দুর্গা অষ্টমী: শক্তির, সাহসের ও নারীশক্তির উৎসব

🎧 Listen in Audio
0:00

ভারতীয় সংস্কৃতিতে নবরাত্রির বিশেষ স্থান রয়েছে, যা শক্তির উপাসনার উৎসব। এই নয়দিবসীয় উৎসবের প্রতিটি দিন দেবী দুর্গার বিভিন্ন রূপকে উৎসর্গ করা হয়। এর মধ্যে অষ্টমী, যাকে মহাষ্টমীও বলা হয়, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং শুভ দিনগুলির একটি হিসেবে বিবেচিত হয়। এই দিনটি কেবল ধর্মীয় আস্থার প্রতীক নয়, বরং নারীশক্তি, সাহস এবং আত্মসম্মানের প্রতীকও বটে।

দুর্গা অষ্টমী শক্তির উপাসনার সেই দিব্য দিন, যখন ভক্তগণ দেবী দুর্গার মহিষাসুরমর্দিনী রূপের আরাধনা করেন এবং তাঁর কাছ থেকে শক্তি, জ্ঞান এবং রক্ষার আশীর্বাদ প্রার্থনা করেন। এই দিন কন্যাপূজন, হোম, জাগ্রত, এবং বিশেষ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ভক্তগণ দেবীর আহ্বান জানান।

দুর্গা অষ্টমীর পৌরাণিক গুরুত্ব

দুর্গা অষ্টমী-র সাথে যুক্ত সবচেয়ে প্রধান পৌরাণিক কাহিনী মহিষাসুর বধের সাথে সম্পর্কিত। দেবী পুরাণ অনুসারে, মহিষাসুর ছিলেন একজন অত্যন্ত বলশালী অসুর যিনি স্বর্গে আক্রমণ করে দেবতাদের পরাজিত করেছিলেন। তাঁর পরাজয়ে দুঃখিত হয়ে ব্রহ্মা, বিষ্ণু এবং শিব তাঁদের শক্তির সংযোগ করে দেবী দুর্গাকে উৎপন্ন করেছিলেন। দেবী দুর্গা নয় দিন ধরে যুদ্ধ করেছিলেন এবং অষ্টমী তিথিতে মহিষাসুরের বধ করে পৃথিবীকে আতঙ্ক থেকে মুক্ত করেছিলেন।

তাই অষ্টমীকে অশুভের উপর শুভের বিজয় এবং নারীশক্তির মহিমা হিসেবেও উদযাপন করা হয়। এই দিনটি দেবীর সাহস, বুদ্ধিমত্তা এবং অসাধারণ শক্তির প্রতীক।

দুর্গা অষ্টমীর তিথি ও সময়

দুর্গা অষ্টমী প্রতি বছর শারদীয় নবরাত্রির অষ্টম দিনে অর্থাৎ আশ্বিন মাসের শুক্ল পক্ষের অষ্টমী তিথিতে পালিত হয়। গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার অনুসারে এই দিনটি সাধারণত সেপ্টেম্বর বা অক্টোবরে পড়ে। কখনো কখনো অষ্টমী এবং নবমী তিথি একই দিনে পড়ে, যাকে মহাসংযোগ বলা হয় এবং এই দিনের ধর্মীয় গুরুত্ব আরও বেড়ে যায়।

দুর্গা অষ্টমীর প্রধান অনুষ্ঠান

  1. কন্যাপূজন (কন্যক পূজা)

এই দিনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং জনপ্রিয় অনুষ্ঠান। ২ থেকে ১০ বছর বয়সী কন্যাদের দেবী দুর্গার নয় রূপের প্রতীক হিসেবে শ্রদ্ধাভরে পূজা করা হয়। তাদের সম্মানের সাথে ভোজন করানো হয়, উপহার দেওয়া হয় এবং তাদের চরণ ধুয়ে আশীর্বাদ গ্রহণ করা হয়।

