রামসেতু: আস্থা, ইতিহাস ও বিজ্ঞানের মেলবন্ধন

🎧 Listen in Audio
0:00

ভারতে রামসেতু (Adam’s Bridge) সর্বদাই আস্থা, ইতিহাস ও বিজ্ঞানের মধ্যে আলোচনার বিষয় হয়ে রয়েছে। এই সেতু ভারতের তামিলনাড়ুর রামেশ্বরম ও শ্রীলঙ্কার মান্নার দ্বীপের মধ্যে অবস্থিত। হিন্দু ধর্মীয় বিশ্বাস অনুসারে, এই সেতু ভগবান শ্রীরামের সেনাবাহিনী দ্বারা নির্মিত হয়েছিল, কিন্তু কি বিজ্ঞান এই দাবিকে সমর্থন করে? আসুন জেনে নেই এই ঐতিহাসিক স্থাপনার সাথে যুক্ত রহস্য ও বৈজ্ঞানিক গবেষণা সম্পর্কে।

ধর্মীয় বিশ্বাস: শ্রীরাম কর্তৃক নির্মিত দিব্য সেতু

রামায়ণ অনুসারে, ভগবান শ্রীরাম রাবণের কবল থেকে মা সীতাকে মুক্ত করার জন্য বানর সেনার সাথে শ্রীলঙ্কা যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। লঙ্কা পৌঁছানোর জন্য বানররাজ নল সমুদ্রের উপর একটি অসাধারণ সেতু নির্মাণ করেন, যাকে রামসেতু বলা হয়।
এই সেতু ভগবান শ্রীরামের বিজয় ও তাঁর দিব্যতার প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হয়। হিন্দু ধর্মে এটিকে আস্থার সাথে যুক্ত করা হয় এবং ভক্তরা এটিকে ঐশ্বরিক অলৌকিক ঘটনা বলে মনে করেন।

বৈজ্ঞানিক গবেষণা: কি রামসেতু মানবসৃষ্ট?

বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে রামসেতু নিয়ে বহু গবেষণা হয়েছে। নাসা (NASA) এবং ভারতীয় বৈজ্ঞানিক প্রতিষ্ঠানগুলি এই সেতুর উৎপত্তি বুঝতে বহু গবেষণা করেছে।

নাসার উপগ্রহ ছবি

• ২০০২ সালে নাসার একটি উপগ্রহ থেকে তোলা ছবিতে সমুদ্রের ভেতরে পাথরের একটি শৃঙ্খল দেখা গেছে, যা ভারত ও শ্রীলঙ্কার মধ্যে যুক্ত ছিল।
• এই পাথরগুলি একটি সেতু-সদৃশ গঠন তৈরি করে, যা হিন্দু গ্রন্থে বর্ণিত রামসেতুর সাথে মিলে যায়।

ভূতাত্ত্বিক গবেষণা কি বলে?

• ভারতীয় বিজ্ঞানী ও ভূতাত্ত্বিকদের গবেষণায় দেখা গেছে যে এই গঠনে চুনাপাথর এবং প্রবাল (coral) শিলা বিদ্যমান।
• আমেরিকান বিজ্ঞানীরা এই সেতুতে পাওয়া পাথরের বয়স ৭,০০০ থেকে ১৮,০০০ বছর পুরোনো বলে জানিয়েছে, যখন এই পাথর যে বালিতে রয়েছে সেটি তুলনামূলকভাবে নতুন।
• এটি ইঙ্গিত করে যে এই পাথরগুলি অন্য কোথাও থেকে এনে রাখা হতে পারে, যা এই যুক্তি দেয় যে এটি প্রাকৃতিক নয়, বরং কৃত্রিমভাবে তৈরি হতে পারে।

পুরাতত্ত্ববিদদের মতামত

কিছু ইতিহাসবিদ ও পুরাতত্ত্ববিদ মনে করেন যে এটি প্রাকৃতিকভাবে তৈরি চুনাপাথর শিলার সমষ্টি হতে পারে। অন্যদিকে, কিছু বিশেষজ্ঞ এটিকে মানবসৃষ্ট মনে করেন, কারণ এই ধরণের পাথর সমুদ্রের ওই অংশে পাওয়া অস্বাভাবিক।
ভারতীয় পুরাতত্ত্ব বিভাগ (ASI) অনুসারে, এই স্থাপনার নির্মাণ মানব প্রচেষ্টা দ্বারা করা হতে পারে, কিন্তু এটিকে প্রমাণ করার জন্য আরও বৈজ্ঞানিক প্রমাণের প্রয়োজন।

রামসেতু সম্পর্কিত আকর্ষণীয় তথ্য

সেতুর মোট দৈর্ঘ্য – প্রায় ৪৮ কিলোমিটার
গভীরতা – এই সেতু জলের তিন থেকে পাঁচ মিটার নিচে অবস্থিত
প্রথম উল্লেখ – বাল্মীকি রামায়ণ এবং অন্যান্য প্রাচীন গ্রন্থে
পৌরাণিক নাম – এটিকে "নল-সেতু"ও বলা হয়

কি সরকার রামসেতু সংরক্ষণ করবে?

ভারত সরকার এই ঐতিহাসিক ও ধর্মীয় ঐতিহ্যকে সংরক্ষণ করার বিষয়ে বিবেচনা করছে। ২০২১ সালে কেন্দ্রীয় সরকার সুপ্রিম কোর্টে জানিয়েছিল যে রামসেতুকে জাতীয় ঐতিহ্য হিসেবে ঘোষণা করার জন্য গবেষণা চলছে।
এছাড়াও, রামসেতুকে পর্যটন স্থান হিসেবে উন্নত করার পরিকল্পনা রয়েছে, যাতে আরও বেশি মানুষ এই ঐতিহাসিক স্থান সম্পর্কে জানতে পারে।

আস্থা ও বিজ্ঞানের সংমিশ্রণ

রামসেতু আজও ইতিহাস, ধর্ম ও বিজ্ঞানের সংমিশ্রণের সর্বোত্তম উদাহরণ হিসেবে বিদ্যমান। একদিকে এটি হিন্দু ধর্মে আস্থার প্রতীক, অন্যদিকে বৈজ্ঞানিক গবেষণা এই রহস্য উদ্ঘাটনের চেষ্টা করছে।

Leave a comment