প্রতি বছর ২৬ জুন ‘আন্তর্জাতিক মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ দিবস’ পালিত হয়। এই দিবসের উদ্দেশ্য হল সমাজে মাদকাসক্তি এবং তার ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করা। এই দিবস মাদকমুক্ত সমাজ গঠনের দিকে মানুষকে অনুপ্রাণিত করে এবং সরকার, সংগঠন এবং সাধারণ নাগরিকদের এই সামাজিক ব্যাধির বিরুদ্ধে একযোগে কাজ করার বার্তা দেয়।
আন্তর্জাতিক মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ দিবসের সূচনা কীভাবে হল?
বিশ্বব্যাপী মাদকাসক্তি একটি গুরুতর সমস্যা হয়ে উঠেছে। এর সাথে জড়িত অপরাধ, স্বাস্থ্য সমস্যা, বেকারত্ব এবং পারিবারিক বিচ্ছেদ সারা বিশ্বকে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। এই বর্ধমান সমস্যাগুলি দেখে, ১৯৮৭ সালে জাতিসংঘ মহাসভা সিদ্ধান্ত নেয় যে, প্রতি বছর ২৬ জুন ‘আন্তর্জাতিক মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার ও অবৈধ ব্যবসার বিরুদ্ধে দিবস’ (International Day against Drug Abuse and Illicit Trafficking) হিসাবে পালন করা হবে।
এই দিবস পালনের প্রধান উদ্দেশ্য হল—মাদকদ্রব্যের অবৈধ ব্যবসা বন্ধ করা এবং মানুষকে মাদকাসক্তির ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে সচেতন করা, যাতে সমাজকে এই ব্যাধি থেকে মুক্ত করা যায়।
২০২৫ সালের থিম কি?
প্রতি বছর এই দিবসের একটি নির্দিষ্ট থিম থাকে যা সমাজকে একটি বিশেষ বার্তা দেয়। ২০২৫ সালের থিম হল: "মাদকমুক্ত যুব, সবল জাতি"।
এই বিষয়বস্তুটির মাধ্যমে বোঝানো হচ্ছে যে যদি যুব প্রজন্ম মাদক থেকে দূরে থাকে তাহলে তারা কেবলমাত্র তাদের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল করে তুলতে পারবে না, বরং দেশের উন্নয়নেও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারবে।
মাদকের প্রকারভেদ এবং তার ক্ষতিকর প্রভাব
- মাদক শুধুমাত্র মদ বা সিগারেট পর্যন্ত সীমাবদ্ধ নয়। বর্তমানে বিভিন্ন ধরণের মাদক প্রচলিত, যেমন:
- তামাক, গুটখা, বিড়ি, সিগারেট
- মদ
- গাঁজা, চরস, আফিম
- হিরোইন, কোকেইন, এলএসডি-র মতো মারাত্মক ড্রাগস
- মেডিকেল ড্রাগস (পেইনকিলার, কাশির সিরাপ ইত্যাদির ভুল ব্যবহার)
এই মাদকগুলির ক্ষতিকর প্রভাব
- মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যের ক্ষতি
- আত্মহত্যার প্রবণতা
- হিংস্র ও অপরাধমূলক প্রবণতা
- পরিবার ও সমাজ থেকে দূরত্ব
- শিক্ষা ও কর্মজীবনে ব্যর্থতা
অকাল মৃত্যু
- কেন মানুষ মাদকের আসক্ত হয়?
- মাদকাসক্তির সূচনা সাধারণত মজা, ফ্যাশন বা বন্ধুদের চাপে পড়ে হয়। কিছু সাধারণ কারণ হল:
- মানসিক চাপ, একাকীত্ব বা পারিবারিক সমস্যা
- বেকারত্ব বা কর্মজীবনে ব্যর্থতা
- চলচ্চিত্র বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্রভাব
মাদকাসক্ত বন্ধুদের সঙ্গ
- অভিভাবকদের অবহেলা বা যোগাযোগের অভাব
- ধীরে ধীরে এটি অভ্যাসে পরিণত হয় এবং মানুষ মাদকের দাস হয়ে পড়ে।
- মাদক ও যুব প্রজন্ম
- আজকের যুব সমাজ এই ব্যাধির আক্রান্ত হচ্ছে সবচেয়ে বেশি। কলেজ, স্কুল বা কোচিং সেন্টারে অনেক সময় ছাত্র-ছাত্রীরা মাদকে আকৃষ্ট হয়।
- এটি কেবল তাদের পড়াশোনার উপর প্রভাব ফেলে না, বরং তাদের ভবিষ্যৎও নষ্ট করে দেয়।
- মাদকমুক্তির জন্য সরকার ও সংস্থাগুলির ভূমিকা
- সরকার ও বিভিন্ন সামাজিক সংস্থা এই সমস্যার সমাধানের জন্য ক্রমাগত প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে:
- মাদকমুক্তি কেন্দ্র স্থাপন
- শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সচেতনতা কর্মসূচী
- ‘মাদকমুক্ত ভারত অভিযান’ শুরু
- মিডিয়া ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার-প্রচার
মাদক সরবরাহ শৃঙ্খলে নিয়ন্ত্রণ
- এছাড়াও অনেক NGO এবং সচেতন নাগরিক সময় সময় র্যালি, কর্মশালা এবং পরামর্শ সেশন আয়োজন করে যাতে মানুষ মাদক থেকে দূরে থাকে।
- ভারতীয় সংস্কৃতি কী বলে?
