২০২৫ সালের যোগিনী একাদশী: তিথি, গুরুত্ব ও পূজাবিধি

🎧 Listen in Audio
0:00

সনাতন ধর্মে একাদশী ব্রতের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। এই ব্রত ভগবান বিষ্ণুকে উৎসর্গ করা হয় এবং বছরজুড়ে মোট ২৪টি একাদশী আসে। প্রতিটি একাদশীরই নিজস্ব নাম, গুরুত্ব এবং ব্রতকথা রয়েছে। এদের মধ্যেই একটি হল ‘যোগিনী একাদশী’, যা আষাঢ় মাসের কৃষ্ণপক্ষে আসে। এই একাদশী কেবল পাপনাশের জন্যই নয়, মোক্ষদায়িনী হিসেবেও পরিচিত।

২০২৫ সালে যোগিনী একাদশী কবে?

২০২৫ সালে যোগিনী একাদশী ২১ জুন, শনিবার পালিত হবে। এই তিথি আষাঢ় মাসের কৃষ্ণপক্ষের একাদশীতে পড়ছে। পঞ্চাঙ্গ অনুযায়ী একাদশী তিথি ২১ জুন সকাল ০৭:১৮ টায় শুরু হয়ে ২২ জুন সকাল ০৪:২৭ টায় শেষ হবে। উদয়তিথি অনুযায়ী ব্রত ও পূজা ২১ জুনই করা হবে।

যোগিনী একাদশীর ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক গুরুত্ব

যোগিনী একাদশীর ব্রত ভগবান বিষ্ণুর কৃপা লাভের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হয়। একাদশী ব্রত দ্বারা মানুষের সকল পাপ ধুলোয় মিশে যায় এবং আত্মা পবিত্র হয়। প্রাচীন শাস্ত্রে বলা হয়েছে যে যোগিনী একাদশীর উপবাস করলে ব্যক্তির পূর্বপুরুষদের পাপও নষ্ট হয় এবং তার আত্মার শুদ্ধি হয়।

এই ব্রত পালন করলে মানসিক শান্তি পাওয়া যায়, ধ্যান ও একাগ্রতা বৃদ্ধি পায় এবং মনে ইতিবাচক শক্তির সঞ্চার হয়। বলা হয় যে, যারা এই ব্রতটি পূর্ণ নিষ্ঠা ও শ্রদ্ধার সাথে পালন করে তাদের জীবনে স্বাস্থ্য, সুখ, সমৃদ্ধি এবং মোক্ষের দ্বার উন্মোচিত হয়।

যোগিনী শব্দের অর্থ – শক্তিশালী দেবী অথবা যিনি শক্তি প্রদান করেন। এই ব্রত পালন করলে দেহ, মন ও আত্মার শক্তি বৃদ্ধি পায়, যা আমাদের জীবনের প্রতিটি কঠিন পরিস্থিতির সাথে লড়াই করতে সাহায্য করে।

যোগিনী একাদশী ব্রতের পূজাবিধি

যোগিনী একাদশীর দিন ব্রত শুরু করার আগে সকালে তাড়াতাড়ি উঠে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার বিশেষ দিকে লক্ষ্য রাখা প্রয়োজন। এখানে ব্রতের সহজ ও কার্যকর পূজাবিধি দেওয়া হল:

  • স্নান ও শুদ্ধি: ব্রতের দিন সকালে তাড়াতাড়ি উঠে পরিষ্কার জলে স্নান করুন। স্নানের পর পরিষ্কার পোশাক পরুন।
  • ব্রতসংকল্প: ভগবান বিষ্ণুর সামনে বসে ব্রতের সংকল্প করুন। মনে সংকল্প করুন যে আজকের দিনটি পূর্ণ শ্রদ্ধা ও নিষ্ঠার সাথে কাটাবেন।
  • পূজা সামগ্রী: ভগবান বিষ্ণুর প্রতিমা বা ছবি স্থাপন করুন। পূজার জন্য হলুদ ফুল, তুলসীপাতা, ফল, পঞ্চামৃত, পাঞ্জরী, মিষ্টান্ন এবং ধূপ-দীপ ব্যবহার করুন।
  • মন্ত্রজপ: ‘ॐ नमो भगवते वासुदेवाय’ মন্ত্রটি ১০৮ বার জপ করুন। মন্ত্রজপ দ্বারা মানসিক শান্তি পাওয়া যায় এবং ভগবান বিষ্ণুর কৃপা লাভ হয়।
  • একাদশী কথার পাঠ: ব্রতকথা পড়ুন বা শুনুন। কথার শ্রবণ ও পাঠ করলে ব্রতের পুণ্যফল বৃদ্ধি পায়।
  • আরতি: পূজার শেষে আরতি করুন এবং প্রসাদ বিতরণ করুন।
  • ব্রতপালন: এই দিন তামসিক খাবার যেমন মাংস, মাছ, পেঁয়াজ, রসুন এবং মদ্যপান থেকে বিরত থাকুন। পরিষ্কার, সাৎত্বিক ও হালকা খাবার খান অথবা নিরজল উপবাস করুন।
  • দ্বাদশীতে পারণ: পরের দিন দ্বাদশীতে ব্রতের পারণ করুন। ভগবান বিষ্ণুর প্রসাদ ভোগ দিন।

যোগিনী একাদশী ব্রতে কি করবেন এবং কি করবেন না?

