বিশ্বের সবচেয়ে বড় কন্টেইনার জাহাজ এমএসসি ইরিনা সোমবার সকালে ভারতের বিজিনজাম আন্তর্জাতিক বন্দরে পৌঁছেছে।
ভারতের সমুদ্রের ইতিহাসে ১৭ জুন ২০২৫ সকাল একটি ঐতিহাসিক দিন হিসেবে লিপিবদ্ধ হয়েছে, যখন বিশ্বের সবচেয়ে বড় কন্টেইনার জাহাজ এমএসসি ইরিনা প্রথমবারের মতো ভারতীয় উপকূলে এসে নোঙ্গর করে। কেরালার বিজিনজাম আন্তর্জাতিক বন্দরে এর আগমন কেবল ভারতের ক্রমবর্ধমান সমুদ্র শক্তিকে নির্দেশ করে না, বরং এটিকে বিশ্বব্যাপী লজিস্টিক্স এবং ট্রান্সশিপমেন্টের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার দিকে একটি বড় পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
প্রথমবার দক্ষিণ এশিয়ায়
দক্ষিণ কোরিয়ায় নির্মিত এবং সুইজারল্যান্ডের সমুদ্র পরিবহন সংস্থা এমএসসি (মেডিটেরেনিয়ান শিপিং কোম্পানি)-এর নৌবহরের অংশ এমএসসি ইরিনা প্রথমবারের মতো দক্ষিণ এশিয়ার কোনও বন্দরে পৌঁছেছে। বিজিনজাম বন্দরে সকাল আটটায় যখনই এই বিশাল জাহাজটি এসে পৌঁছালো, সেখানে উপস্থিত কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা ঐতিহ্যগত জল সলাম দিয়ে এর স্বাগত জানিয়েছেন। এই দৃশ্য ভারতের সমুদ্র পরম্পরা এবং সাংস্কৃতিক আতিথেয়তার অসাধারণ উদাহরণ।
বিশালতার চরম রূপ এমএসসি ইরিনা
এমএসসি ইরিনা কেবল একটি কন্টেইনার জাহাজ নয়, বরং আধুনিক সমুদ্র প্রযুক্তি এবং নির্মাণ কৌশলের চরম রূপ। এর দৈর্ঘ্য প্রায় ৪০০ মিটার, অর্থাৎ চারটি ফুটবল মাঠের সমান। প্রস্থ প্রায় ৬১ মিটার এবং গভীরতা ৩৩.২ মিটার। এই জাহাজটি ২৪,৩৪৬ টিইইউ (টুয়েন্টি ফুট ইকুইভ্যালেন্ট ইউনিটস) কন্টেইনার বহন করার ক্ষমতা রাখে। এত বড় পরিমাণে মালামাল বহন করার ক্ষমতা এটিকে বিশ্বের সবচেয়ে বড় কন্টেইনার জাহাজ করে তুলেছে।
বিজিনজাম বন্দরের কঠোর পরীক্ষা
এমএসসি ইরিনার আগমন বিজিনজাম বন্দরের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ এবং একই সাথে এক অর্জন। এই বন্দরের উদ্বোধন সম্প্রতি ২ মে ২০২৫ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী করেছেন। এটি ভারতের প্রথম গভীর সমুদ্রের এবং সম্পূর্ণ ট্রান্সশিপমেন্টের জন্য প্রস্তুত বন্দর, যা বড় এবং ভারী জাহাজ পরিচালনার ক্ষমতা রাখে।
এই বন্দরের ব্যবস্থাপনা অদানি পোর্টস অ্যান্ড স্পেশাল ইকোনমিক জোন লিমিটেড (এপিএসইজেড) কর্তৃক করা হচ্ছে। এমএসসি ইরিনার মতো জাহাজ সফলভাবে ডক করা এই বিষয়টির ইঙ্গিত দেয় যে, ভারত এখন লজিস্টিক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচারের ক্ষেত্রে কোনও উন্নত দেশের থেকে পিছিয়ে নেই।