- ভারতীয় সংস্কৃতিতে সংযম, সদাচার এবং স্বাস্থ্যকে জীবনের মূল ভিত্তি হিসেবে মেনে নেওয়া হয়।
- মহাভারত, রামায়ণ এবং অন্যান্য গ্রন্থেও মদ বা মাদকদ্রব্য থেকে দূরে থাকার অনুপ্রেরণা দেওয়া হয়েছে। আমাদের ঋষি-মুনিরা সর্বদা পরিষ্কার খাদ্য, পরিষ্কার জীবনযাপন এবং যোগের মাধ্যমে মানসিক ও শারীরিক ভারসাম্য বজায় রাখার কথা বলেছেন।
- যোগ ও ধ্যান: মাদকমুক্তির পথ
- আন্তর্জাতিক যোগ দিবসও জুন মাসেই (২১ জুন) পালিত হয়। যোগ ও ধ্যান শুধুমাত্র শরীরকে সুস্থ রাখে না, বরং মানসিক চাপও দূর করে।
যোগের সুবিধা
- মনে শান্তি পাওয়া যায়
- নেতিবাচক চিন্তা থেকে মুক্তি
- আত্ম-সংযমের শক্তি বৃদ্ধি পায়
- অবসাদ, উদ্বেগ ও চাপ কমে
আজকাল অনেক মাদকমুক্তি কেন্দ্রে নিয়মিত যোগ ও ধ্যানের ক্লাস চলে, যা থেকে রোগীরা অনেক উপকার পায়।
আমরা কী করতে পারি?
- মাদক রোধের দায়িত্ব শুধুমাত্র সরকারের নয়, প্রতিটি নাগরিকের। আমাদের সকলকে একত্রে এই দিকে কাজ করতে হবে:
- ছেলেমেয়েদের সাথে যোগাযোগ বাড়ান এবং তাদের ভালো-মন্দ চিনতে শেখান
- মাদকাসক্ত ব্যক্তিদের ধমক দেওয়ার পরিবর্তে বুঝিয়ে এবং সাহায্য করুন
- সমাজে এমন ব্যক্তিদের অনুপ্রাণিত করুন যারা মাদক থেকে মুক্ত হয়েছেন
- সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সচেতনতা ছড়িয়ে দিন
- মাদকাসক্ত বন্ধুদের থেকে দূরত্ব বজায় রাখুন অথবা তাদের সংশোধনের চেষ্টা করুন
- আন্তর্জাতিক মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ দিবসে অনুপ্রেরণামূলক বার্তা
- “মাদক নয়, শিক্ষা গ্রহণ করুন”
- “সুস্থ দেহে সুস্থ মন বাস করে”
- “মাদক জীবনের অবসান, সংযম জীবনের সূচনা”
- “প্রতিটি মাদক ত্যাগ করুন, প্রতিটি সম্পর্ককে জড়ো করুন”
মাদক একটি ধীর বিষ, যা মানুষের শরীর, মস্তিষ্ক, পরিবার এবং সমাজ—সবকিছুকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। ‘আন্তর্জাতিক মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ দিবস’ একটি এমন সুযোগ যখন আমরা নিজেদের সাথে প্রতিশ্রুতি করি যে আমরা মাদক থেকে দূরে থাকব এবং অন্যদেরও সচেতন করব। একটি সুস্থ, সবল এবং মাদকমুক্ত ভারতের কল্পনা তখনই বাস্তবায়িত হতে পারে যখন প্রতিটি নাগরিক এর সূচনা নিজের থেকে করে।