রামায়ণের কাহিনীতে রাবণের মৃত্যু একটি মহাযুদ্ধের পর ঘটে, কিন্তু তার চেয়েও বেশি আকর্ষণীয় প্রশ্ন হলো তার শেষকৃত্য কে করেছিলেন এবং কেন? এই প্রশ্নটি প্রতিটি পাঠকের মনে উঠে আসে। রাবণের ছোট ভাই বিভীষণ প্রথমে তার দাহসংস্কার করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন, কিন্তু ভগবান শ্রীরামের বলার পর তিনি কী ও কেন করেছিলেন, সে বিষয়টি এই প্রবন্ধে বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। জেনে নিন রাবণের মৃত্যু, তার শেষ ক্ষণের অবস্থা, বিভীষণের প্রতিবাদ এবং শেষ পর্যন্ত শ্রীরামের শিক্ষা।
রাবণ: একজন মহান যোদ্ধা, পণ্ডিত ও অহঙ্কারী রাক্ষস
রাবণের নাম শুনলেই আমাদের মনে একই চিত্র ভেসে ওঠে—একজন দশশির, অত্যন্ত পরাক্রান্ত রাক্ষস, যিনি সীতা মা’কে অপহরণ করেছিলেন এবং ভগবান শ্রীরামের সাথে ভয়াবহ যুদ্ধ করেছিলেন। কিন্তু রাবণ শুধুমাত্র একজন খলনায়ক ছিলেন না, তিনি একজন প্রকান্ড পণ্ডিত, মহান সংগীতজ্ঞ, শিবভক্ত এবং অসীম শক্তিসম্পন্ন যোদ্ধাও ছিলেন। লঙ্কার রাজা রাবণ তার বুদ্ধিমত্তা এবং বলের জন্য পরিচিত ছিলেন, কিন্তু তার অহংকার এবং অধর্মই তার পতনের কারণ হয়েছিল।
রাবণের সবচেয়ে বড় ভুল ছিল—মা সীতার অপহরণ। এই ঘটনাই তাকে ধর্মের পথ থেকে বিচ্যুত করেছিল এবং শেষ পর্যন্ত তার ধ্বংসের কারণ হয়েছিল।
শ্রীরাম ও রাবণের যুদ্ধ: ধর্ম ও অধর্মের সরাসরি লড়াই
রামায়ণ অনুসারে, যখন রাবণ মা সীতাকে অপহরণ করে লঙ্কায় বন্দি করে রেখেছিলেন, তখন ভগবান শ্রীরাম বানর সেনার সাথে লঙ্কায় আক্রমণ করেন। এই যুদ্ধ প্রায় দশ দিন ধরে চলে। এটি ছিল শুধু দুই রাজার লড়াই নয়, বরং এটি ছিল ধর্ম ও অধর্ম, সদগুণ ও দুর্গুণের সংঘর্ষ।
যুদ্ধের সময় রাবণ বারবার পরাজিত হয়েছিল, কিন্তু প্রতিবারই তার শক্তি এবং মায়া তাকে আবার দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল। শেষ পর্যন্ত, দশমী তিথিতে ভগবান শ্রীরাম ব্রহ্মাষ্ট্র প্রয়োগ করে রাবণের নাভিতে আঘাত করেন। এটিই ছিল সেই স্থান যেখানে তার অমরত্বের শক্তি লুকিয়ে ছিল। যখনই সেই অস্ত্র লাগলো, রাবণ মাটিতে পড়ে গেল এবং তার জীবনের অবসান হলো।
রাবণের শেষ মুহূর্ত: যখন বেরিয়ে এল শ্রীরামের নাম
যুদ্ধে পরাজিত হওয়ার পর যখন রাবণ মাটিতে পড়ে ছিলেন, তখন তিনি জীবনের শেষ জ্ঞান লাভ করেছিলেন। এটি সেই সময় ছিল যখন তার সকল অহংকার, দ্বেষ এবং অধর্মের অবসান হয়েছিল। তার শেষ মুহূর্তে রাবণ ভগবান শ্রীরামের দিকে তাকিয়ে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা প্রকাশ করেছিলেন।
বিশ্বাস করা হয় যে মৃত্যুর সময় রাবণের মুখ থেকে "রাম" নাম বেরিয়ে এসেছিল। এটি দেখায় যে শেষ পর্যন্ত তিনি ভগবান শ্রীরামের রূপের জ্ঞান লাভ করেছিলেন এবং তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে ধর্মের পথে চলাই একমাত্র সত্য রাজা।
বিভীষণের প্রতিবাদ: কেন ভাইয়ের দাহসংস্কার করতে চাইছিলেন না
