হনুমানজির অজানা ১০টি বিস্ময়কর তথ্য

🎧 Listen in Audio
0:00

ভগবান হনুমানজিকে সংকটমোচন, বজরঙ্গবলী এবং মারুতি নন্দন ইত্যাদি নানা নামে পরিচিত। তিনি হিন্দু ধর্মের অত্যন্ত পূজ্য দেবতা, যিনি শক্তি, ভক্তি এবং সমর্পণের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত। তাঁর সম্পর্কে যত বেশি জানা যায়, ততই তাঁর মহিমা ও রহস্যের আলো ছড়িয়ে পড়ে। আজ আমরা আপনাদের ভগবান হনুমানের সাথে জড়িত ১০টি এমন বিশেষ ও কম জানা তথ্য জানাবো, যা জানার পর আপনার ভক্তি ও শ্রদ্ধা আরও গভীর হবে।

হনুমানজি ভগবান শিবের এগারোতম অবতার

হনুমানজিকে ভগবান শিবের এগারোতম অবতার বলে মনে করা হয়। হিন্দু ধর্মের বিশ্বাস অনুসারে, হনুমানজিকে রুদ্রাবতারও বলা হয়, কারণ তিনি ভগবান শিবের শক্তিশালী ও বীর রূপ। বলা হয়, ভগবান শিব ভগবান রামের সেবা করার জন্য নিজেই হনুমানজির রূপে পৃথিবীতে অবতরণ করেছিলেন। তাই হনুমানজির মধ্যে শিবের অসীম শক্তি ও বল বর্তমান। यही কারণে হনুমানজিকে অত্যন্ত বলশালী, নির্ভয় এবং ভক্তির প্রতীক হিসেবে পূজা করা হয়। তাঁর ভক্তি ও শক্তির বর্ণনা সকল ধর্মগ্রন্থে পাওয়া যায়।

হনুমানজির স্ত্রী কে ছিলেন?

অনেক কম লোক জানেন যে হনুমানজির স্ত্রীও ছিলেন। পুরাণে বলা হয়েছে যে হনুমানজির বিবাহ সূর্যদেবের কন্যা সুবর্চলা দেবীর সাথে হয়েছিল। এই বিবাহ অত্যন্ত বিশেষ ও দিব্য ছিল, কারণ সুবর্চলা দেবীর সাথে যুক্ত হওয়ার পর হনুমানজির শক্তি ও তেজ আরও বৃদ্ধি পেয়েছিল। এই বিবাহকে ভগবান হনুমানের শক্তি ও ভক্তির একটি সুন্দর প্রতীক বলে মনে করা হয়। তাই হনুমানজি কেবলমাত্র একজন বীর যোদ্ধা ছিলেন না, বরং তাঁর স্ত্রীর সাথে তাঁর জীবনও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এই বিষয়টি তাঁর মহিমা ও দৈব রূপকে আরও গভীর করে তোলে।

হনুমানজির পাঁচ ভাই কারা ছিলেন?

হনুমানজির পাঁচ ভাই ছিলেন, যাদের নাম ছিল শ্রুতিমান, গতিমান, মতিমান, কেতুমান এবং ধৃতিমান। এরা সকলেই হনুমানজির মতো অত্যন্ত বীর, তেজস্বী এবং বুদ্ধিমান ছিলেন। পুরাণে বলা হয়েছে যে এরা সকলেই ভগবান হনুমানের পরিবারের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছিলেন এবং তাঁর মতোই গুণাবলী সম্পন্ন ছিলেন। এই ভাইদের জীবন ও কাজও হনুমানজির মতো বীরত্ব ও ধর্মপালনে পূর্ণ ছিল। তাই তাদেরকেও হনুমানজির সমান শক্তি ও সম্মান দেওয়া হয়।

হনুমানজির পুত্রের নাম কী ছিল?

হনুমানজির পুত্রের নাম ছিল মকরধ্বজ। একটি বিশেষ কথার अनुसार, যখন হনুমানজি লঙ্কার যুদ্ধের সময় অত্যন্ত পরিশ্রম করছিলেন, তখন তাঁর ঘাম থেকে মকরধ্বজের জন্ম হয়েছিল। মকরধ্বজও তাঁর পিতার মতো অত্যন্ত বীর ও শক্তিশালী যোদ্ধা ছিলেন। তিনিও সংকট দূরকারী হিসেবে বিবেচিত এবং তাঁর বীরত্বে সকলের সম্মান অর্জন করেছিলেন। মকরধ্বজের কাহিনী হনুমানজির মহিমা আরও বৃদ্ধি করে।

