ভারতের অগ্নি-V ক্ষেপণাস্ত্রের নতুন প্রচলিত সংস্করণ: ক্ষমতা ও প্রভাব

ভারতের অগ্নি-V ক্ষেপণাস্ত্রের নতুন প্রচলিত সংস্করণ: ক্ষমতা ও প্রভাব
সর্বশেষ আপডেট: 1 দিন আগে

ভারত অগ্নি-V ক্ষেপণাস্ত্রের নতুন একটি প্রচলিত সংস্করণ তৈরি করছে, যা ৭.৫ টন ওজনের যুদ্ধমাথা বহন করবে। এটি এয়ারবার্স্ট এবং বঙ্কার-বাস্টার অস্ত্রে সজ্জিত হবে, যার ফলে শত্রুর গভীর স্থাপনাগুলিতে সঠিক আঘাত হানা সম্ভব হবে।

India Developing Missile: ভারত অগ্নি-V ক্ষেপণাস্ত্রের একটি নতুন প্রচলিত (অ-পরমাণু) সংস্করণ উন্নয়ন করছে। এই ক্ষেপণাস্ত্রটি ৭.৫ টন ওজনের ভারী যুদ্ধমাথা বহন করবে এবং এর পাল্লা ২০০০ থেকে ২৫০০ কিলোমিটারের মধ্যে হবে। এতে এয়ারবার্স্ট এবং বঙ্কার-বাস্টার উভয় ধরণের যুদ্ধমাথা থাকবে। এই ক্ষেপণাস্ত্রটি প্রচলিত পদ্ধতিতে পাকিস্তান ও চীনের কৌশলগত স্থাপনাগুলিকে লক্ষ্য করতে পারবে। এর নির্ভুলতা, প্রাণঘাতী ক্ষমতা এবং আঞ্চলিক প্রভাব ভারতের নিরাপত্তা নীতিকে আরও শক্তিশালী করবে।

ভারত কেন নতুন প্রচলিত সংস্করণ তৈরি করছে

অগ্নি-V এখন পর্যন্ত ভারতের আন্তঃমহাদেশীয় ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র (ICBM) ছিল, যা পারমাণবিক অস্ত্র বহন করতে সক্ষম। কিন্তু এখন ভারত এর অ-পারমাণবিক সংস্করণ তৈরি করছে। এই পদক্ষেপ ভারতের প্রচলিত সামরিক শক্তিকে বৃদ্ধি করার দিকে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। এর ফলে ভারত পারমাণবিক বিকল্প ছাড়াই সীমিত যুদ্ধ পরিস্থিতিতে সিদ্ধান্তমূলক প্রতিক্রিয়া জানানোর ক্ষমতা পাবে।

ক্ষেপণাস্ত্রের প্রধান বৈশিষ্ট্যসমূহ

১. ভারী যুদ্ধমাথা

নতুন সংস্করণটি ৭.৫ টন ওজনের প্রচলিত যুদ্ধমাথা বহন করবে। এটি আমেরিকার GBU-57 বঙ্কার বাস্টার থেকেও তিনগুণ ভারী। এত ভারী পেলোডের কারণে এর পাল্লা সীমিত হবে, তবে প্রভাব বিরাট হবে।

২. দুই ধরণের যুদ্ধমাথা

  • এয়ারবার্স্ট যুদ্ধমাথা: এই যুদ্ধমাথা বাতাসে বিস্ফোরিত হয় এবং বৃহৎ এলাকা জুড়ে সামরিক স্থাপনা, এয়ারবেস, রাডার স্টেশন ইত্যাদি লক্ষ্যবস্তু ধ্বংস করে। এটি শত্রুর সামরিক অভিযানকে এক ঝটকায় বাধাগ্রস্ত করতে পারে।
  • বঙ্কার বাস্টার যুদ্ধমাথা: এটি ৮০ থেকে ১০০ মিটার গভীর ভূগর্ভস্থ স্থাপনা ধ্বংস করতে পারে। এটি বিশেষ করে শত্রুর কমান্ড সেন্টার, ক্ষেপণাস্ত্র ডিপো এবং পারমাণবিক অস্ত্রের ভান্ডার লক্ষ্য করার ক্ষেত্রে কার্যকর হবে।

