৪০০০ কিলোমিটার ভেতরে ড্রোন আক্রমণে রাশিয়ার ৪১টি বোমারু বিমান ধ্বংস, প্রতিশোধের আশঙ্কা, তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের আলোচনা তীব্র।
রাশিয়া-ইউক্রেন: ইউক্রেনের সাম্প্রতিক ড্রোন আক্রমণে রাশিয়ার সামরিক বাহিনী ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ৪০-এরও বেশি দীর্ঘ পাল্লার বোমারু বিমান ধ্বংস হয়েছে, যা রাশিয়ার সামরিক সুনামকে ব্যাপক আঘাত করেছে। এই আক্রমণের পর এখন পুরো বিশ্ব ভাবছে, রাশিয়া কি এর প্রতিশোধে ব্যাপক সামরিক অভিযান চালাবে এবং কি এই উত্তেজনা তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধে রূপান্তরিত হবে? এই প্রবন্ধে আমরা এই যুদ্ধের বর্তমান অবস্থা, রাশিয়ার সম্ভাব্য পদক্ষেপ এবং বিশ্ব রাজনীতিতে এর প্রভাব বুঝতে চেষ্টা করব।
ইউক্রেনের ড্রোন আক্রমণ এবং রাশিয়ার ক্ষতি
১লা জুন ২০২৫-এ ইউক্রেন রাশিয়ার ভেতরে প্রায় ৪০০০ কিলোমিটার পর্যন্ত ঢুকে ব্যাপক ড্রোন আক্রমণ চালিয়েছে। এই অভিযানকে ইউক্রেন ‘স্পাইডারওয়েব’ নাম দিয়েছে। এই আক্রমণে রাশিয়ার পাঁচটি বৃহৎ এয়ারবেস—বেলায়া, ড্যাগিলেভো, ইভানোভো, ওলেনিয়া এবং অন্যান্য কয়েকটি স্থানে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ হয়েছে। ইউক্রেনের গোয়েন্দা সংস্থা SBU দাবি করেছে যে এই আক্রমণে রাশিয়ার ৪১টি দীর্ঘ পাল্লার বোমারু বিমান ধ্বংস হয়েছে, যার জ্বলন্ত ছবি মিডিয়ায় প্রকাশিত হয়েছে। এই আক্রমণে রাশিয়ার প্রায় ৭ বিলিয়ন ডলার ক্ষতি হয়েছে।
রাশিয়ার সামরিক গৌরব এবং বর্তমান অবস্থা
এই আক্রমণ রাশিয়ার সামরিক সম্পদের ক্ষয়ক্ষতির দিক থেকে এ পর্যন্ত সবচেয়ে বড় ড্রোন আক্রমণ বলে মনে করা হচ্ছে। রাশিয়া এই আক্রমণকে ‘অভূতপূর্ব উসকানি’ বলে আখ্যায়িত করেছে। ক্রেমলিন স্পষ্ট সংকেত দিয়েছে যে রাষ্ট্রপতি ভ্লাদিমির পুতিন এর কঠোর প্রতিশোধ নেবেন। লক্ষণীয় বিষয় হল, এই আক্রমণ ইস্তাম্বুলে ২রা জুন প্রস্তাবিত শান্তি আলোচনার ঠিক আগে ঘটেছে, যার ফলে শান্তি আলোচনার উপরও প্রভাব পড়েছে।
ইউক্রেনের বড় সামরিক ঝুঁকি
সাড়ে তিন বছর ধরে চলা এই যুদ্ধে गतिरोध ভাঙার জন্য ইউক্রেন সাহসী পদক্ষেপ নিয়েছে। যদিও এর আগেও ইউক্রেন রাশিয়ার ভেতরে আক্রমণ করেছে, তবে তাতে সাফল্য সীমিত ছিল। ২০২২ সালে খারকিভ এবং খেরসনে চালানো আক্রমণ সফল বলে মনে করা হয়েছিল, কিন্তু এর বিনিময়ে রাশিয়া ইউক্রেনের অনেক অঞ্চলে দখল করে নিয়েছে। ২০২৪ সালে ইউক্রেন রাশিয়ার কুরস্ক অঞ্চলে পদ দখল করার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু পিছু হটতে হয়েছিল। এই নতুন ড্রোন আক্রমণকে নতুন মোড় হিসেবে দেখা হচ্ছে, যার প্রভাব রাশিয়ার প্রতিশোধমূলক আক্রমণে দেখা যাবে।
এখন পুতিন কি করতে পারেন?
