পৃথিবীতে স্বর্গের সমতুল্য মনে করা কৈলাশ মানসসরোবরের যাত্রা প্রতি বছর হাজার হাজার ভক্তকে আকর্ষণ করে। এই যাত্রা কেবলমাত্র ধর্মীয় নয়, বরং একটি আধ্যাত্মিক ও রহস্যময় অভিজ্ঞতাও। কৈলাশ পর্বতের প্রদক্ষিণ শুরু করার আগে একটি স্থান আছে, যাকে যমদ্বার বলা হয় – মৃত্যুর প্রবেশদ্বার। এই দ্বার ভক্তদের জন্য কেবলমাত্র একটি স্থান নয়, বরং একটি আধ্যাত্মিক পরীক্ষাও।
যমদ্বার কী?
যমদ্বারের শাব্দিক অর্থ – মৃত্যুদেবতা যমরাজের দ্বার। এই স্থান কৈলাশ পর্বতের পশ্চিমে অবস্থিত এবং এখান থেকেই কৈলাশের তিন দিনের প্রদক্ষিণ শুরু হয়। এই স্থান ধর্মীয়, আধ্যাত্মিক ও বৈজ্ঞানিকভাবে রহস্যে পরিপূর্ণ। তিব্বতী ভাষায় একে ‘তারবোচে’ নামে জানা হয়। এখানে একটি বিশাল ধ্বজস্তম্ভ অবস্থিত, যা প্রতি বছর বৈশাখ পূর্ণিমার দিন তিব্বতী বৌদ্ধ অনুসারীরা গভীর শ্রদ্ধা ও উল্লাসের সাথে পরিবর্তন করে। এই অনুষ্ঠান কেবলমাত্র ধর্মীয় নয়, বরং সাংস্কৃতিক ঐক্যেরও প্রতীক বলে মনে করা হয়।
কেন যমদ্বার এত রহস্যময়?
যমদ্বারের সাথে জড়িত অনেক অদ্ভুত ও ভয়ঙ্কর বিশ্বাস বহু বছর ধরে চলে আসছে। মনে করা হয় যে, যে কেউ এই দ্বারের কাছে রাত কাটানোর চেষ্টা করে, তার মৃত্যু নিশ্চিত। গত কয়েক বছরে কিছু ঘটনা সামনে এসেছে, যেখানে যাত্রীরা আবহাওয়া খারাপ হওয়ার কারণে যমদ্বারের কাছে থেমে গেছে এবং পরের দিন মৃত অবস্থায় পাওয়া গেছে।
বৈজ্ঞানিকরা এখনও পর্যন্ত এই রহস্যের কোন স্পষ্ট উত্তর দিতে পারেননি। কিছু বিশেষজ্ঞ একে অক্সিজেনের অভাব, উচ্চ বিকিরণ এবং বরফের ঠান্ডা বাতাসের প্রভাব মনে করেন, কিন্তু এটি কেবলমাত্র একটি প্রযুক্তিগত ব্যাখ্যা। ধর্মীয় বিশ্বাস অনুসারে, এটি যমরাজের অঞ্চল এবং এখানে থাকা দেবতাদের অমান্য করা বলে মনে করা হয়। এই কারণেই রাত্রি বিশ্রাম নিষিদ্ধ।
পিছনে ফিরে তাকানোর নিষেধাজ্ঞা
হিন্দু ও তিব্বতী বিশ্বাস অনুসারে, যমদ্বার পার হওয়ার পর কখনো পিছনে ফিরে তাকানো উচিত নয়। এটি করা নেতিবাচক শক্তিকে আকর্ষণ করে এবং যাত্রায় বাধা সৃষ্টি করে। এই নিয়মও এই দ্বারের প্রভাবের মতোই রহস্যময় ও কঠোর বলে মনে করা হয়।
ধর্মীয় গুরুত্ব ও বিশ্বাস
হিন্দু ধর্মে যমদ্বারের অত্যন্ত পবিত্র ও নির্ণায়ক গুরুত্ব রয়েছে। ধর্মীয় শাস্ত্র অনুসারে, যে ব্যক্তি যমদ্বার পার হয়ে কৈলাশের প্রদক্ষিণ করে, তার সকল পাপ ক্ষমা হয়। চিত্রগুপ্ত, যাকে যমরাজের লেখাপড়া বলে মনে করা হয়, এমন পুণ্যাত্মার আত্মার হিসাব-নিকাশ শেষ করে এবং তাকে স্বর্গের পথ প্রশস্ত করে দেয়। তাই মনে করা হয় যে, কৈলাশ প্রদক্ষিণ জীবনে একবার অবশ্যই করা উচিত, কারণ এটি জন্মের পাপ থেকে মুক্তি দিতে পারে।
২০২৫ সালে আবার খুলবে কৈলাশের দ্বার
কোভিড-19 মহামারী এবং সীমান্ত বিবাদের কারণে গত কয়েক বছরে কৈলাশ যাত্রায় নিষেধাজ্ঞা ছিল। কিন্তু ২০২৫ সালের জুনের শেষ সপ্তাহ থেকে যাত্রা শুরু হওয়ার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা হয়েছে। এই বছর ভারত-চীনের মধ্যে উন্নত সম্পর্কের কারণে নতুন পথ খোলা হয়েছে যাতে যাত্রা আরও সহজ হবে। এই যাত্রা উত্তরাখণ্ডের লিপুলেখ পথ এবং নেপালের হুমলা পথ দিয়ে সম্পন্ন করা যাবে।
তিব্বতী বৌদ্ধ ধর্মেও যমদ্বারের বিশেষ স্থান রয়েছে। এখানে ‘সাগা দাওয়া উৎসব’-এর সময় হাজার হাজার তিব্বতী বৌদ্ধ যমদ্বারে জড়ো হয় এবং বিশাল ধ্বজস্তম্ভ পরিবর্তন করে। এই স্তম্ভ পৃথিবী ও আকাশের মধ্যে সংযোগ বলে মনে করা হয়। এই উৎসব ভগবান বুদ্ধের জন্ম, জ্ঞান লাভ এবং নির্বাণের সাথে জড়িত এবং এটি অত্যন্ত শুভ বলে মনে করা হয়।
যমদ্বার কেবলমাত্র একটি ভৌগোলিক স্থান নয়, এটি ধর্ম, আধ্যাত্ম ও রহস্যের সংমিশ্রণ। এখানে থাকা নিষেধ, পিছনে ফিরে তাকানো নিষিদ্ধ, এবং এটি পার হয়ে কৈলাশের প্রদক্ষিণ করা জীবনের পরম লক্ষ্য বলে মনে করা হয়।