মহাভারতের ১৮ দিনের যুদ্ধ: একটি আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যা

🎧 Listen in Audio
0:00

মহাভারত এক অমূল্য মহাকাব্য, যা শুধুমাত্র যুদ্ধের কাহিনী নয়, বরং ধর্ম-অধর্ম, নীতি-অনীতি এবং জীবনের গূঢ় রহস্য ব্যাখ্যা করে এমন এক অসাধারণ গ্রন্থ। এতে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধকে ধর্মযুদ্ধ বলা হয়েছে, যা দ্বাপর যুগে সংঘটিত হয়েছিল। এই যুদ্ধে পান্ডবরা ধর্মের পক্ষে এবং কৌরবরা অধর্মের পক্ষে লড়াই করেছিল। এই যুদ্ধ মোট ১৮ দিন স্থায়ী ছিল, এবং এই সংখ্যা (১৮) এই মহাকাব্যে বার বার উল্লেখিত হয়েছে। কিন্তু কি আপনি কখনো ভেবে দেখেছেন যে, আসলে এই যুদ্ধ শুধুমাত্র ১৮ দিন কেনই স্থায়ী ছিল? একদিন কম নয়, একদিন বেশি নয়।

১৮ দিন এবং মহাভারতের রহস্য

মহাভারত শুধুমাত্র একটি যুদ্ধ ছিল না, এটি ছিল ধর্ম এবং অধর্মের মধ্যে সবচেয়ে বৃহৎ লড়াই। কিন্তু এই যুদ্ধের সবচেয়ে আশ্চর্যজনক ব্যাপার হলো, এটি মাসের পর মাস বা বছরের পর বছর ধরে চলে নি, বরং মাত্র ১৮ দিনেই শেষ হয়ে গিয়েছিল।

১৮-এর দিব্য রহস্য:

১৮ দিনের যুদ্ধ: মহাভারতের এই ভয়াবহ যুদ্ধ কুরুক্ষেত্রের মাঠে মাত্র ১৮ দিন স্থায়ী ছিল। প্রতিদিন নতুন নতুন কৌশল, নতুন নতুন কার্যকলাপ এবং অনেক যোদ্ধার মৃত্যু। এই যুদ্ধ যতটা রক্তাক্ত ছিল, ততটাই পরিকল্পিত এবং রহস্যময়ও ছিল।

১৮ অধ্যায়ের গীতা: যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে অর্জুন যুদ্ধ থেকে পিছিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। তখন ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তাকে যে উপদেশ দিয়েছিলেন, সেটাই আজ শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা নামে পরিচিত। এতে মোট ১৮ টি অধ্যায় রয়েছে, এবং প্রতিটি অধ্যায় জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিককে তুলে ধরে। এটি কোনো সম্পূর্ণ যোগাযোগ নয়, বরং একটি আধ্যাত্মিক সংকেত।

১৮ টি অক্ষৌহিণী সেনা: মহাভারতের যুদ্ধে মোট ১৮ টি অক্ষৌহিণী সেনা অংশগ্রহণ করেছিল। পান্ডবদের কাছে ৭ টি এবং কৌরবদের কাছে ১১ টি অক্ষৌহিণী সেনা ছিল। প্রতিটি অক্ষৌহিণীতে লক্ষ লক্ষ যোদ্ধা ছিল। যুদ্ধের এই সংগঠনও ১৮ সংখ্যার সাথে যুক্ত ছিল।

শেষে ১৮ জন প্রধান যোদ্ধা বেঁচে ছিলেন: এই ভয়াবহ যুদ্ধের শেষে যখন ধুলোবালি ছড়িয়ে পড়েছিল, তখন মাঠে মাত্র ১৮ জন প্রধান যোদ্ধা বেঁচে ছিলেন। এটি নিজেই একটি গভীর প্রতীক – শক্তি, নীতি এবং ভাগ্যের মিশ্র ফলাফল।

১৮ দিনে রচিত মহাভারত: মনে করা হয় যে, মহর্ষি বেদব্যাস ভগবান গণেশের সাহায্যে এই মহাকাব্যটি মাত্র ১৮ দিনে লিখেছিলেন। বেদব্যাসের দিব্য দৃষ্টি আগেই যুদ্ধের ঘটনা দেখেছিল, এবং গণেশ লিখতে লিখতে এটিকে গ্রন্থের আকার দিয়েছিলেন।

কি ‘১৮’ এর অর্থ?