ভারতের ট্রান্সশিপমেন্ট কৌশলকে শক্তিশালীকরণ
ভারত দীর্ঘদিন ধরে ট্রান্সশিপমেন্ট হাব হওয়ার স্বপ্ন দেখে আসছে। এখন যখন বিজিনজামের মতো আধুনিক বন্দরে বিশ্বের সবচেয়ে বড় জাহাজ নোঙ্গর করেছে, এই স্বপ্ন বাস্তবায়িত হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। করণ অদানি এক বিবৃতিতে বলেছেন, এমএসসি ইরিনার আগমন ভারতের সমুদ্র শক্তিকে আন্তর্জাতিক মঞ্চে স্বীকৃতি দেওয়ার মতো। তিনি এটিকে ভারতের ট্রান্সশিপমেন্ট কৌশলের জন্য একটি সিদ্ধান্তমূলক মুহূর্ত বলে উল্লেখ করেছেন।
রণনৈতিক অবস্থান এবং বাণিজ্যিক লাভ
বিজিনজাম বন্দরের ভৌগোলিক অবস্থান এটিকে অত্যন্ত রণনৈতিক করে তুলেছে। এই বন্দরটি বিশ্বের সবচেয়ে ব্যস্ত পূর্ব-পশ্চিম শিপিং রুট থেকে মাত্র ১০ নটিক্যাল মাইল (প্রায় ১৯ কিলোমিটার) দূরত্বে অবস্থিত। অর্থাৎ, এখান থেকে ইউরোপ, ফারসি উপসাগর, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং সুদূর পূর্বের সরাসরি পৌঁছানো অত্যন্ত সহজ। এই কারণে এই বন্দরটি কেবল ভারতের জন্য নয়, প্রতিবেশী দেশগুলির জন্যও একটি আদর্শ ট্রান্সশিপমেন্ট সেন্টার হতে পারে।
আত্মনির্ভর ভারতের দিকে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ
এমএসসি ইরিনার মতো জাহাজের ভারতে আগমন, বিশেষ করে বিজিনজাম বন্দরে, আত্মনির্ভর ভারতের দর্শন বাস্তবায়নের দিকে একটি পদক্ষেপ। ভারত এখন কলম্বো বা সিঙ্গাপুরের মতো বিদেশি বন্দরের উপর নির্ভর করবে না। বড় পরিমাণে আমদানি-রপ্তানি এখান থেকেই ট্রান্সশিপ করা যাবে, যার ফলে ব্যবসায়িক ব্যয় কমবে এবং সময়ও সাশ্রয় হবে।
বিশ্ব মঞ্চে ভারতের ভাবমূর্তি শক্তিশালীকরণ
এই অর্জন কেবলমাত্র অর্থনৈতিক নয়, কূটনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকেও গুরুত্বপূর্ণ। ভারত এখন বিশ্বকে দেখাচ্ছে যে, তা কেবলমাত্র প্রযুক্তিগতভাবে দক্ষ নয়, লজিস্টিক্স এবং ইনফ্রাস্ট্রাকচারের ক্ষেত্রেও অগ্রণী। চীন এবং অন্যান্য প্রতিযোগী দেশের দৃষ্টি এই পদক্ষেপে আকর্ষণ হয়েছে কারণ ভারত এখন একটি প্রভাবশালী সমুদ্র কেন্দ্র হিসেবে উঠে আসছে।
রোজগার এবং আঞ্চলিক উন্নয়নে উৎসাহ
বিজিনজাম বন্দর থেকে কেবলমাত্র বিশ্বব্যাপী ব্যবসায় উৎসাহ পাবে না, বরং স্থানীয় অর্থনীতি এবং রোজগারও নতুন দিক পাবে। এই বন্দরের সাথে যুক্ত লজিস্টিক্স, পরিবহন, কাস্টমস, গুদামঘরের মতো সেবাগুলিতে হাজার হাজার নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। পাশাপাশি কেরাল এবং দক্ষিণ ভারতের অন্যান্য রাজ্যের ব্যবসায়ীদের আমদানি-রপ্তানিতে নতুন প্ল্যাটফর্ম পাবে।