প্রতি বছর ১৫ই মে “জাতীয় ঊর্ধ্বতন নাগরিক প্রতারণা সচেতনতা দিবস” (National Senior Fraud Awareness Day) পালিত হয়। এই দিবসের উদ্দেশ্য হল – আমাদের সমাজের বয়োবৃদ্ধদের আর্থিক, ডিজিটাল ও সাইবার প্রতারণা থেকে রক্ষা করার জন্য সচেতনতা বৃদ্ধি করা। আজকের ডিজিটাল যুগে যেখানে অনলাইন পেমেন্ট, ব্যাংকিং এবং সোশ্যাল মিডিয়া সাধারণ ঘটনা, সেখানে বয়োবৃদ্ধরা প্রতারকদের সহজ লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হচ্ছেন।
জাতীয় ঊর্ধ্বতন নাগরিক প্রতারণা সচেতনতা দিবসের গুরুত্ব কী?
জাতীয় ঊর্ধ্বতন নাগরিক প্রতারণা সচেতনতা দিবসের গুরুত্ব অপরিসীম, কারণ এই দিবসের উদ্দেশ্য হল বয়োবৃদ্ধদের প্রতারণা ও ঠকাই থেকে রক্ষা করার জন্য সচেতনতা বৃদ্ধি করা। এই দিবসের মাধ্যমে আমরা তাদের বুঝিয়ে দিই যে কিভাবে প্রতারকরা ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার করে তাদের প্রতারণার শিকার করে। এই দিবস হল একটি সুযোগ যার মাধ্যমে আমরা নিশ্চিত করতে পারি যে বয়োবৃদ্ধদের তাদের অধিকার, সুরক্ষা ব্যবস্থা এবং ডিজিটাল ঝুঁকির সম্পর্কে সম্পূর্ণ তথ্য আছে।
বয়োবৃদ্ধদের সুরক্ষা বৃদ্ধির জন্য এই দিবস তাদের পরিবার ও সমাজকে সচেতন করে, যাতে তারা তাদের বয়োবৃদ্ধ আত্মীয়স্বজনদের প্রতারণা থেকে রক্ষা করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে পারে। এছাড়াও, এই দিবস আমাদের এ কথাও মনে করিয়ে দেয় যে আমাদের বয়োবৃদ্ধদের সাথে সময় কাটানো উচিত, যাতে আমরা তাদের অভিজ্ঞতা ও সমস্যার ব্যাপারে বুঝতে পারি এবং তাদের যে কোনও ধরণের প্রতারণা থেকে রক্ষা করতে পারি।
কেন ঊর্ধ্বতন নাগরিকদের প্রতারণা থেকে রক্ষা করা প্রয়োজন?
আজকের সময়ে ঊর্ধ্বতন নাগরিকদের প্রতারণা থেকে রক্ষা করা অত্যন্ত জরুরি হয়ে উঠেছে। এর প্রধান কারণ হল বয়োবৃদ্ধদের সাধারণত সীমিত আয় থাকে। তারা পেনশন, সঞ্চয় অথবা সন্তানদের সাহায্যে জীবনযাপন করেন। এমতাবস্থায় যদি কোনও প্রতারক তাদের পরিশ্রমের উপার্জন কেড়ে নেয়, তাহলে তাদের কাছে তা পুনরায় অর্জন করার সুযোগ থাকে না। এর ফলে শুধুমাত্র আর্থিক ক্ষতিই হয় না, বরং মানসিক চাপ ও হতাশার ঝুঁকিও বেড়ে যায়।
প্রতারকরা প্রায়ই বয়োবৃদ্ধদের লক্ষ্য করে, কারণ তারা সরল স্বভাবের হন এবং প্রযুক্তির সাথে তেমন পরিচিত নন। প্রতারকরা বিভিন্ন উপায়ে তাদের ফাঁদে ফেলে, যেমন—
মিথ্যা ব্যাংক কল: এতে প্রতারকরা ব্যাংক কর্মকর্তা সেজে OTP, অ্যাকাউন্ট নম্বর অথবা ATM পিনের মতো গোপনীয় তথ্য জিজ্ঞাসা করে।
লটারি/পুরস্কারের প্রতারণা: 'আপনার ২৫ লক্ষ টাকার লটারি জিতেছে' এরকম মিথ্যা বার্তা পাঠিয়ে তাদের কাছে প্রসেসিং ফি অথবা ট্যাক্সের নামে টাকা চাওয়া হয়।
চিকিৎসা ও বীমা প্রতারণা: সস্তা ওষুধ অথবা বীমা পলিসির প্রলোভন দেখিয়ে টাকা আদায় করা হয়।
সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রতারণা: প্রতারকরা কোনও আত্মীয়স্বজন অথবা পরিচিত ব্যক্তির নামে সাহায্য চাওয়ার ভান করে।
কোন কোন প্রধান প্রতারণার কৌশল রয়েছে?