হিন্দু ধর্মে ১৮ সংখ্যার খুবই বিশেষ গুরুত্ব আছে। একে “৯” এর গুণিতক মনে করা হয়, কারণ ১ + ৮ = ৯ হয়। ৯ সংখ্যাকে পূর্ণতা, সমাপ্তি এবং ব্রহ্মাণ্ডীয় ভারসাম্যের প্রতীক মনে করা হয়। যেমন নবদুর্গার নয়টি রূপ, নবগ্রহের নয়টি গ্রহ এবং নবধা ভক্তির নয়টি প্রকার। তাই ১৮ আধ্যাত্মিকভাবে সম্পূর্ণ সমাপ্তি এবং ভারসাম্যের ইঙ্গিত দেয়।

মহাভারতের ১৮ দিনের যুদ্ধকেও এই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা যেতে পারে। এই যুদ্ধ মানুষের মনের ক্রোধ, মোহ, লোভ, অহংকার ইত্যাদি নেতিবাচক অনুভূতির সাথে লড়াই এবং আত্মশুদ্ধির প্রক্রিয়া প্রতীক। ১৮ দিন সেই কঠিন সাধনা ও আত্মমনন, যার শেষে সত্য এবং ধর্মের বিজয় হয়। তাই ‘১৮’ শুধুমাত্র একটি সংখ্যা নয়, বরং আধ্যাত্মিক জাগ্রত এবং মানুষের ভেতরের লড়াইয়ের বার্তাও।

মহাভারত যুদ্ধের কারণ: শুধুমাত্র ভূমির বিবাদ ছিল না

মহাভারতের যুদ্ধ শুধুমাত্র জমি বা রাজ্যের লড়াই ছিল না, বরং এর পিছনে আরও অনেক গভীর কারণ ছিল যা সামাজিক, নৈতিক এবং ব্যক্তিগত ছিল।

দুর্যোধনের অহংকার: দুর্যোধন অত্যন্ত অহংকারী ছিল। সে পান্ডবদের একটি সুইয়ের ফুটো যতটুকু জমিও দিতে অস্বীকার করেছিল। তার এই স্বার্থপরতা এবং জেদ পান্ডব এবং কৌরবদের মধ্যে উত্তেজনার বড় কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল।

দ্রৌপদীর অপমান: দ্রৌপদীর অপমান মহাভারত যুদ্ধের একটি বড় কারণ ছিল। দ্রৌপদীকে জুয়ার মাধ্যমে দান করে এবং তারপর তার চীরহরণের চেষ্টা করা অধর্ম ছিল। এই অপমান পান্ডবদের মনে গভীর ক্ষোভ তৈরি করেছিল।

জুয়া খেলা এবং প্রতারণা: কৌরবরা পান্ডবদের জুয়ায় ফাঁসিয়ে প্রতারণা করেছিল। এর ফলে পান্ডবদের ১৩ বছর বনবাসে যেতে হয়েছিল। এই প্রতারণা এবং অন্যায় যুদ্ধের সবচেয়ে বড় কারণগুলির মধ্যে একটি ছিল।

রাজা ধৃতরাষ্ট্রের পুত্র প্রীতি: রাজা ধৃতরাষ্ট্র তার পুত্র দুর্যোধনের ভুলগুলি ঠেকাতে পারেননি। পুত্র প্রীতিতে সে অন্যায়কে উপেক্ষা করে চলেছিল, যার ফলে দুর্যোধন আরও নির্ভয়ে পান্ডবদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল।

ন্যায়বিচারের ব্যর্থতা: যখন সকল সমঝোতা এবং শান্তির প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছিল, তখন যুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়েছিল। ধর্ম এবং অধর্মের এই লড়াইয়ে অবশেষে সত্য এবং ন্যায়ের বিজয় হয়।