৩. সীমিত কিন্তু কৌশলগত পাল্লা

এই নতুন সংস্করণের পাল্লা ২০০০ থেকে ২৫০০ কিলোমিটার পর্যন্ত হবে। ভারী যুদ্ধমাথার কারণে পাল্লা কম, কিন্তু পুরো পাকিস্তান এবং চীনের অনেক কৌশলগত স্থাপনা এটি কভার করার জন্য যথেষ্ট।

৪. উৎক্ষেপণ ব্যবস্থা এবং নির্ভুলতা

এই ক্ষেপণাস্ত্রটি ক্যানিস্টার ভিত্তিক হবে, যার ফলে এটি যে কোনও জায়গায়, যে কোনও সময় এবং যে কোনও আবহাওয়ায় উৎক্ষেপণ করা যাবে। এতে রিং লেজার গাইরোস্কোপ এবং নেভিকেশন/জিপিএস ভিত্তিক নেভিগেশন সিস্টেম থাকবে, যার ফলে এটি ১০ মিটারের কম নির্ভুলতার সাথে লক্ষ্যভেদ করতে পারবে।

৫. প্রযুক্তিগত উন্নতি

অগ্নি-V এর এই সংস্করণে হালকা কম্পোজিট উপাদান ব্যবহার করা হবে। এটি ক্ষেপণাস্ত্রটিকে হালকা করবে এবং গতিতে বৃদ্ধি করবে। এর গতি ম্যাক ২৪ (প্রায় ২৯,৪০০ কিমি/ঘণ্টা) হবে। এটি বিশ্বের দ্রুততম ক্ষেপণাস্ত্রগুলির মধ্যে একটি হবে।

উন্নয়নের অবস্থা

এই ক্ষেপণাস্ত্রটি এখনও নকশা এবং প্রকৌশলের প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। DRDO এটিতে কাজ শুরু করেছে, তবে এর প্রথম পরীক্ষা এখনও বাকি। মিশন দিব্যাস্ত্রে MIRV প্রযুক্তির সফল পরীক্ষা হয়েছে। এই প্রযুক্তি এই প্রচলিত সংস্করণেও ব্যবহার করা যেতে পারে।

পাকিস্তানের উপর প্রভাব

১. কিড়ানা হিলস-এর মতো স্থাপনা বিপন্ন
এই ক্ষেপণাস্ত্রটি পাকিস্তানের কিড়ানা হিলসের মতো ভূগর্ভস্থ পারমাণবিক স্থাপনা ধ্বংস করতে পারে। বঙ্কার বাস্টার যুদ্ধমাথার মাধ্যমে এই সুরক্ষা কবচ দুর্বল হতে পারে।

২. এয়ারবেসকে নিষ্ক্রিয় করার ক্ষমতা
এয়ারবার্স্ট যুদ্ধমাথা পাকিস্তানের পেশোয়ার, ইসলামাবাদ, করাচি-এর মতো সামরিক এয়ারবেস লক্ষ্য করতে পারে। এর ফলে শত্রুর বিমানবাহিনীকে ব্যাপক ক্ষতি হতে পারে।

৩. কৌশলগত চাপ
ভারতের এই ক্ষমতা পাকিস্তানের উপর কৌশলগত চাপ সৃষ্টি করবে। এটি ভারতের নো-ফার্স্ট-ইউজ নীতিকে শক্তিশালী করে প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করবে।

চীনের উপর প্রভাব

১. সীমিত কিন্তু যথেষ্ট পাল্লা
যদিও এই ক্ষেপণাস্ত্রের পাল্লা বেইজিং বা সাংহাইয়ের মতো পূর্ব চীনা শহরগুলিতে পৌঁছাবে না, তবে তিব্বত, ইউনান এবং সিনকিয়াংয়ের মতো অঞ্চলে অবস্থিত চীনা স্থাপনাগুলিকে সহজেই লক্ষ্য করা যাবে।

২. LAC-এর কাছে কৌশলগত সুবিধা
এই ক্ষেপণাস্ত্রটি LAC-এর কাছে চীনের কমান্ড সেন্টার, ক্ষেপণাস্ত্র ডিপো বা বঙ্কার ধ্বংস করতে কার্যকর হতে পারে। এতে ভারত কৌশলগত সুবিধা পাবে।

