সনাতন ধর্মে একাদশী ব্রতের বিশেষ স্থান রয়েছে। এই ব্রত কেবল আধ্যাত্মিক শুদ্ধিরই নয়, মানসিক ও শারীরিক শুদ্ধিরও পথ। প্রতি মাসে দুইবার আগমনকারী একাদশী তিথিকে ভগবান বিষ্ণুর আরাধনার শ্রেষ্ঠ দিন বলে মনে করা হয়। ২০২৫ সালে আষাঢ় মাসের যোগিনী একাদশী ও দেবশয়নী একাদশীর সময় নিকটবর্তী, যা চাতুর্মাসের সূচনা সহ ভক্তদের জীবনে নতুন শক্তি ও পুণ্য নিয়ে আসে।
যোগিনী একাদশী ২০২৫: মোক্ষ ও রোগমুক্তির পথ
যোগিনী একাদশী, আষাঢ় মাসের কৃষ্ণ পক্ষের একাদশী তিথিতে পালিত হয়। এই ব্রত বিশেষ করে রোগমুক্তি, পাপনাশ ও মোক্ষলাভের জন্য পালন করা হয়। শাস্ত্রে বর্ণিত আছে যে, এই দিন ব্রত রাখলে ৮৮ হাজার ব্রাহ্মণকে ভোজন করানোর সমান পুণ্য লাভ হয়। যারা জীবনে স্বাস্থ্য, সমৃদ্ধি ও আধ্যাত্মিক উন্নতি কামনা করেন তাদের জন্য এই ব্রত বিশেষ ফলদায়ক।
যোগিনী একাদশী ব্রতের তিথি ও মুহূর্ত (২০২৫)
- একাশী তিথি আরম্ভ: ২১ জুন ২০২৫ সকাল ০৭:১৮ টা
- একাশী তিথি সমাপ্তি: ২২ জুন ২০২৫ সকাল ০৪:২৭ টা
- ব্রত রাখার তিথি: ২১ জুন ২০২৫ (উদয় তিথি অনুযায়ী)
- পারণের সময়: ২২ জুন ২০২৫ সকালে সূর্যোদয়ের পর
যোগিনী একাদশী ব্রতের ধর্মীয় গুরুত্ব
বিশ্বাস করা হয় যে, যোগিনী একাদশী ব্রত পালনকারী ভক্তের জীবন থেকে দুঃখ, রোগ ও দারিদ্র্য দূর হয়। এই ব্রত বিশেষ করে তাদের জন্য শুভ বলে মনে করা হয় যাদের কুণ্ডলীতে গ্রহদোষ আছে অথবা যারা বারবার অসুস্থ হন। ভগবান বিষ্ণুর পূজার সাথে এই দিন ব্রতী ব্রতকথার পাঠ করেন এবং লক্ষ্মী নারায়ণের প্রতিমাকে জল, তুলসী, পুষ্প, ফল ও পঞ্চামৃত দিয়ে স্নান করিয়ে পূজন করেন।
এই একাদশীর সম্পর্ক শরীরের আধ্যাত্মিক শুদ্ধির সাথেও আছে। শাস্ত্রে এও বলা হয়েছে যে, যোগিনী একাদশী ব্রত পালনকারী ব্যক্তি জীবনে সংযম, ব্রহ্মচর্য ও সেবার পথে চলে, যার ফলে তিনি সাংসারিক সুখের সাথে সাথে মোক্ষও লাভ করেন।
যোগিনী একাদশী ব্রতের পূজা পদ্ধতি
- প্রাতঃকালে স্নান ও সংকল্প করুন: যোগিনী একাদশীর দিন সূর্যোদয়ের পূর্বে উঠে স্নান করুন। শুদ্ধ বস্ত্র পরিধান করুন এবং ঘরের পূজা স্থানটি গঙ্গাজল অথবা পরিষ্কার পানি দিয়ে পবিত্র করুন। তারপর ভগবান বিষ্ণু ও লক্ষ্মী দেবীর ধ্যান করে ব্রতের সংকল্প করুন – ‘আমি আজ যোগিনী একাদশী ব্রত পালন করছি, দয়া করে আমাকে শক্তি ও আশীর্বাদ দিন।’
- ভগবান বিষ্ণু ও লক্ষ্মী দেবীর মূর্তি অথবা ছবি স্থাপন করুন: পূজা স্থানে ভগবান বিষ্ণু ও মা লক্ষ্মীর মূর্তি অথবা ছবি রাখুন। তাঁদের সামনে দীপ ও আগরবাতি জ্বালান। হলুদ ফুল, তুলসী পাতা ও চন্দন অর্পণ করুন।