কন্যাপূজন ভারতীয় সমাজে নারী সম্মান, সমতা এবং শক্তির পরিচয়ের প্রতীক। এই প্রথাটি এই বার্তা দেয় যে নারীর মধ্যেই সৃষ্টি এবং ধ্বংস উভয়েরই শক্তি রয়েছে।

  1. মহাস্নান এবং সংকল্প

অষ্টমী তিথিতে ভক্তগণ প্রাতঃকালে স্নান করে পবিত্র বস্ত্র পরিধান করেন এবং ব্রতের সংকল্প গ্রহণ করেন। এই ব্রত আত্মশুদ্ধি এবং মানসিক একাগ্রতার জন্য পালন করা হয়।

  1. হোম এবং পূজন

দুর্গা সপ্তশতী, চণ্ডী পাঠ এবং নবদুর্গা স্তোত্র পাঠ করে হোম করা হয়। এই হোমে বিশেষ উপাদান, যেমন যব, তিল, ঘি, চন্দন এবং পুষ্পাদি অর্পণ করা হয়। এই পূজা নেতিবাচক শক্তিকে দূর করে ইতিবাচকতা আহ্বান করে।

  1. ভান্ডার এবং প্রসাদ বিতরণ

অনেক জায়গায় এই দিন ভান্ডারের আয়োজন করা হয়, যেখানে সকল ভক্তদের মায়ের দুর্গার প্রসাদ খাওয়ানো হয়। এটাকে সাংঝা ভোজনও বলা হয় এবং এটি সামাজিক সম্প্রীতির প্রতীক হিসেবে পরিগণিত হয়।

অষ্টমী ব্রতের গুরুত্ব

অষ্টমীর ব্রত বিশেষ করে নারীরা পালন করেন, কিন্তু পুরুষরাও শ্রদ্ধা ও আস্থার সাথে এটি পালন করেন। এই ব্রত কেবল ধর্মীয় নয়, বরং আধ্যাত্মিক আত্মশুদ্ধির মাধ্যমও বটে। মনে করা হয় যে যে ব্যক্তি অষ্টমীর ব্রত পালন করে, তিনি দেবী দুর্গার বিশেষ কৃপা লাভ করেন এবং জীবনের দুঃখ থেকে মুক্তি পান।

দুর্গা অষ্টমীর সাংস্কৃতিক রূপ

ভারত বিভিন্নতায় ঐক্যের দেশ এবং দুর্গা অষ্টমী সমগ্র ভারতে বিভিন্ন রূপে পালিত হয়:

পশ্চিমবঙ্গ

এখানে দুর্গাপূজার বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে এবং অষ্টমীকে সবচেয়ে পবিত্র দিন হিসেবে বিবেচনা করা হয়। মানুষ নতুন পোশাক পরে, প্যান্ডালে বিশেষ পূজা হয় এবং সিন্দুর খেলা প্রভৃতি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।

উত্তর ভারত

উত্তরপ্রদেশ, বিহার, দিল্লি, পাঞ্জাব এবং হরিয়ানায় কন্যাপূজন এবং জাগ্রতের আয়োজন প্রচলিত। ঘরে ঘরে দেবীর প্রতিষ্ঠা হয় এবং সুন্দরকান্ড ও দুর্গা সপ্তশতীর পাঠ করা হয়।

গুজরাট

এখানে অষ্টমী তিথিতে গরবা এবং ডাণ্ডিয়ার রঙিন আয়োজন হয়। নবরাত্রির নয় দিন ধরে মানুষ রাত জেগে নৃত্য করে এবং দেবীর চরণে ভক্তি অর্পণ করে।

দক্ষিণ ভারত

এখানে দেবীকে বিভিন্ন রূপে পূজা করার প্রথা রয়েছে। বিশেষ করে সরস্বতী পূজার আয়োজন করা হয়, যেখানে শিশুরা বই এবং বাদ্যযন্ত্রের পূজা করে।