৩. চীনের প্রতিক্রিয়া
চীন ইতিমধ্যেই অগ্নি-V কে ৮০০০ কিমি পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র বলে মনে করে। এই প্রচলিত সংস্করণের ফলে সে ভারতের শক্তিকে আরও বেশি গুরুত্বের সাথে নেবে। এতে অঞ্চলে অস্ত্র প্রতিযোগিতা তীব্র হতে পারে।

আঞ্চলিক ও বিশ্বব্যাপী প্রভাব

১. প্রতিবেশী দেশের উপর প্রভাব

বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা এবং মালদ্বীপের মতো ভারতের নিকটবর্তী প্রতিবেশী এই ক্ষেপণাস্ত্রের পাল্লার মধ্যে রয়েছে, কিন্তু ভারতের সাথে তাদের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে। তাই এই ক্ষেপণাস্ত্রটি আঞ্চলিক নেতৃত্বকে শক্তিশালী করবে, কাউকে ভয় দেখানোর কাজ করবে না।

২. মধ্যপ্রাচ্য পর্যন্ত পৌঁছানো

২৫০০ কিমি পাল্লা ভারতকে ইরান এবং সৌদি আরবের মতো দেশের কাছাকাছি নিয়ে আসবে। কিন্তু ভারতের নীতি সবসময় প্রতিরক্ষা এবং স্থায়িত্বকেন্দ্রিক। তাই এর উদ্দেশ্য শুধুমাত্র প্রতিরক্ষা।

৩. হিন্দ মহাসাগরে প্রভাব

এই ক্ষেপণাস্ত্রটি ভারতকে হিন্দ মহাসাগর অঞ্চলে একটি শক্তিশালী শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করবে। এতে সমুদ্রের নিরাপত্তা এবং আঞ্চলিক ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করবে।

প্রযুক্তিগত ও কৌশলগত দৃষ্টিকোণ থেকে গুরুত্ব

১. প্রচলিত বাধার মধ্যে শক্তিশালীকরণ- এটি প্রথমবারের মতো যখন ভারত অগ্নি-V কে প্রচলিত অস্ত্রের সাথে প্রস্তুত করছে। এতে ভারত পারমাণবিক আঘাত ছাড়াই বৃহৎ লক্ষ্যবস্তু ধ্বংস করার ক্ষমতা পাবে।

২. নির্ভুলতা এবং কার্যকারিতা- ১০ মিটারের কম নির্ভুলতা এটিকে শত্রুর গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলি চুপচাপ এবং দ্রুত ধ্বংস করতে সক্ষম করে। এয়ারবার্স্ট এবং বঙ্কার বাস্টার উভয় সংস্করণই ভারতকে কৌশলগত নমনীয়তা প্রদান করে।

৩. পারমাণবিক ত্রিমুখীকে সম্পূরক করে- এই ক্ষেপণাস্ত্রটি ভারতের স্থল, জল ও আকাশ ভিত্তিক পারমাণবিক শক্তিকে সুষম এবং সম্পূরক করবে। এতে ভারতের সামগ্রিক প্রতিরক্ষা কৌশল শক্তিশালী হবে।

আগামী চ্যালেঞ্জ এবং পরিকল্পনা

১. নকশা এবং পরীক্ষার চ্যালেঞ্জ

এত ভারী পেলোড নিয়ে ক্ষেপণাস্ত্রটিকে সুষম এবং কার্যকর করা প্রযুক্তিগত চ্যালেঞ্জ। DRDO কে এতে রকেট মোটর, উপাদান এবং নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থায় পরিবর্তন করতে হবে।

২. ব্যয় এবং সময়

এখন পর্যন্ত অগ্নি-V এর উন্নয়নে প্রায় ২৫০০ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। এই নতুন সংস্করণের জন্য আরও অর্থায়নের প্রয়োজন হবে। এর পরীক্ষা এবং স্থাপনায় কয়েক বছর সময় লাগতে পারে।

৩. কূটনৈতিক ভারসাম্য

ভারত সবসময় তার ক্ষেপণাস্ত্র নীতিকে প্রতিরক্ষামূলক রেখেছে। কিন্তু এই নতুন পদক্ষেপ চীন ও পাকিস্তানের সাথে অস্ত্র প্রতিযোগিতা সৃষ্টি করতে পারে। ভারতকে আন্তর্জাতিক মঞ্চে তার নীতি ও উদ্দেশ্য স্পষ্ট রাখতে হবে।

Leave a comment