আজকাল অনলাইন ও ফোনের মাধ্যমে প্রতারণা করার কৌশল ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে, বিশেষ করে বয়োবৃদ্ধ ও কম প্রযুক্তিগত জ্ঞান সম্পন্ন ব্যক্তিদের লক্ষ্য করে। এই প্রতারকদের অনেক কৌশল আছে, যা দেখতে সহজ মনে হলেও খুবই বিপজ্জনক। আসুন জেনে নিই কিছু প্রধান প্রতারণার কৌশল সম্পর্কে, যা চিনতে ও এড়িয়ে চলা অত্যন্ত জরুরি:
মিথ্যা কল সেন্টার প্রতারণা: এতে প্রতারকরা নিজেদের ব্যাংক কর্মকর্তা বলে ফোন করে এবং বলে যে আপনার অ্যাকাউন্টে কোনও সমস্যা আছে। তারপর তারা আপনার কাছ থেকে OTP, কার্ড নম্বর অথবা ব্যক্তিগত তথ্য চায়। একবার আপনি এই তথ্য দিয়ে দিলে, আপনার ব্যাংক ব্যালেন্স মিনিটের মধ্যে শূন্য হয়ে যেতে পারে।
জাল লিঙ্ক পাঠানো: ইমেইল, SMS অথবা WhatsApp এর মাধ্যমে জাল লিঙ্ক পাঠানো হয়। যেই মুহূর্তে আপনি সেই লিঙ্কে ক্লিক করবেন, আপনার মোবাইলে অথবা কম্পিউটারে ভাইরাস ঢুকে পড়তে পারে অথবা আপনার তথ্য হ্যাক হতে পারে।
মিথ্যা চিকিৎসা অথবা স্বাস্থ্য পরিকল্পনা: প্রতারকরা সস্তা ওষুধ, অলৌকিক চিকিৎসা অথবা সস্তা স্বাস্থ্য বীমা পরিকল্পনার প্রলোভন দেখিয়ে টাকা কেড়ে নেয়। পরে বোঝা যায় যে ওষুধটিও নকল ছিল এবং কোনও পলিসিও ছিল না।
সরকারি সুবিধা অথবা পেনশন স্কিমের নামে প্রতারণা: প্রতারকরা বলে যে আপনার পেনশন অথবা সরকারি স্কিমের সুবিধা পাওয়ার কথা। তারপর আধার নম্বর, প্যান কার্ড অথবা OTP চেয়ে আপনার অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা তুলে নেয়।
পরিবারের জরুরি অবস্থার প্রতারণা: এতে কোনও আত্মীয়স্বজনের নামে ফোন আসে—'ভাইসাহেব হাসপাতালে আছেন' অথবা 'ছেলে জেলে আছে'। ভয়ে লোকেরা টাকা পাঠিয়ে দেয় এবং পরে বুঝতে পারে যে সব মিথ্যা ছিল।
জাতীয় ঊর্ধ্বতন নাগরিক প্রতারণা সচেতনতা দিবস কীভাবে পালন করবেন?