হনুমানজির গদার নাম ও তাঁর বিশেষত্ব

হনুমানজির গদার নাম ‘কৌমোদকী’ ছিল, যা ধনের দেবতা কুবের হনুমানজিকে দিয়েছিলেন। এই গদা কেবলমাত্র একটি অস্ত্র নয়, বরং একটি বিশেষ দিব্য শক্তির প্রতীক। কৌমোদকী গদায় এত শক্তি ছিল যে হনুমানজি তা তাঁর বিরোধীদের উপর আঘাত করে বড় বড় শত্রুদের সহজেই পরাজিত করতে পারতেন। এই গদার কারণে হনুমানজি অনেক যুদ্ধে বিরাট সাফল্য পেয়েছিলেন এবং তাঁর ভক্তদের রক্ষা করেছিলেন। তাই এই গদা হনুমানজির শক্তি ও সাহসের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ বলে মনে করা হয়।

হনুমানজি তাঁর আঙ্গুলে গোবর্ধন পর্বত তুলেছিলেন

পুরাণ অনুসারে, যখন ভগবান কৃষ্ণ তাঁর ভক্ত ও গোকুলবাসীদের বন্যার হাত থেকে রক্ষা করার জন্য গোবর্ধন পর্বতকে তাঁর ছোট হাতে তুলে ধরেছিলেন, ঠিক তখনই হনুমানজিও তাঁর আঙ্গুলে এই বিশাল পর্বত তুলে ধরেছিলেন। এই ঘটনা হনুমানজির অপার শক্তি, সাহস ও সহনশীলতার পরিচয় দেয়। তাঁর এই শক্তির কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল না, এবং এ ধরনের কীর্তি তাঁর দিব্য মহিমাকে আরও বাড়িয়ে তোলে। হনুমানজির এই শক্তি আমাদের শিক্ষা দেয় যে সত্যিকারের বিশ্বাস ও ভক্তিতে অসম্ভব কাজও সম্ভব হয়।

হনুমানজির পঞ্চমুখী রূপ সম্পর্কে জানুন

হনুমানজির পঞ্চমুখী রূপ অত্যন্ত বিশেষ ও শক্তিশালী বলে মনে করা হয়। এই রূপে তাঁর পাঁচটি মুখ থাকে, যা বিভিন্ন দিকের রক্ষা করে এবং বিভিন্ন শক্তির প্রতীক। প্রথম মুখ হনুমানের নিজের মুখ, যা পূর্ব দিকে মুখোমুখি এবং তাঁর বীরত্ব ও শক্তির পরিচয় দেয়। দ্বিতীয় মুখ গরুড়ের, যা পশ্চিম দিকে মুখোমুখি এবং মন্দ শক্তি থেকে রক্ষা করে। তৃতীয় মুখ বরাহের, যা উত্তর দিকে মুখোমুখি এবং সমৃদ্ধি ও সুরক্ষার প্রতীক। চতুর্থ মুখ নৃসিংহের, যা দক্ষিণ দিকে মুখোমুখি এবং অত্যন্ত ক্রোধী শত্রুদের বিনাশ করে। পঞ্চম মুখ হয়গ্রীভের, যা আকাশের দিকে মুখোমুখি এবং জ্ঞান ও বুদ্ধির প্রতিনিধিত্ব করে। এই পঞ্চমুখী রূপ হনুমানজির বিভিন্ন শক্তি ও তাঁর দিব্য রূপকে প্রকাশ করে, যা ভক্তদের জন্য অত্যন্ত পূজ্য।

হনুমানজি কলযুগে কোথায় থাকেন?

হনুমানজিকে অমরত্বের বরদান প্রাপ্ত হয়েছে, তাই তিনি আজও এই পৃথিবীতে জীবিত আছেন এবং আমাদের মাঝে উপস্থিত আছেন। মনে করা হয় যে হনুমানজি কলযুগে গন্ধমাধন পর্বতে বাস করেন, যা কৈলাস পর্বতের উত্তর দিকে অবস্থিত একটি পবিত্র ও রহস্যময় স্থান। এই পর্বতকে ভগবান হনুমানের শক্তি ও আশীর্বাদের কেন্দ্র বলে মনে করা হয়। এখান থেকে তিনি তাঁর ভক্তদের রক্ষা করেন এবং তাঁদের মনোকামনা পূর্ণ করেন। ভক্তগণ এই স্থানকে অত্যন্ত পবিত্র মনে করেন এবং হনুমানজির প্রতি শ্রদ্ধা ও ভক্তির কারণে তাঁর কৃপা লাভের আশা করেন। এইভাবে, হনুমানজির গন্ধমাধন পর্বতে বসবাস কলযুগে তাঁর উপস্থিতি ও শক্তির প্রতীক।

হনুমানজির নয় নিধি কী কী?