- ভোগ অর্পণ ও মন্ত্রজপ করুন: ভগবানকে ফল, মিষ্টি, পঞ্জিরী অথবা খির ইত্যাদি সাৎত্বিক ভোগ অর্পণ করুন। তারপর বিষ্ণুসহস্রনাম, ‘ॐ नमो भगवते वासुदेवाय’ অথবা ‘ॐ विष्णवे नमः’ মন্ত্রের জপ কমপক্ষে ১০৮ বার করুন।
- দিনভর উপবাস ও ভক্তি করুন: এই দিন ফলাহার করুন অথবা নির্জলা ব্রত রাখুন। দিনভর ভগবান বিষ্ণুর স্মরণ করুন, ধর্মগ্রন্থ পড়ুন এবং ভজন-কীর্তন করুন। কোনও দরিদ্রকে অন্ন, বস্ত্র অথবা দক্ষিণা দান করুন।
- রাত জাগ্রত ও পরের দিন পারণ করুন: রাতে জাগ্রত করুন এবং ভগবানের আরতি করুন। পরের দিন দ্বাদশী তিথিতে সূর্যোদয়ের পর ব্রতের পারণ করুন। প্রথমে কোনও দরিদ্রকে ভোজন করান অথবা গাভীকে খাবার দিন, তারপর নিজে ফলাহার করুন।
দেবশয়নী একাদশী ২০২৫:
দেবশয়নী একাদশী, আষাঢ় শুক্ল পক্ষের একাদশী তিথিতে পালিত হয়। এই একাদশী ভগবান বিষ্ণুর শয়ন (ঘুম) করার তিথি। একে ‘হরিশয়নী একাদশী’ অথবা ‘পদ্মা একাদশী’ও বলা হয়। এই দিন থেকে ভগবান বিষ্ণু চার মাসের জন্য ক্ষীরসাগরে যোগনিদ্রায় চলে যান, যাকে চাতুর্মাস বলা হয়। এই সময় বিবাহ, মুণ্ডন, গৃহপ্রবেশ ইত্যাদি শুভ কাজ করা হয় না।
দেবশয়নী একাদশী ব্রতের তিথি ও মুহূর্ত (২০২৫)
- একাশী তিথি আরম্ভ: ০৫ জুলাই ২০২৫ সন্ধ্যা ০৬:৫৮ টা
- একাশী তিথি সমাপ্তি: ০৬ জুলাই ২০২৫ সন্ধ্যা ০৯:১৪ টা
- ব্রত রাখার তিথি: ০৬ জুলাই ২০২৫ (সূর্যোদয় অনুযায়ী)
- পারণের সময়: ০৭ জুলাই সকালে সূর্যোদয়ের পর
দেবশয়নী একাদশীর গুরুত্ব
দেবশয়নী একাদশী কেবল একটি ব্রত নয়, বরং চার মাসের আধ্যাত্মিক অনুশাসনের সূচনা। এই ব্রত পালন করলে মানুষের সকল পাপ ক্ষয় হয় এবং সে ধর্ম, অর্থ, কাম ও মোক্ষের দিকে অগ্রসর হয়। ভগবান বিষ্ণুকে এই দিন বিশেষ মন্ত্র দিয়ে জাগ্রত করা হয়, হলুদ পুষ্প, তুলসী পাতা, পীতাভর বস্ত্র, ধূপ-দীপ দিয়ে পূজন করা হয়।
এই দিন ব্রতী বিশেষ করে বিষ্ণুসহস্রনামের পাঠ করেন। সাথে ‘ॐ नमो भगवते वासुदेवाय’ মন্ত্রের জপ করা অত্যন্ত ফলদায়ক বলে মনে করা হয়। এই ব্রত পালন করলে জীবনে স্থিরতা আসে এবং মানুষ সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা বিকশিত করে।
দেবশয়নী একাদশী ব্রতের পূজা পদ্ধতি
সকালে স্নান করে ব্রতের সংকল্প করুন: দেবশয়নী একাদশীর দিন ব্রহ্মমুহূর্তে উঠে স্নান করুন। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও সাৎত্বিক বস্ত্র পরিধান করুন। তারপর ঘরের পূজা স্থানের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা করুন এবং গঙ্গাজল ছিটিয়ে পবিত্র করুন। এরপর ভগবান বিষ্ণুর ধ্যান করে ব্রতের সংকল্প করুন – ‘আমি আজ দেবশয়নী একাদশী ব্রত পালন করছি, দয়া করে আমার উপর কৃপা বজায় রাখুন।’