জাতীয় ঊর্ধ্বতন নাগরিক প্রতারণা সচেতনতা দিবস পালনের জন্য আমাদের বয়োবৃদ্ধদের প্রতারণা থেকে বাঁচার উপায় সম্পর্কে সচেতন করতে হবে। এই দিবস আমাদের এ কথা মনে করিয়ে দেয় যে বয়োবৃদ্ধরা সমাজের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ এবং তাদের প্রতারণা থেকে রক্ষা করার জন্য আমাদের তাদের সাহায্য করতে হবে। এই দিবস পালনের জন্য আমরা কিছু নির্দিষ্ট পদক্ষেপ নিতে পারি:
যোগাযোগে থাকুন: বয়োবৃদ্ধদের সাথে দেখা করে তাদের প্রতারণা সম্পর্কে তথ্য দিন। তাদের বলুন যে কখনও অপরিচিত কল, মেসেজ অথবা লিঙ্কে ক্লিক করবেন না, এবং যদি তেমন হয় তাহলে তা অবিলম্বে উপেক্ষা করুন এবং কোনও বিশ্বস্ত ব্যক্তির সাথে কথা বলুন।
ওয়ার্কশপ ও সেমিনার: সম্প্রদায় কেন্দ্র, স্কুল ও সামাজিক সংগঠনের মাধ্যমে ওয়ার্কশপ ও সেমিনারের আয়োজন করুন। এই আয়োজনে বয়োবৃদ্ধদের প্রতারণার কৌশল, সাইবার অপরাধ এবং তার প্রতিরোধের ব্যবস্থা সম্পর্কে বলা যেতে পারে।
সোশ্যাল মিডিয়ায় সচেতনতা অভিযান: সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রতারণা থেকে বাঁচার উপায় সম্পর্কে পোস্ট, ভিডিও এবং তথ্য শেয়ার করুন। এটি বয়োবৃদ্ধদের সতর্ক করার একটি ভাল উপায় হতে পারে।
স্থানীয় পুলিশ ও হেল্পলাইন থেকে তথ্য: বয়োবৃদ্ধদের সাইবার ক্রাইম হেল্পলাইন নম্বর (১৯৩০) এবং স্থানীয় পুলিশের সাথে যোগাযোগ করার কথা বলুন। এছাড়াও, তাদের শেখান যে যদি তারা প্রতারণার শিকার হয়, তাহলে অবিলম্বে সাহায্য নিন।
বয়োবৃদ্ধদের কীভাবে সচেতন করবেন?
বয়োবৃদ্ধদের প্রতারণা থেকে রক্ষা করার জন্য প্রথম ও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ হল তাদের সঠিক তথ্য দেওয়া। তাদের স্পষ্ট ভাষায় বোঝাতে হবে যে কোনও ব্যাংক, বীমা কোম্পানি অথবা সরকারি প্রতিষ্ঠান কখনও ফোনে OTP, ATM PIN অথবা পাসওয়ার্ডের মতো গোপনীয় তথ্য চায় না। যদি কোনও অপরিচিত কল করে কেউ নিজেকে ব্যাংক কর্মকর্তা বলে পরিচয় দিয়ে এমন তথ্য চায়, তাহলে সেটি অবশ্যই প্রতারণা হতে পারে। এমন ক্ষেত্রে দেরি না করে ফোন কেটে দিতে হবে এবং অবিলম্বে পরিবারের কোনও বিশ্বস্ত সদস্যকে এর কথা জানাতে হবে। সময়মতো সতর্কতা অবলম্বন করলে বড় ধরণের ক্ষতি থেকে বাঁচা যায়।
পরিবারের ভূমিকাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ
বয়োবৃদ্ধদের সুরক্ষা আমাদের পরিবারের দায়িত্ব। তাদের সাহায্য করার জন্য আমাদের তাদের প্রযুক্তিগত তথ্য দিতে হবে, যাতে তারা ডিজিটাল প্রতারণা থেকে বাঁচতে পারে। আমাদের তাদের বলতে হবে যে আজকাল প্রতারকরা কত চালাকি করে লোকদের ফাঁদে ফেলে, এবং তাদের মোবাইল অথবা ইন্টারনেটে নতুন কিছু ব্যবহার করার সময় আমাদের তাদের সাহায্য করতে হবে।
যদি বয়োবৃদ্ধরা একা থাকেন, তাহলে সপ্তাহে একবার তাদের ব্যাংক ও ডিজিটাল লেনদেনের তথ্য জানতে হবে। এর মাধ্যমে আপনি নিশ্চিত হতে পারেন যে তারা নিরাপদে আছেন। তাদের বুঝিয়ে দিন যে যদি তাদের কোনও বিষয়ে সন্দেহ হয়, তাহলে তারা কোনও ভয় ছাড়াই আপনার সাথে যোগাযোগ করতে পারে। এতে তাদের মানসিক শান্তি বজায় থাকবে এবং তারা নিরাপদ বোধ করবে।
জাতীয় ঊর্ধ্বতন নাগরিক প্রতারণা সচেতনতা দিবস হল একটি সুযোগ—আমাদের বয়োবৃদ্ধদের ডিজিটাল ও আর্থিক সুরক্ষার তথ্য দেওয়ার। আজ যখন সবকিছু অনলাইনে হচ্ছে, তখন আমাদের উচিত আমাদের মা-বাবা, দাদা-দাদি ও অন্যান্য ঊর্ধ্বতন নাগরিকদের সময় সময় আপডেট রাখা।