দুর্গা অষ্টমী এবং নারী সবলীকরণ

দুর্গা অষ্টমী কেবল ধর্মীয় অনুষ্ঠানের দিন নয়, এটি আমাদের নারীশক্তির স্মরণ করিয়ে দেয়। যেমন দেবী দুর্গা অন্যায়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন, তেমনি এই উৎসব নারীদের তাদের অধিকার এবং আত্মশক্তির প্রতি সচেতন করে তোলে।

আজকের যুগে যখন নারীরা প্রতিটি ক্ষেত্রে এগিয়ে যাচ্ছেন—শিক্ষা, বিজ্ঞান, রাজনীতি, প্রতিরক্ষা—তখন দুর্গা অষ্টমীর বার্তা আরও প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। এই দিনটি এই অনুপ্রেরণা দেয় যে নারী কখনো দুর্বল নয়, বরং তিনি সৃষ্টি এবং শক্তির প্রতীক।

দুর্গা অষ্টমী-র সাথে যুক্ত বিশেষ মন্ত্র

  • যা দেবী সর্বভূতেষু শক্তিরূপেণ সংস্থিতা। নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নমঃ॥
  • এই পবিত্র মন্ত্র দেবীর সেই রূপকে উৎসর্গ করা হয়েছে, যা সকল প্রাণীতে শক্তির রূপে বিদ্যমান। এই শ্লোক মা'র সর্বব্যাপকতা এবং তাঁর শক্তিশালী উপস্থিতিকে প্রণাম করে।
  • সর্বমঙ্গল মাঙ্গল্যে শিবে সর্বার্থ সাধিকে। শরণ্যে ত্র্যম্বকে গৌরী নারায়ণী নমোঃস্তুতে॥
  • এই মন্ত্রের মাধ্যমে মা দুর্গার কাছে জীবনের কল্যাণ, সুখ-শান্তি এবং সুরক্ষার প্রার্থনা করা হয়। এই স্তুতি তাঁর করুণাময়ী, মঙ্গলময়ী এবং রক্ষাকারী রূপকে উৎসর্গ করা হয়েছে।
  • যা দেবী সর্বভূতেষু শক্তিরূপেণ সংস্থিতা। নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নমঃ॥
  • এই পবিত্র মন্ত্র দেবীর সেই রূপকে উৎসর্গ করা হয়েছে, যা সকল প্রাণীতে শক্তির রূপে বিদ্যমান। এই শ্লোক মা'র সর্বব্যাপকতা এবং তাঁর শক্তিশালী উপস্থিতিকে প্রণাম করে।
  • সর্বমঙ্গল মাঙ্গল্যে শিবে সর্বার্থ সাধিকে। শরণ্যে ত্র্যম্বকে গৌরী নারায়ণী নমোঃস্তুতে॥
  • এই মন্ত্রের মাধ্যমে মা দুর্গার কাছে জীবনের কল্যাণ, সুখ-শান্তি এবং সুরক্ষার প্রার্থনা করা হয়। এই স্তুতি তাঁর করুণাময়ী, মঙ্গলময়ী এবং রক্ষাকারী রূপকে উৎসর্গ করা হয়েছে।

দুর্গা অষ্টমী কেবল ব্রত, পূজা এবং অনুষ্ঠানের উৎসব নয়, এটি আত্মশক্তি, নারী সম্মান, সামাজিক সম্প্রীতি এবং আধ্যাত্মিক জাগ্রতির প্রতীক। এটি আমাদের শিক্ষা দেয় যে জীবনে যতই কঠিনতা থাকুক না কেন, যদি আমাদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস এবং শক্তি থাকে, তাহলে আমরা প্রতিটি সংকটকে অতিক্রম করতে পারি।

আসুন, এই দুর্গা অষ্টমীতে আমরা কেবল দেবীর পূজা না করে, বরং তাঁর গুণাবলীকেও আত্মস্থ করি—সাহস, করুণা, ধৈর্য্য এবং ন্যায়প্রিয়তাকে আমাদের জীবনে প্রয়োগ করি।

Leave a comment