকে লাভ করেন এবং পরে ইংল্যান্ডের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে অনার্স অর্জন করেন।
ক্রীড়ায় অবদান এবং অলিম্পিক যাত্রা
ক্রীড়ায় তাঁর বিশেষ আগ্রহ এবং কঠোর পরিশ্রম জয়পাল সিংহ মুন্ডাকে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান এনে দিয়েছিল। ১৯২৮ সালে, তিনি ভারতীয় হকি দলের অধিনায়ক হন এবং সেই দলটি আমস্টারডামে অনুষ্ঠিত গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিকে স্বর্ণপদক জয় করে। তবে, দলের ইংলিশ কোচের সাথে বিবাদের কারণে মুন্ডা লিগ পর্বের পর দল থেকে বাদ পড়ে যান, কিন্তু তাঁর অধিনায়কত্বে দলের সাফল্য ভারতীয় ক্রীড়া ইতিহাসে স্বর্ণময় অধ্যায় হিসেবে লিপিবদ্ধ হয়ে রয়েছে।
রাজনৈতিক যাত্রার সূচনা
ভারতে ফিরে আসার পর, মুন্ডা ক্রীড়া থেকে অবসর গ্রহণ করে শিক্ষা এবং রাজনীতির ক্ষেত্রে পদক্ষেপ নেন। তিনি বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন এবং ১৯৩৯ সালে আদিবাসী মহাসভার সভাপতি হন। এরপর তিনি ঝাড়খণ্ড রাজ্য গঠনের প্রয়োজনীয়তার জন্য আন্দোলন শুরু করেন, যার জন্য তিনি সুভাষ চন্দ্র বসুর সাথে যোগাযোগ করেন।
সংবিধান সভায় ভূমিকা
জয়পাল সিংহ মুন্ডা ভারতীয় সংবিধান সভার সদস্য হিসেবেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। আদিবাসীদের অধিকারের জন্য তাঁর সংগ্রাম ভারতীয় সংবিধান প্রণয়নে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তিনি সংবিধান সভায় আদিবাসী সম্প্রদায়ের জন্য বিশেষ বিধানের দাবি জানান। তাঁর ভাষণ, যেখানে তিনি আদিবাসীদের প্রতি চরম অন্যায় ও শোষণের উল্লেখ করেছিলেন, আজও স্মরণ করা হয়। তাঁর এই বক্তব্য, "আমি বিশ্বাস করি আমরা এখন একটি নতুন অধ্যায় শুরু করতে যাচ্ছি, যেখানে সুযোগের সমতা থাকবে," আদিবাসী সম্প্রদায়ের জন্য তাঁর সংগ্রামের প্রতীক।
ঝাড়খণ্ড রাজ্যের পক্ষে আন্দোলন
মুন্ডা ঝাড়খণ্ড রাজ্য গঠনের জন্যও সংগ্রাম করেছিলেন। ১৯৫২ সালে তিনি রাঁচি আসন থেকে জয়ী হন এবং পরে ঝাড়খণ্ড পার্টির নেতৃত্ব দেন। তিনি রাজ্য পুনর্গঠন কমিশনে একটি স্মারকলিপি জমা দিয়েছিলেন, যেখানে দক্ষিণ বিহারের আদিবাসী অঞ্চলগুলিকে নতুন রাজ্য গঠনের জন্য সমর্থন দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু এই প্রস্তাবটি নাকচ করে দেওয়া হয়। এরপর মুন্ডা ১৯৬৩ সালে তাঁর দলের ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসে বিলয় ঘটান এবং কংগ্রেস প্রার্থী হিসেবে ১৯৬৭ সালে খুঁটি লোকসভা আসন থেকে নির্বাচনে জয়ী হয়ে রাজনীতিতে তাঁর প্রভাব বজায় রাখেন।
ব্যক্তিগত জীবন এবং পরিবার
মুন্ডার ব্যক্তিগত জীবনও তাঁর সার্বজনীন জীবনের মতোই আকর্ষণীয় ছিল। ১৯৩১ সালে, তিনি তারা উইনফ্রিড মজুমদারের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন এবং তাদের তিনটি সন্তান হয়। পরে তিনি শ্রীমতী জহানারা জয়রত্নমের সাথে বিবাহ করেন। তাঁর পরিবার আজও তাঁর উত্তরাধিকারকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।
মৃত্যু এবং উত্তরাধিকার
২০ মার্চ ১৯৭০ সালে মস্তিষ্ক রক্তপাতের কারণে জয়পাল সিংহ মুন্ডার মৃত্যু হয়। তিনি ৬৭ বছর বয়সী ছিলেন, কিন্তু তাঁর অবদান ভারতীয় রাজনীতি এবং আদিবাসী সমাজের জন্য সর্বদা জীবন্ত থাকবে। তাঁর অবদানের জন্য তাঁকে "মারাং গোমকে" (মহান নেতা) হিসেবে সম্মানিত করা হয়েছিল। তাঁর স্মরণে রাঁচিতে একটি স্টেডিয়াম খোলা হয়েছে এবং ঝাড়খণ্ড রাজ্য সরকার তাঁর নামে "মারাং গোমকে জয়পাল সিংহ মুন্ডা ওভারসিজ স্কলারশিপ" চালু করেছে, যার মাধ্যমে রাজ্যের যুবকরা বিদেশে উচ্চশিক্ষা লাভ করছে।
সংবিধান সভায় আদিবাসীদের অধিকারের লড়াই
জয়পাল সিংহ মুন্ডা সংবিধান সভায় আদিবাসীদের অধিকার নিশ্চিত করার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। তিনি সর্বদা তাঁর সম্প্রদায়ের উন্নয়নের জন্য কণ্ঠ উত্থাপন করেছেন এবং তাঁদের অধিকার রক্ষার জন্য সংগ্রাম করেছেন। তাঁর ভাষণে আদিবাসীদের শোষণ এবং বৈষম্যের বিরুদ্ধে একটি স্পষ্ট বার্তা ছিল, যা আজও ভারতীয় রাজনীতিতে প্রতিধ্বনিত হয়।
তাঁর উত্তরাধিকার
জয়পাল সিংহ মুন্ডার জীবন একটি অনুপ্রেরণা, যা আমাদের শেখায় যে সংগ্রাম এবং সমর্পণের মাধ্যমেই আমরা আমাদের অধিকার এবং সমাজের জন্য পরিবর্তন আনতে পারি। তাঁর সংগ্রাম এবং বিজয়গুলি কেবলমাত্র আদিবাসী সম্প্রদায়কে শক্তি প্রদান করে নি, বরং ভারতীয় রাজনীতি এবং ক্রীড়া জগতকেও অনুপ্রাণিত করেছে। তাঁর জীবন প্রমাণ করে যে একজন ব্যক্তির সংগ্রাম সমাজে বড় পরিবর্তনের কারণ হতে পারে। জয়পাল সিংহ মুন্ডার অবদান এবং তাঁর উত্তরাধিকার ভারতীয় ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে থাকবে, এবং তাঁর নাম সর্বদা সম্মানের সাথে উচ্চারিত হবে।