কি করবেন:

  • তুলসীপাতা ছাড়া ভগবান বিষ্ণুর পূজা অসম্পূর্ণ মনে করা হয়, তাই তুলসীদল অবশ্যই অর্পণ করুন।
  • সারাদিন উপবাস রাখুন এবং মন, বচন, কর্মে শুদ্ধ থাকুন।
  • দরিদ্রদের অন্ন, বস্ত্র ও দক্ষিণা দান করুন।
  • সন্ধ্যায় দীপদান অবশ্যই করুন।

কি করবেন না:

  • তামসিক খাবার যেমন রসুন, পেঁয়াজ, মাংস-মদ্যপান থেকে বিরত থাকুন।
  • ক্রোধ, ছল-কপট ও মিথ্যা থেকে দূরে থাকুন।
  • অপ্রয়োজনীয় বিবাদে জড়ান না।

যোগিনী একাদশী সংক্রান্ত প্রধান বিশ্বাস

যোগিনী একাদশী নিয়ে এমন বিশ্বাস রয়েছে যে, যিনি শ্রদ্ধা ও ভক্তির সাথে এই ব্রত পালন করেন, তার বর্তমান জন্মের পাপ তো দূর হয়ই, সাথে সাথে তার অতীত জন্মের দোষও নষ্ট হয়। এই ব্রত পালন করলে ব্যক্তির জীবনে আসা সংকট ও অসুবিধার অবসান ঘটে। মনে শান্তি এবং আত্মায় শুদ্ধি আসে, যার ফলে জীবনে ইতিবাচক পরিবর্তন আসে।

এই ব্রত ভগবান বিষ্ণুর বিশেষ কৃপা লাভের মাধ্যম মনে করা হয়। যারা পূর্ণ নিয়ম ও নিষ্ঠার সাথে যোগিনী একাদশীর ব্রত পালন করেন, তাদের প্রতিটি মনোকামনা পূর্ণ হয় এবং জীবনে সাফল্য, সমৃদ্ধি ও সুখের প্রাপ্তি হয়। মনে করা হয় এই দিন ব্রত করলে মানুষ খারাপ সময় থেকে উত্তরণ লাভ করে এবং তার ভাগ্য উজ্জ্বল হয়।

যোগিনী একাদশী ব্রতের উপকারিতা

  • এই ব্রত মানসিক শান্তি এবং আধ্যাত্মিক শক্তি বৃদ্ধি করে।
  • শারীরিক স্বাস্থ্যের উন্নতি সাধন হয়।
  • ব্যক্তির জীবন থেকে নেতিবাচক প্রভাব দূর হয়।
  • ধন-সম্পদ ও সাফল্য অর্জিত হয়।
  • জীবনে আসা বাধা নিবারণ হয় এবং ভাগ্য শক্তিশালী হয়।

যোগিনী একাদশী ব্রতকথা

অনেক আগে অলকাপুরী নামক একটি নগরে কুবের নামে একজন রাজা রাজত্ব করতেন। তিনি ভগবান শিবের পরম ভক্ত ছিলেন এবং প্রতিদিন শিবলিঙ্গে পূজা করে ফুল অর্পণ করতেন। তার সেবারত একজন মালি (ফুলওয়ালা)ও কাজ করত, যার নাম ছিল হেম। হেমের স্ত্রীর নাম ছিল বিশালাক্ষী।

একদিন মালি তার স্ত্রীর সৌন্দর্যে এতটাই মগ্ন হলেন যে কুবেরের জন্য ফুল নিয়ে যাওয়া ভুলে গেলেন। রাজা কুবের যখন শিবপূজার জন্য ফুল চাইতে পুরোহিতের কাছে গেলেন, তখন জানতে পারলেন যে মালি ফুল নিয়ে আসেনি। এ কথা শুনে কুবেরের খুব রাগ হল এবং তিনি মালিকে ডেকে দণ্ড দিলেন। রাজা তাকে কুষ্ঠ রোগে আক্রান্ত হওয়ার অভিশাপ দিলেন এবং নগর থেকে বের করে দিলেন।

অভিশপ্ত হয়ে হেম মালি জঙ্গলে ঘুরে বেড়াতে লাগলেন। একদিন তিনি এক ঋষির আশ্রমে পৌঁছালেন। সেখানে ঋষি মার্কণ্ডেয় তাকে দেখে তার অবস্থা জিজ্ঞাসা করলেন। হেম মালি তার সকল ভুল এবং দুঃখের কথা ঋষিকে বললেন। তখন ঋষি তাকে যোগিনী একাদশীর ব্রত পালন করার পরামর্শ দিলেন এবং জানালেন যে এই ব্রত করলে সকল পাপ ধুলোয় মিশে যায়।

হেম মালি পূর্ণ নিয়মে যোগিনী একাদশীর ব্রত পালন করলেন। তার শ্রদ্ধা ও ভক্তিতে ভগবান বিষ্ণু প্রসন্ন হলেন এবং তাকে কুষ্ঠ রোগ থেকে মুক্তি দিলেন। এরপর তার জীবন সুখময় হল। এই কথামালা থেকে শিক্ষা পাওয়া যায় যে, যোগিনী একাদশীর ব্রত আন্তরিকতা ও শ্রদ্ধার সাথে পালন করা উচিত, তাহলে জীবনের সকল দুঃখ দূর হয়ে যায়।

যোগিনী একাদশীর ব্রত কেবলমাত্র ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়, বরং এটি আত্মশুদ্ধি ও ভক্তির পথ। এটি জীবনের সেসব অন্ধকার দিক থেকে বেরিয়ে আসার একটি শক্তিশালী সাধনা, যা আমাদের পাপ, রোগ ও দুঃখে বন্দী করে রাখে। এই একাদশীটি পূর্ণ শ্রদ্ধা ও বিধি-বিধানের সাথে পালন করুন, নিশ্চিতভাবে ভগবান বিষ্ণুর কৃপা আপনার উপর বর্ষিত হবে এবং জীবনে সুখ-শান্তির সঞ্চার হবে।

Leave a comment