জগন্নাথের অসুস্থতা: একটি আধ্যাত্মিক ও ঐতিহাসিক পরম্পরা

🎧 Listen in Audio
0:00

ভারতের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে অনেক এমন পরম্পরা আছে যা শুধুমাত্র ভক্তির সাথে যুক্ত নয়, তার পিছনে গূঢ় অনুভূতি ও গভীর আধ্যাত্মিক বার্তা লুকিয়ে আছে। এমনই একটি অসাধারণ ও হৃদয়স্পর্শী পরম্পরা হল—ভগবান জগন্নাথের অসুস্থ হওয়া।

পুরী (ওড়িশা)র জগন্নাথ মন্দিরের সাথে যুক্ত এই পরম্পরা প্রতি বছর জ্যৈষ্ঠ পূর্ণিমা থেকে শুরু হয়ে রথযাত্রা পর্যন্ত চলে। একে ‘অনাসর কাল’ বলা হয়। আসুন জেনে নিই স্নান পূর্ণিমা থেকে ভগবানের একান্তবাস এবং এরপর রথযাত্রা পর্যন্ত এই যাত্রা কতটা গভীরতা ও অনুভূতিপূর্ণ।

স্নান পূর্ণিমা: একটি বিশেষ ধর্মীয় অনুষ্ঠান

প্রতি বছর জ্যৈষ্ঠ মাসের পূর্ণিমায় ভগবান জগন্নাথ, তাঁর ভ্রাতা বলভদ্র ও বোন সুভদ্রাকে বিশেষভাবে স্নান করানো হয়। এই উৎসবকে ‘স্নান যাত্রা’ বা ‘স্নান পূর্ণিমা’ বলা হয়। এই দিন তিনটি দেব প্রতিমাকে মন্দিরের বাইরে আনা হয় যাতে সকল ভক্ত তাঁদের দর্শন করতে পারেন।

এরপর ভগবানদের ১০৮টি স্বর্ণ কলসে স্নান করানো হয়। এই কলসগুলিতে বিভিন্ন পবিত্র নদীর জল, চন্দন, ঘি, গোলাপজল, দই এবং ঔষধির মিশ্রণ থাকে। এই স্নান শুদ্ধিকরণ ও শরীরকে শীতল করার প্রতীক। স্নানের পর ভগবানদের রাজকীয় বস্ত্রে সজ্জিত করা হয়, কিন্তু এরপর ঘটে একটি অনন্য ঘটনা—ভগবান অসুস্থ হয়ে পড়েন।

অনাসর কাল: যখন ভগবান বিশ্রাম নেন

স্নান পূর্ণিমার পর, ভগবান ১৫ দিন একান্তবাসে থাকেন, যাকে ‘অনাসর’ বলা হয়। এই সময় মন্দিরের গর্ভগৃহের দ্বার বন্ধ থাকে এবং কেউই ভগবানের দর্শন পায় না। পুরোহিতরা ভগবানের সেবা করেন যেমন কোন রোগীর সেবা করা হয়। তাঁদের ঔষধি কাড়া, বিশেষ আহার ও বিশ্রাম দেওয়া হয়।

এই পরম্পরা যুগ যুগ ধরে চলে আসছে এবং একে গভীরভাবে বুঝতে হলে আমাদের সেই লোককথার দিকে তাকাতে হবে যেখানে ভক্ত ও ভগবানের পবিত্র সম্পর্ক উন্মোচিত হয়।

ভক্ত মাধব দাস ও ভগবানের সেবা

এই পরম্পরার পিছনে একটি অত্যন্ত ভাবুক করে দেওয়া কাহিনী প্রচলিত আছে। বলা হয়, পুরীতে মাধব দাস নামক একজন ভক্ত থাকতেন। তিনি ভগবান জগন্নাথের অনন্য ভক্ত ছিলেন এবং জীবিকার জন্য ভগবানের প্রসাদে নির্ভরশীল ছিলেন। একবার তিনি গুরুতরভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন, কিন্তু তবুও তিনি না ভগবানের সেবা ছাড়েন এবং না বৈদ্যের সাহায্য নেন।