ভগবান বিষ্ণু ও লক্ষ্মী দেবীর প্রতিষ্ঠা করুন: পূজা স্থানে ভগবান বিষ্ণু ও মা লক্ষ্মীর মূর্তি অথবা ছবি রাখুন। তাঁদের সামনে দীপ, আগরবাতি ও ধূপ জ্বালান। ভগবানকে হলুদ ফুল, তুলসী পাতা, চন্দন ও অক্ষত অর্পণ করুন। ভগবান বিষ্ণুকে হলুদ বস্ত্র ও শঙ্খ-চক্র অর্পণ করা শুভ বলে মনে করা হয়।
মন্ত্রজপ ও কথার শ্রবণ করুন: পূজনকালে ‘ॐ नमो भगवते वासुदेवाय’ মন্ত্রের জপ করুন। বিষ্ণুসহস্রনাম অথবা বিষ্ণুস্তুতির পাঠও করুন। সাথে দেবশয়নী একাদশীর ব্রতকথার শ্রবণ করুন অথবা অন্যদের শুনান। এই কথার শ্রবণ অত্যন্ত পুণ্যদায়ক।
ফলাহার ও উপবাস পালন করুন: পুরোদিন সাৎত্বিক আহারের পালন করুন। কেউ কেউ ফলাহার করেন আবার কেউ কেউ নির্জল ব্রতও পালন করেন। রসুন, পেঁয়াজ, তামসিক খাবার ও অন্ন থেকে বিরত থাকুন। দিনভর ভগবান বিষ্ণুর স্মরণ করুন, ভজন-কীর্তন করুন এবং মনে ইতিবাচক ভাব রাখুন।
রাত জাগ্রত ও পরের দিন ব্রত পারণ করুন: রাতে জাগ্রত করুন এবং ভক্তিভাব নিয়ে ভগবান বিষ্ণুর আরতি করুন। পরের দিন দ্বাদশী তিথির সূর্যোদয়ের পর ব্রতের পারণ করুন। প্রথমে কোনও ব্রাহ্মণ অথবা দরিদ্রকে ভোজন করান, তারপর নিজে ফলাহার করুন। এইভাবে ব্রতের সমাপ্তি শুভ ও পূর্ণ ফলদায়ক হয়।
চাতুর্মাস: সংযম, সাধনা ও সেবার কাল
দেবশয়নী একাদশী থেকে দেবোঠনী একাদশী (কার্তিক শুক্ল পক্ষ) পর্যন্ত চার মাসকে চাতুর্মাস বলে। এই কাল আধ্যাত্মিক সাধনা, তপ, ব্রত ও সংযমের প্রতীক। বিশ্বাস করা হয় যে, এই সময় ভগবান বিষ্ণু যোগনিদ্রায় থাকেন এবং ব্রহ্মান্ডের পরিচালনা ভগবান শিব করেন। এই কালে:
- মাংস, মদ্য, পেঁয়াজ-রসুন, তামসিক খাবার ত্যাগ করা উচিত
- অধিক সময় ভজন, কীর্তন, সৎসঙ্গ ও ধ্যানে ব্যয় করা উচিত
- কেউর নিন্দা, মিথ্যা, ক্রোধ ও আলস্য থেকে বিরত থাকা উচিত
যোগিনী ও দেবশয়নী একাদশী উভয়ই আধ্যাত্মিক উন্নতি, মানসিক শান্তি ও পাপমুক্তিদায়ক তিথি। ২০২৫ সালে এই দুটি একাদশী বিশেষ সংযোগ নিয়ে আসছে এবং সাধকদের জীবনে নবচেতনা ও ইতিবাচক শক্তির সংযোগের সুযোগ দিচ্ছে। চাতুর্মাসের সূচনা নিয়ে সংযম ও সাধনার এই কাল আমাদের জীবনকে আরও অনুশাসিত, পবিত্র ও শান্তিপূর্ণ করে তুলতে পারে। এমন অবস্থায় প্রত্যেক ব্যক্তির উচিত এই ব্রতগুলির সুযোগ গ্রহণ করে নিজের জীবনকে দিব্যতার দিকে অগ্রসর করা।