রাবণের মৃত্যুর পর প্রশ্ন উঠেছিল যে তার শেষকৃত্য কে করবে? রাবণের অধিকাংশ ভাই যুদ্ধে নিহত হয়েছিল, এবং শুধুমাত্র বিভীষণ বেঁচে ছিলেন। কিন্তু বিভীষণ স্পষ্টভাবে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন। তার বক্তব্য ছিল যে রাবণ ধর্মের বিরুদ্ধে কাজ করেছেন, তিনি একজন অত্যাচারী ও পাপী ছিলেন। যিনি নারীর অপহরণ করেছেন, নিজের অহংকারে পুরো পরিবার ও রাজ্যের ধ্বংস করে দিয়েছেন—এমন ব্যক্তির দাহসংস্কার তিনি করবেন না।
বিভীষণের এই সিদ্ধান্তটি খুবই কঠোর মনে হতে পারে, কিন্তু তিনি তার নীতির প্রতি অটল ছিলেন। তার বিশ্বাস ছিল যে কোনও রাজা যদি অধর্মের পথে চলে, তাহলে সে সম্মানের যোগ্য নয়, তিনি তার ভাইই হোক না কেন।
ভগবান শ্রীরামের শিক্ষা: মৃত্যুর পরও মানবতার পালন জরুরি
যখন বিভীষণ দাহসংস্কার করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন, তখন ভগবান শ্রীরাম তাকে বুঝিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন যে রাবণ একজন মহান পণ্ডিত ছিলেন। তিনি বেদ-শাস্ত্রের গভীর অধ্যয়ন করেছিলেন, তিনি শিবের পরম ভক্ত ছিলেন। শ্রীরাম এটাও বলেছিলেন যে যখন কোন প্রাণী মৃত্যুবরণ করে, তখন তার সকল পাপ শেষ হয়ে যায়।
শ্রীরাম বিভীষণকে এটা মনে করিয়ে দিয়েছিলেন যে একজন ভাইয়ের কর্তব্য হল তার ভাইয়ের শেষকৃত্য পূর্ণ করা, জীবনে তার সাথে যতই দূরত্ব বা মতবিরোধ থাকুক না কেন। তিনি বলেছিলেন যে এটি রাবণকে ক্ষমা করার এবং মানবতার পরিচয় দেওয়ার সময়।
শ্রীরামের এই কথা বিভীষণের অন্তরে ছুঁয়ে গেল এবং তিনি রাবণের শেষকৃত্য পূর্ণ রীতি-নীতি অনুযায়ী সম্পন্ন করলেন।
রাবণের দাহসংস্কার: সম্মান ও বিদ্যার অবসান
শেষ পর্যন্ত বিভীষণ তার বড় ভাই রাবণের দাহসংস্কার করেছিলেন। এই অনুষ্ঠানে ভগবান শ্রীরাম সহ সমস্ত বানর সেনা এবং লঙ্কার নাগরিকরা উপস্থিত ছিলেন। রাবণের শেষকৃত্যে তার সম্পূর্ণ জীবন—তার বুদ্ধিমত্তা, শক্তি, সংগীত, শিবভক্তি এবং ত্রুটি—সবকিছু একসাথে বিদায় নিল।
রাবণের অবসান শুধুমাত্র একজন রাজার অবসান ছিল না, বরং এটি ছিল এমন একটি বার্তা যে কেউ যতই জ্ঞানী বা পরাক্রান্ত হোক না কেন, যদি সে অধর্মের পথে চলে, তাহলে তার অবসান অবশ্যম্ভাবী।
রাবণ থেকে আমরা কী শিক্ষা পাই?
রাবণের কাহিনী শুধুমাত্র একটি পৌরাণিক কাহিনী নয়, বরং এটি আমাদের জীবনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা দেয়:
অহংকারের অবসান নিশ্চিত।
বিদ্যা ও শক্তি ততক্ষণ পর্যন্তই সার্থক যতক্ষণ না সেগুলি ধর্ম ও কল্যাণের জন্য ব্যবহৃত হয়।
পরিবার ও সম্পর্কের মর্যাদা বজায় রাখা জরুরি, অন্যথায় সেগুলি ধ্বংস হয়ে যায়।
মৃত্যুর পর ক্রোধ বা দ্বেষ পোষণ করা উচিত নয়, বরং ক্ষমা ও মানবতার পরিচয় দেওয়া উচিত।
রাবণের জীবন থেকে আমরা এটাও বুঝতে পারি যে জ্ঞান ও শক্তির সাথে যদি সংযম, নম্রতা ও ধর্ম না থাকে, তাহলে সে ব্যক্তি নিজের সাথে সাথে অন্যদেরও ধ্বংস করে দেয়।
রামায়ণের কাহিনীতে রাবণের অবসান ও তার দাহসংস্কার একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড়। এটি শুধুমাত্র একজন রাজার মৃত্যু ছিল না, বরং এটি ছিল একটি যুগের অবসান। বিভীষণ কর্তৃক রাবণের শেষকৃত্য এটা দেখায় যে মানুষকে তার ব্যক্তিগত অনুভূতির উপরে উঠে সমাজ ও ধর্মের নিয়ম মেনে চলতে হবে। ভগবান শ্রীরামের শিক্ষা আজও ততটাই প্রাসঙ্গিক—ক্ষমা, করুণা ও কর্তব্য পালনই সত্য ধর্ম।