লোকেরা তাঁকে বৈদ্যের কাছে যাওয়ার পরামর্শ দেন, কিন্তু তিনি বলেন, ‘যখন আমার সাথে নিজে ভগবান আছেন, তখন আমাকে কোন বৈদ্যের প্রয়োজন নেই।’ তাঁর অসুস্থতা বৃদ্ধি পায় এবং একদিন তিনি অচেতন হয়ে পড়েন। তখন নিজেই ভগবান জগন্নাথ তাঁর কাছে প্রকাশ হন এবং তাঁর সেবা করতে থাকেন।

মাধব দাস যখন সুস্থ হন এবং তাঁর বুঝতে পারেন যে নিজেই ভগবান তাঁর সেবা করছিলেন, তখন তিনি ভাববিভোর হয়ে ওঠেন। তিনি ভগবানকে জিজ্ঞাসা করেন, ‘প্রভু! আপনি আমার সেবা কেন করলেন?’ ভগবান হাসিমুখে বলেন, ‘আমি আমার ভক্তদের সাথে কখনো ছাড়ি না। তোমার কর্মের ফল তোমাকে ভোগ করতে হবে, কিন্তু যে অসুস্থতার ১৫ দিন বাকি ছিল, সেটা আমি নিজের উপর নিয়েছি।’

এই ঘটনা জ্যৈষ্ঠ পূর্ণিমায় ঘটেছিল। তখন থেকে প্রতি বছর ভগবান ১৫ দিনের জন্য অসুস্থ হন এবং ভক্তরা তাঁদের দেখতে পান না। এই একান্তবাসকেই ‘অনাসর কাল’ বলা হয়।

নয়ন উৎসব ও রথযাত্রা: অসুস্থতা থেকে মুক্তির উল্লাস

এই ১৫ দিনের পর ভগবান আবার সুস্থ হন এবং এর উৎসব ‘নয়ন উৎসব’ হিসেবে পালিত হয়। নয়ন মানে দৃষ্টি—এই দিন ভগবানের পুনরায় দর্শন হয় এবং পরের দিন শুরু হয় জগন্নাথ রথযাত্রা। এই যাত্রা আষাঢ় শুক্ল দ্বিতীয়ায় হয়, যাতে ভগবান জগন্নাথ, বলভদ্র ও সুভদ্রা তাঁদের বিশাল রথে চড়ে নগর ভ্রমণ করেন।

রথযাত্রার আয়োজন নিজেই একটি দিব্য অভিজ্ঞতা। ভক্তরা রথ টানার জন্য আগ্রহী থাকেন কারণ বিশ্বাস করা হয় যে রথ টানলে পাপ ক্ষয় হয় এবং মোক্ষ লাভ হয়।

আধ্যাত্মিক গুরুত্ব

ভগবান জগন্নাথের প্রতি বছর অসুস্থ হওয়া শুধুমাত্র একটি ধর্মীয় রীতি নয়, বরং গভীর আবেগগত ও আধ্যাত্মিক গুরুত্বের পরম্পরা। এটি আমাদের এই বার্তা দেয় যে ভগবান শুধুমাত্র পূজার বিষয় নন, বরং তাঁর ভক্তদের সুখ-দুঃখে সমানভাবে অংশীদার। যখন একজন ভক্ত সৎ মনে ভগবানের ভক্তি করে, তখন ভগবানও তার কষ্টকে নিজের মনে করেন। এই পরম্পরা আমাদের এটাও শেখায় যে ভক্তি শুধুমাত্র আরতি ও পূজায় সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি এমন একটি সম্পর্ক যেখানে ভগবান তাঁর ভক্তদের কষ্ট অনুভব করেন এবং তা নিজের উপর নেন। এর ফলে এই আস্থা দৃঢ় হয় যে সৎ হৃদয় থেকে করা প্রেম ও বিশ্বাস কখনো ব্যর্থ হয় না।

জগন্নাথ মন্দিরের এই পরম্পরা ভারতের সমৃদ্ধ ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। স্নান পূর্ণিমা, অনাসর কাল ও রথযাত্রা শুধুমাত্র ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়, বরং ভক্ত ও ভগবানের মধ্যে আধ্যাত্মিক সম্পর্কের নিদর্শন।

Leave a comment