চক্রব্যূহে অভিমন্যুর বধ - মহাভারতের গল্প
কুরুক্ষেত্রে কৌরব ও পাণ্ডবদের মধ্যে ১৮ দিন ধরে তুমুল যুদ্ধ চলেছিল। একদিকে ধর্মের জন্য লড়ছিলেন পাণ্ডবরা, অন্যদিকে ছল-চাতুরি ও প্রতারণায় পারদর্শী কৌরবরা। তারা ছল করে যুদ্ধ জেতার জন্য একটি কৌশল তৈরি করে। তাদের পরিকল্পনা ছিল অর্জুনকে যুদ্ধের মধ্যে ব্যস্ত রেখে বাকি ভাইদের থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া এবং তারপর যুধিষ্ঠিরকে বন্দী করে যুদ্ধ জিতে নেওয়া। যুদ্ধ শুরু হলে, কৌরব সেনারা অর্জুনের সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে তাকে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে দূরে নিয়ে যায়। সেই সময়, গুরু দ্রোণাচার্য যুধিষ্ঠিরকে বন্দী করার জন্য চক্রব্যূহ রচনা করেন, অথচ পাণ্ডবদের মধ্যে শুধুমাত্র অর্জুনই জানতেন কিভাবে চক্রব্যূহ ভেদ করতে হয়।
অর্জুন দূরে চলে গেলে, গুরু দ্রোণাচার্য পাণ্ডবদের যুদ্ধের আহ্বান জানিয়ে বলেন, হয় যুদ্ধ কর, না হয় পরাজয় স্বীকার কর। যুদ্ধের নিয়ম অনুযায়ী যুদ্ধ করা জরুরি ছিল। যুদ্ধ না করলেও তারা হারতেন, আর যুদ্ধ করলেও হার নিশ্চিত ছিল। তখন ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির বুঝতে পারছিলেন না কি করবেন। ঠিক সেই সময়ে, ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরের সামনে এক যুবক এসে দাঁড়ায় এবং বলে, "কাকশ্রী, আমাকে চক্রব্যূহ ভেদ করে যুদ্ধ করার আশীর্বাদ করুন।" এই যুবক আর কেউ নন, অর্জুনের পুত্র অভিমন্যু। অভিমন্যুর বয়স তখন মাত্র ১৬ বছর, কিন্তু সবাই জানত যে তিনি যুদ্ধবিদ্যায় তার পিতার মতোই দক্ষ।
যুধিষ্ঠির অভিমন্যুকে নিষেধ করেন, কিন্তু অভিমন্যু রাজি হননি এবং বলেন, "আমি চক্রব্যূহ ভেদ করতে জানি। যখন আমি মায়ের গর্ভে ছিলাম, তখন বাবা মাকে চক্রব্যূহ ভেদ করার কৌশল বলেছিলেন। আমি তখন সেটি শিখেছিলাম। আমি সামনে থাকব এবং আপনারা সবাই আমার পেছন পেছন আসবেন।" উপায়ান্তর না দেখে যুধিষ্ঠির অভিমন্যুর কথা মেনে নেন এবং সবাই যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হন। অভিমন্যু সবার আগে ছিলেন এবং বাকিরা তার পিছনে। অভিমন্যুকে যুদ্ধক্ষেত্রে দেখে কৌরবরা ঠাট্টা করতে শুরু করে যে এই ছোট ছেলে কী যুদ্ধ করবে, কিন্তু যখন তারা অভিমন্যুর যুদ্ধ দক্ষতা দেখল, তখন তাদের ঘাম ছুটে গেল।
এগিয়ে গিয়ে অভিমন্যু দুর্যোধনের পুত্র লক্ষণকে হত্যা করে চক্রব্যূহে প্রবেশ করেন। তার চক্রব্যূহে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গেই সিন্ধুরাজ জয়দ্রথ চক্রব্যূহের দরজা বন্ধ করে দেন, যাতে বাকি চার ভাই প্রবেশ করতে না পারে। অভিমন্যু এগিয়ে যেতে থাকেন। তিনি একে একে সমস্ত যোদ্ধাদের পরাজিত করেন, যাদের মধ্যে স্বয়ং দুর্যোধন, কর্ণ এবং গুরু দ্রোণও ছিলেন। কেউই কোনো উপায় খুঁজে পাচ্ছিলেন না, তখন কৌরবদের সমস্ত মহারথীরা একসঙ্গে অভিমন্যুর ওপর হামলা করে।
কেউ তার ধনুক ভেঙে দেয়, আবার কেউ তার রথ। তা সত্ত্বেও অভিমন্যু থামেননি। তিনি রথের চাকা তুলে যুদ্ধ করতে শুরু করেন। বড় বড় মহারথীদের সঙ্গে বীর অভিমন্যু একা লড়তে থাকেন, কিন্তু তিনি একা আর কতক্ষণ লড়তে পারতেন। অবশেষে সবাই মিলে তাকে হত্যা করে এবং অভিমন্যু বীরগতি লাভ করেন। অভিমন্যুর মৃত্যুর পর অর্জুন প্রতিজ্ঞা করেন যে তিনি পরের দিন যুদ্ধে জয়দ্রথকে বধ করবেন। আজ বীর অভিমন্যুর নাম কর্ণ এবং অর্জুনের থেকেও আগে সম্মানের সঙ্গে নেওয়া হয়।