১৮-এর আধ্যাত্মিক বার্তা

মহাভারত শুধুমাত্র একটি যুদ্ধ ছিল না, বরং এটি জীবনের সংগ্রাম এবং পরীক্ষার প্রতীক। এতে ১৮ দিনের যুদ্ধ, ১৮ অধ্যায়ের ভগবদ্গীতা এবং ১৮ টি সেনা এই কথা বোঝায় যে, জীবনে যখন আমরা ধর্ম, সত্য এবং ন্যায়ের পথে চলি, তখন বড় বড় সংগ্রামও সীমিত সময়ের মধ্যে শেষ হতে পারে।

এই সংখ্যা ১৮ আমাদের শেখায় যে, কঠিন পরিস্থিতি যতই দীর্ঘ এবং কঠিন কেন না হোক, যদি আমরা সঠিক পথে থাকি এবং আমাদের ভেতরের শক্তি এবং ধৈর্য বজায় রাখি, তাহলে অবশেষে বিজয় আমাদের পদচিহ্ন ছুঁয়ে যাবে। তাই ১৮ এর এই আধ্যাত্মিক বার্তা হলো – সংগ্রামে ভয় পেও না, কারণ সঠিক দিকে প্রচেষ্টা সীমিত সময়ের মধ্যে সাফল্য এনে দেয়।

মহাভারত যুদ্ধে কি কি ঘটেছিল?

মহাভারতের যুদ্ধ কুরুক্ষেত্রের মাঠে ভয়াবহভাবে লড়াই করা হয়েছিল, যেখানে পান্ডব এবং কৌরবদের মধ্যে অনেক গুরুত্বপূর্ণ এবং ঐতিহাসিক ঘটনা ঘটেছিল। এই যুদ্ধে অনেক মহান যোদ্ধা অংশগ্রহণ করেছিলেন, যেমন অর্জুন, ভীম, দ্রৌপদী, কর্ণ, দুর্যোধন এবং ভীষ্ম। যুদ্ধের সময় অনেক কৌশল অবলম্বন করা হয়েছিল, যেমন অশ্বমেধ যজ্ঞ, অস্ত্র-শস্ত্রের ব্যবহার এবং গোপন সেনার কৌশল। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনের সারথি হিসেবে গীতার উপদেশ দিয়েছিলেন, যা যুদ্ধের মাঝেও একটি গভীর আধ্যাত্মিক বার্তা ছিল। যুদ্ধে ভীম দুর্যোধনের সাথে ভয়াবহ লড়াই করেছিলেন এবং অবশেষে দুর্যোধনকে পরাজিত করেছিলেন।

এই যুদ্ধে মোট ১৮ দিন ধরে রক্তপাত এবং প্রাণহানি হয়েছিল। অনেক প্রধান যোদ্ধা নিহত হয়েছিলেন, যার মধ্যে কর্ণ, দ্রোণাচার্য, ভীষ্ম এবং দুর্যোধন উল্লেখযোগ্য। অবশেষে পান্ডবদের বিজয় হয় এবং ধর্মের পুনঃপ্রতিষ্ঠা হয়। মহাভারতের যুদ্ধ শুধুমাত্র একটি শক্তি সংগ্রাম ছিল না, বরং এটি ধর্ম এবং অধর্মের লড়াই ছিল, যেখানে ন্যায় এবং সত্যের বিজয় হয়। এই যুদ্ধ থেকে অনেক সামাজিক এবং নৈতিক শিক্ষা আজও পাওয়া যায়।

মহাভারত যুদ্ধ শুধুমাত্র একটি ভৌত সংগ্রাম ছিল না, বরং ধর্ম, ন্যায় এবং সত্যের চূড়ান্ত পরীক্ষা ছিল। ১৮ দিনের এই যুদ্ধ জীবনের ভেতরের লড়াই এবং আত্মশুদ্ধির প্রতীক। এতে পাওয়া শিক্ষা আমাদের শেখায় যে, কঠিন পরিস্থিতির মধ্যেও সঠিক পথে থাকা উচিত, তাহলেই অবশেষে বিজয় এবং ভারসাম্য পাওয়া যাবে। यही মহাভারতের প্রকৃত বার্তা।

Leave a comment