প্রতি মাসের কৃষ্ণপক্ষের অষ্টমী তিথিতে হিন্দু ধর্মে কালীষ্টমীর পর্ব পালিত হয়। এই দিনটি ভগবান শিবের ভয়ঙ্কর রূপ, কালভৈরবের পূজা-অর্চনার জন্য অত্যন্ত বিশেষ বলে মনে করা হয়। এই দিনে শিবের ভক্তরা অপরিসীম ভক্তি ও আস্থার সাথে ব্রত পালন করেন এবং তাঁর উপাসনা করেন। জ্যোতিষশাস্ত্রেও কালীষ্টমীকে অত্যন্ত শুভ ও ফলপ্রদ বলে মনে করা হয়েছে। বলা হয়, এই দিনে সত্যিকারের মনে ভগবান কালভৈরবের পূজা করলে জন্মপত্রে গ্রহদোষ দূর হয়, মনোকামনা পূর্ণ হয় এবং জীবনের দুঃখ-কষ্ট দূর হয়।
কালীষ্টমী ২০২৫: কবে এবং শুভ মুহূর্ত
পঞ্চাঙ্গ অনুসারে, মে ২০২৫-এ কালীষ্টমী ২০ মে রাত ১:৪০ মিনিটে শুরু হবে এবং ২১ মে সকাল ১২:২৮ মিনিট পর্যন্ত চলবে। মাসিক কালীষ্টমীর ব্রত ২০ মে পালন করা হবে। এই দিনের পূজা ও ব্রত পালন অত্যন্ত শুভ বলে মনে করা হয়।
শুভ মুহূর্ত:
অষ্টমী তিথি আরম্ভ: ২০ মে ২০২৫, রাত ১:৪০ মিনিট
অষ্টমী তিথি সমাপ্তি: ২১ মে ২০২৫, সকাল ১২:২৮ মিনিট
ব্রহ্মমুহূর্ত (পূজার জন্য উত্তম সময়): সকাল ৪:৩০ মিনিট থেকে ৫:৩০ মিনিট পর্যন্ত
কালীষ্টমী পূজাবিধি:
কালীষ্টমীর দিন সকালে ব্রহ্মমুহূর্তে উঠা অত্যন্ত শুভ বলে মনে করা হয়। এই সময় উঠে পূজা করলে ব্রতের ফল বেশি পাওয়া যায় এবং ভগবান কালভৈরব ও শিবের কৃপা লাভ হয়।
- স্নান ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা: প্রথমে সকালে তাড়াতাড়ি উঠে নিত্যকর্ম সম্পন্ন করুন। তারপর গঙ্গাজল অথবা পবিত্র জলে স্নান করুন। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও হালকা রঙের পোশাক পরুন যাতে মন ও শরীর উভয়ই পরিশুদ্ধ থাকে। পূজার জন্য পূর্ণ প্রস্তুতি ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা অত্যন্ত জরুরি।
- পূজাস্থলের প্রস্তুতি: এবার পূজার জন্য যে স্থানটি নির্বাচন করেছেন, তা ভালো করে পরিষ্কার করুন। সেখানে লাল রঙের পরিষ্কার কাপড় বিছান। তার উপর ভগবান শিব ও কালভৈরবের মূর্তি অথবা ছবি স্থাপন করুন। যদি মূর্তি না পাওয়া যায় তাহলে ছবি দিয়েও পূজা করা যায়। খেয়াল রাখবেন পূজাস্থল শান্ত ও পরিষ্কার থাকবে।
- পূজা আরম্ভ: পূজার সূচনা ভগবান শিব ও কালভৈরবকে সাদা চন্দনের তিলক দিয়ে করুন। চন্দন দেওয়ার ফলে পূজার পরিবেশ পবিত্র হয় এবং এটি ভগবানকে অত্যন্ত প্রিয়। এরপর তাঁদের সামনে ফুল অর্পণ করুন।
- ধূপ ও প্রদীপ জ্বালান: ফুল অর্পণ করার পর ধূপ ও প্রদীপ জ্বালান। এটি পরিবেশকে শুদ্ধ করে এবং ভগবানের আরাধনায় মনকে স্থির করে। প্রদীপের আলো অশুভ শক্তিকে দূর করে এবং ইতিবাচক শক্তির আবির্ভাব ঘটায়।
- ভোগ নিবেদন: ভগবান শিব ও কালভৈরবকে ফল, মিষ্টান্ন ও জলের ভোগ নিবেদন করুন। এই ভোগ সরলভাবে এবং পূর্ণ ভক্তির সাথে নিবেদন করা উচিত। ভোগ নিবেদনের ফলে ভগবানের কৃপা লাভ হয় এবং মনোকামনা পূর্ণ হয়।