হনুমানজির নয় নিধি তাঁর অপার সম্পদ ও দিব্যতার প্রতীক। এই নিধিগুলির নাম হল—মহাপদ্ম নিধি, পদ্মা নিধি, মুকুন্দ নিধি, নন্দ নিধি, মকর নিধি, কচ্ছপ নিধি, শঙ্খ নিধি, কুণ্ড নিধি এবং খারব নিধি। প্রতিটি নিধির নিজস্ব বিশেষ ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক গুরুত্ব আছে। এই নিধিগুলি ভক্তদের রক্ষা করে এবং জীবনে সুখ, সমৃদ্ধি ও ইতিবাচক শক্তি প্রদান করে। মনে করা হয় যে হনুমানজির এই নিধিগুলির কারণে তাঁর ভক্তরা বিপদ থেকে মুক্তি পায় এবং সকল কঠিন পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ করে। তাই হনুমানজির পূজা-অর্চনায় এই নিধিগুলিরও বিশেষ স্থান আছে, যা তাঁর দিব্য শক্তি ও আশীর্বাদের পরিচয় দেয়।

হনুমানজির আটটি সিদ্ধি

হনুমানজিকে আটটি মহান সিদ্ধি প্রাপ্ত হয়েছে, যা তাঁর অদ্ভুত ও দিব্য শক্তি প্রকাশ করে। এই আটটি সিদ্ধির মধ্যে আছে অণিমা, যার অর্থ যেকোনো বস্তু বা জীবের সবচেয়ে ক্ষুদ্র রূপ ধারণ করা। মহিমা বলতে বোঝায় অত্যন্ত বৃহৎ বা মহান হওয়া। গরিমা থেকে হনুমানজির গম্ভীরতা ও প্রভাবশালী উপস্থিতি বোঝা যায়। লাঘিমা বলতে বোঝায় কম ভারী বা হালকা হওয়া, যার ফলে তিনি সহজেই উড়তে পারেন। প্রাপ্তি সিদ্ধি অনুসারে তিনি ইচ্ছানুযায়ী যেকোনো বস্তু পেতে পারেন। প্রাকাম্য বলতে বোঝায় मन মতো যেকোনো কাজ সম্পন্ন করা। ঈশিত্ব বলতে বোঝায় নিজের উপর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ও অধিকার রাখা, এবং বশীত্ব বলতে বোঝায় অন্যদের উপর নিয়ন্ত্রণ রাখা। এই সকল সিদ্ধি হনুমানজির অসীম শক্তি ও মহিমাকে প্রকাশ করে, যা তাঁকে প্রতিটি কঠিন পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ করতে সাহায্য করে।

জ্যৈষ্ঠ মাসে হনুমানজির পূজার বিশেষ গুরুত্ব

জ্যৈষ্ঠ মাস হিন্দু ধর্মে অত্যন্ত পবিত্র ও গুরুত্বপূর্ণ মাস বলে মনে করা হয়। এই মাসের মঙ্গলবার ভক্তদের জন্য অত্যন্ত শুভ বলে মনে করা হয়। মনে করা হয় যে এই দিন হনুমানজির পূজা-অর্চনা করলে তাঁর কৃপা ও আশীর্বাদ লাভ হয়, যা জীবনের সকল কষ্ট দূর করে। জ্যৈষ্ঠ মাসের মঙ্গলবার ভগবান হনুমানের বিশেষ পূজার গুরুত্ব আরও বেড়ে যায় কারণ এই দিনকে তাঁর ও প্রভু শ্রীরামের প্রথম দেখা করার দিন হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এই কারণে এই দিন ভক্তদের কাছে অত্যন্ত বিশেষ ও শুভ বলে মনে করা হয়।

এই দিনকে ‘বুড়ো মঙ্গল’ নামেও জানা যায়, কারণ জ্যৈষ্ঠের মঙ্গলবার হনুমানজির বৃদ্ধ রূপের পূজাও করা হয়। এই পূজার সময় ভক্তগণ হনুমানজির দীর্ঘায়ু, শক্তি এবং তাঁর অদ্ভুত সাহসের জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। ‘বুড়ো মঙ্গল’ পূজার দ্বারা ব্যক্তির জীবনে স্থায়িত্ব, শক্তি ও মানসিক শান্তির আগমন ঘটে। তাই জ্যৈষ্ঠ মাসের এই মঙ্গল দিবস হনুমান ভক্তরা বড় শ্রদ্ধা ও ভক্তির সাথে পালন করেন।

ভগবান হনুমান কেবলমাত্র একজন মহাবলী যোদ্ধা নন, বরং তিনি ভক্তদের সংকটমোচন ও জীবনের প্রতিটি কষ্ট দূরকারী দেবতাও। তাঁর অবতার, পরিবার, শক্তি ও রহস্য জানা আমাদের জন্য ভক্তির সাগর। তাঁর পূজা ও আশীর্বাদে জীবনে শক্তি, সাহস ও সমৃদ্ধি আসে। এ কারণেই জ্যৈষ্ঠের মঙ্গলবার তাঁর বিশেষ পূজা করা অত্যন্ত শুভ বলে মনে করা হয়।

Leave a comment