ইউক্রেনের এই ব্যাপক ড্রোন আক্রমণের পর রাশিয়ার প্রতিক্রিয়া গুরুত্বপূর্ণ হবে। পুতিনের সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়ার মধ্যে ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র, হাইপারসোনিক ক্ষেপণাস্ত্র যেমন Kinzhal অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে। রাশিয়ার কাছে Yars নামে অত্যাধুনিক পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্রও রয়েছে, যা মাল্টিপল ইন্ডিপেন্ডেন্টলি টার্গেটেবল রি-এন্ট্রি ভেহিকল (MIRV) বহন করতে সক্ষম। প্রতিটি MIRV-এ একটি থার্মোনিউক্লিয়ার ওয়ারহেড থাকে।
তবে, বিশ্বব্যাপী ধ্বংসের আশঙ্কার কারণে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের সম্ভাবনা এখনও কম বলেই মনে করা হচ্ছে। এই সময় রাশিয়ার মনোযোগ ইউক্রেনের সামরিক এবং শক্তি অবকাঠামোকে লক্ষ্য করতে পারে। পাশাপাশি, রাশিয়া চেষ্টা করবে ইউক্রেনের ড্রোন এবং ক্ষেপণাস্ত্র উৎপাদন ক্ষমতা কমাতে এবং NATO-এর সমর্থন বাধাগ্রস্ত করতে।
তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের হুমকি কতটা বাস্তব?
রাশিয়ার ২৫ বছর ধরে ক্ষমতায় থাকা রাষ্ট্রপতি পুতিন সম্প্রতি বলেছেন যে, তার কাছে যথেষ্ট শক্তি আছে যার মাধ্যমে ২০২২ সালে শুরু হওয়া যুদ্ধকে “তাত্ত্বিক সিদ্ধান্ত” পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়া যাবে। পুতিনের বক্তব্যে উত্তেজনা এবং হুমকি উভয়েরই ছাপ রয়েছে। NATO-এর হস্তক্ষেপকে পুতিন “সভ্যতার ধ্বংস” বলে আখ্যায়িত করে আসছেন। ২০২৪ সালের মে মাসে রাশিয়ার সাবেক রাষ্ট্রপতি দিমিত্রি মেদভেদেভ পারমাণবিক যুদ্ধের সতর্কতাও জারি করেছিলেন।
আমেরিকার রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্প সহ অনেক কৌশলবিদ এই যুদ্ধের তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধে রূপান্তরিত হওয়ার সম্ভাবনা প্রকাশ করেছেন। সাবেক CIA পরিচালক উইলিয়াম বার্নস জানিয়েছিলেন যে ২০২২ সালের শেষের দিকে রাশিয়ার পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের সম্ভাবনা একটি বড় হুমকি ছিল, যা মস্কো অস্বীকার করেছিল।
রাশিয়া এবং জার্মানির মধ্যে বর্ধমান উত্তেজনা
রাশিয়ার অসন্তোষ জার্মানির প্রতিও বাড়ছে, যা নির্দ্বিধায় ইউক্রেনকে অস্ত্র সরবরাহ করছে। জার্মানি ১০০০ কিলোমিটার পর্যন্ত আঘাত করতে পারে এমন টরাস ক্ষেপণাস্ত্র ইউক্রেনকে দেওয়ার প্রস্তুতির কথা বলেছে। এই ক্ষেপণাস্ত্র NATO-এর অংশ জার্মানি ইউক্রেনকে দিচ্ছে, যা রাশিয়ার জন্য বড় উদ্বেগের বিষয়। জার্মানির পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং অন্যান্য উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা এই সহায়তা আরও জোরদার করার পক্ষে।
ইউক্রেনের রাষ্ট্রপতি জেলেনস্কি সম্প্রতি জার্মানি সফর করেছেন এবং সেখানে ক্ষেপণাস্ত্র সহায়তা বাড়ানোর পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা করেছেন। এই পরিস্থিতি রাশিয়া-জার্মানির মধ্যে সংঘাত আরও বাড়াচ্ছে।
NATO-এর বর্ধমান হস্তক্ষেপ এবং রাশিয়ার প্রতিক্রিয়া
NATO এবং রাশিয়ার মধ্যে উত্তেজনা ক্রমশ বাড়ছে। পুতিন সতর্ক করে দিয়েছেন যে, যদি NATO দেশ ইউক্রেনে সরাসরি সামরিক হস্তক্ষেপ করে, তাহলে এটি “সভ্যতার ধ্বংস” হতে পারে। রাশিয়ার মতে, NATO-এর সম্প্রসারণ তাদের প্রভাব ক্ষেত্রে পশ্চিমা হস্তক্ষেপ।