- প্রার্থনা ও ব্রত সংকল্প: ভোগ নিবেদন করার পর হাত জোড় করে ভগবানের কাছে আপনার ভুল ও পাপের ক্ষমা চান। এই দিন ব্রত পালনের সংকল্প করুন এবং মনে প্রতিজ্ঞা করুন যে ভবিষ্যতে সৎকর্ম করবেন। এর ফলে ব্রত সফল হয় এবং জীবনে ইতিবাচক পরিবর্তন আসে।
- আরতি করুন: এবার কালভৈরবের আরতি করুন। আরতির সময় তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করুন যে তিনি আপনার রক্ষা করেছেন। আরতির পর মন্দির অথবা পূজাস্থল পরিষ্কার করুন।
- সূর্যদেবকে জল অর্পণ করুন: পূজার শেষে ভগবান সূর্যকে জল অর্পণ করুন। এই কাজটি অত্যন্ত শুভ বলে মনে করা হয় এবং এর ফলে আপনার পূজা সম্পূর্ণ হয়। জল অর্পণ করার ফলে গ্রহদোষ দূর হয় এবং জীবনে সফলতা লাভ হয়।
কালীষ্টমীর ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক গুরুত্ব
কালীষ্টমী ভগবান শিবের রৌদ্র রূপ কালভৈরবের পূজার বিশেষ দিন। কালভৈরবকে কালের অধিপতি বলে মনে করা হয় এবং তিনি সকল অশুভ শক্তিকে দূর করেন। এই দিন তাঁর পূজা করলে জীবনে আসা সকল দুঃখ-কষ্ট ও বাধা দূর হয়। পাশাপাশি, গ্রহদের কারণে হওয়া দোষও শান্ত হয়, যার ফলে আমাদের জীবনে সুখ-শান্তি বজায় থাকে।
ধর্মীয় বিশ্বাস অনুসারে, কালীষ্টমীর ব্রত পালন করলে মন ও আত্মাকে শান্তি মেলে। এই দিন করা পূজা, দান ও শুভ কাজের ফলে ভগবান শিব ও কালভৈরবের কৃপা লাভ হয়। বিশেষ করে যাদের জন্মপত্রে শনি, রাহু অথবা কেতুর কারণে কোন গ্রহদোষ আছে তাদের জন্য এই দিনটি অত্যন্ত উপকারী। এই দিন করা শুভ কাজ জীবনে সমৃদ্ধি ও সফলতা আনে।
কালীষ্টমীতে দান-পুণ্যের বিশেষ গুরুত্ব
কালীষ্টমী দিন ভগবান শিব ও কালভৈরবের পূজার বিশেষ দিন। এই দিন দান করা অত্যন্ত শুভ ও ফলপ্রদ বলে মনে করা হয়। ধর্মগ্রন্থে বলা হয়েছে কালীষ্টমীর দিন করা দান অনেকগুণ বেশি ফল দেয়। তাই এই দিন দান-পুণ্য করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
যদি আপনি দান করতে চান তাহলে আপনি দরিদ্রদের মাটির পাত্র, সাদা বস্ত্র, ফল অথবা খাবার দিতে পারেন। এই জিনিসগুলি দরিদ্র ও অসহায় মানুষের জন্য অত্যন্ত সাহায্যকর। পাশাপাশি, এই দিন ধনদানও অত্যন্ত পুণ্যকর বলে মনে করা হয়। আপনি যা ক্ষমতানুযায়ী দান করবেন, তার ফলে আপনার ঘরে ও জীবনে সুখ-শান্তি বজায় থাকবে।
দান করার সময় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো আপনার মন সম্পূর্ণ নিঃস্বার্থ হবে। কোন স্বার্থ ছাড়াই, শুধুমাত্র ভগবানের কৃপা লাভ করার উদ্দেশ্যে করা দানই ভগবান শিবকে পছন্দ হয়। এ ধরণের দান শুধুমাত্র সমাজের সেবা করে না, বরং আপনার জীবনে আধ্যাত্মিক দিক থেকেও অত্যন্ত বড় উপকার করে। তাই কালীষ্টমীতে দান করা ভুলবেন না এবং আপনার জীবনে সুখ-সমৃদ্ধি আনুন।
কালীষ্টমী ব্রত কেন পালন করবেন?
কালীষ্টমী ব্রত পালনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ সুফল আছে। প্রথমত, এই ব্রত শরীর ও মন উভয়কেই শান্তি ও প্রশান্তি দেয়। যখন আমরা ব্রত পালন করি, তখন আমাদের মন একাগ্র হয় এবং নেতিবাচক চিন্তা কমে যায়, যার ফলে মানসিক শুদ্ধি হয়। এর ফলে ব্যক্তির আধ্যাত্মিক উন্নতি হয় এবং জীবনে ইতিবাচক পরিবর্তন আসতে থাকে।
তদুপরি, ব্রতের সময় সংযত ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন খাবার গ্রহণ করা উচিত এবং ভগবান শিবের কথা শোনা উচিত অথবা তাঁর মন্ত্র জপ করা উচিত। এভাবে করলে ব্রতের প্রভাব আরও শক্তিশালী হয় এবং ভগবানের কৃপা লাভ হয়। এইভাবে, কালীষ্টমী ব্রত আমাদের জীবনে শক্তি, সাহস ও আভ্যন্তরীণ শক্তি বৃদ্ধি করে।
কালীষ্টমী পূজার আরতি
কালীষ্টমীর দিন ভগবান শিবের রৌদ্র রূপ কালভৈরবের আরতি করা অত্যন্ত শুভ বলে মনে করা হয়। এই আরতি সরল ও ভক্তিপূর্ণ, যার ফলে মনে শান্তি ও বিশ্বাস বৃদ্ধি পায়।
আরতি পাঠ:
জয় কালভৈরব, কালের অধিপতি,
সব দুঃখ হরণকারী, সব মনোকামনা পূরণকারী।
ত্রাহি ত্রাহি করুম আমি, কৃপা করুন আমার উপর,
শিবের রূপে রৌদ্র, কালভৈরব মহারাজ।
ভক্তের সংকট হরণ করুন, জীবনে আনুন শান্তি,
দুষ্টের নাশ করুন, সকল বাধা দূর করুন।
তুমিই হো সকলের রক্ষক,
তোমার পূজা দিয়েই জীবনে আসে সুখ।
জয় কালভৈরব, জয় কালভৈরব।
কালীষ্টমী পূজার কথা
কালীষ্টমী দিন ভগবান শিবের রৌদ্র রূপ কালভৈরবের পূজার জন্য বিশেষ বলে মনে করা হয়। বলা হয়, একবার ভগবান শিব তাঁর অনুগামীদের শিক্ষা দিয়েছিলেন যে সময় (কাল) সকলের পালনকর্তা এবং তিনি সকল অশুভ শক্তিকে ধ্বংস করেন। কালভৈরবই কালের অধিপতি, যিনি ধর্মের রক্ষা করেন এবং অধর্মের ধ্বংস করেন। তাই এই দিন তাঁর পূজা করলে সকল প্রকার বাধা দূর হয় এবং জীবনে সুখ-শান্তি আসে।
কথার বর্ণনা অনুসারে, একবার এক রাজকুমারের জীবনে নানা ধরণের সমস্যা দেখা দিয়েছিল। তিনি অনেক সাধু ও ঋষির কাছে উপায় চেয়েছিলেন, কিন্তু কেউই সমস্যার সমাধান করতে পারেননি। অবশেষে একজন সাধু তাঁকে জানালেন যে তিনি কালীষ্টমীর দিন কালভৈরবের পূজা করবেন এবং ব্রত পালন করবেন। রাজকুমার ভক্তিপূর্ণভাবে ব্রত পালন করেছিলেন এবং ভগবান কালভৈরবের আরাধনা করেছিলেন। এরপর তার সকল সমস্যা দূর হয়ে গিয়েছিল এবং তিনি সুখে জীবনযাপন করতে শুরু করেছিলেন। এই কথার মাধ্যমে এটি স্পষ্ট হয় যে কালীষ্টমী পূজায় বড় শক্তি আছে।
সেজন্য প্রতি বছর মাসিক কালীষ্টমীতে লোকেরা ভগবান কালভৈরবের পূজা করে, তাঁর কাছে আশীর্বাদ লাভ করে এবং ব্রত পালন করে। এই দিন দান-পুণ্য করাও অত্যন্ত শুভ বলে মনে করা হয়। বলা হয় এর ফলে জন্মপত্রের গ্রহদোষ শান্ত হয় এবং জীবনে সুখ-সমৃদ্ধি আসে। কালীষ্টমী পূজার এই কথা আমাদের শিক্ষা দেয় যে সত্যিকারের মনে করা ভক্তি ও শ্রদ্ধা দিয়ে সকল বাধা দূর করা যায়।
কালীষ্টমীর পর্ব ভগবান শিবের রৌদ্র রূপ কালভৈরবের পূজা ও ব্রতের গুরুত্বপূর্ণ উপলক্ষ্য, যা জীবনের সকল বাধা ও গ্রহদোষ দূর করে বলে মনে করা হয়। এই দিন করা ভক্তি, পূজা ও দান দিয়ে মন ও আত্মাকে শান্তি মেলে এবং জীবনে সুখ-সমৃদ্ধি আসে। তাই, কালীষ্টমীর ব্রত ও পূজা শ্রদ্ধাভরে পালন করা উচিত যাতে ভগবান কালভৈরবের কৃপা বজায় থাকে এবং জীবন সুখময় হয়।
```