প্রফেসর ভ্লাদিস্লাভ ইবশ্চুট্সের স্ত্রীর মৃত্যুর পর তাঁর কাছে শুধুমাত্র বই আর কিছু পোষা পাখিই অবশিষ্ট ছিল। ইতিহাসের অধ্যাপক হলেও, কিছু অদ্ভুত ছাত্রের কারণে তিনি পদত্যাগ করেছিলেন। এই ছাত্ররা “জেলপোলস্কি দল”-এর সাথে যুক্ত ছিল এবং পড়াশোনার চেয়ে ঝগড়ায় বেশি আগ্রহী ছিল। তারা এক ধরণের সোনালি টুপি পরত এবং হাতে লোহার ছড়ি নিয়ে ঘুরে বেড়াত। তাদের আচরণ ছিল অত্যন্ত হিংস্র এবং তারা ইহুদিদের প্রতি গভীর ঘৃণা পোষণ করত। প্রফেসর কখনোই বুঝতে পারেননি কেন তাদের ইহুদিদের জন্য এত ঘৃণা?
ছাত্রদের মুখে রাগ স্পষ্ট দেখা যেত – লাল মুখ, ফুসকুড়িযুক্ত গলা, এবং মোটা নাক। তারা ইহুদি ছাত্রদের জন্য আলাদা করে বসার দাবি জানাত, যা ক্লাসের পরিবেশকে আরও বিষাক্ত করে তুলত।
প্রফেসর যখন চাকরি ছেড়ে দেন, তখন তাঁর খুবই ক্ষীণ পেনশন ছিল, যা দিয়ে সংসার চালানো কঠিন হয়ে পড়েছিল। তাঁর সাথে বাস করত এক বৃদ্ধা গৃহকর্মী টেকলা, যিনি আগে খেতে কাজ করতেন। প্রফেসর তাঁর বেতনও বন্ধ করে দিয়েছিলেন, তবুও তিনি তাঁর সাথেই থাকতেন। দুজনেরই দাঁত ছিল না, তাই টেকলা দিনে দুবার স্যুপ বানিয়ে দিতেন। তাদের নতুন কাপড় বা জুতা কিনার কোন প্রয়োজন ছিল না। তাঁর স্ত্রীর পুরোনো কোট ও কাপড় এখনও রাখা ছিল, যা এখনো পর্যন্ত কীটনাশক গুলি দ্বারা রক্ষা করা হয়েছিল।
বই ও পাখির জগৎ
সময়ের সাথে সাথে প্রফেসরের গ্রন্থাগার অনেক বড় হয়ে উঠেছিল। তাঁর আলমারি, বাক্স, বেসমেন্ট এবং অ্যাটিক – সবই বইতে ভরে গেছে। স্ত্রী যখন জীবিত ছিলেন, তখন বইগুলো সুন্দর করে রাখতেন, কিন্তু তাঁর মৃত্যুর পর সব কিছু ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল। বইয়ের পাশাপাশি প্রফেসর পাখিদের প্রতিও অসীম ভালোবাসা পোষণ করতেন। তিনি তোতা, টিউইয়া-তোতা, ক্যানারি ইত্যাদি পাখির অসংখ্য খাঁচা জোগাড় করেছিলেন। তিনি এই পাখিগুলিকে খাঁচায় বন্দী করে রাখতেন না, বরং খোলা ছাড়িয়ে দিতেন যাতে তারা ঘরে ইচ্ছামতো উড়ে বেড়াতে পারে।
টেকলা এই পাখিদের নোংরা পরিষ্কার করতে বিরক্ত হতেন, কিন্তু প্রফেসর হেসে বলতেন, ‘ভগবানের সৃষ্টিতে নোংরা কোথায়?’ তাঁর কাছে এগুলি শুধু পাখি নয়, যেন মন্দিরের পূজার মতো পবিত্র।
কবুতরের সাথে আধ্যাত্মিক সম্পর্ক
প্রফেসর প্রতিদিন সকাল-সন্ধ্যে কবুতরদের দানা ছড়িয়ে দিতে বের হতেন। তিনি ছিলেন এতই ছোটো এবং কুঁজো যে লোকেরা তাঁকে দূর থেকেই চিনতে পারত। তাঁর মুখের झुर्रियाँ, হলুদ-সাদা দাড়ি, মোটা চশমার আড়ালে झাঁকানো চোখ, এবং সর্বদা একই পুরোনো সবুজ কোট তাঁর এক অনন্য পরিচয় হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তিনি কোনো শব্দ করতেন না, কিন্তু কবুতররা তাঁর আসার শব্দে কেবল জড়ো হয়ে যেত।
তাঁর বাড়ি ছিল একটি পুরোনো গলিতে, যেখানে যানবাহনের চাপ ছিল খুবই কম। কবুতররা সেখানে কোনো শব্দ বা ভয় ছাড়াই স্বচ্ছন্দে বাস করত। প্রফেসর মনে করতেন কবুতরদের দানা খাওয়ানোও এক ধরণের পূজা। তিনি বলতেন, “ভগবানের সৃষ্ট এই প্রাণীর সেবা করা-ই হলো প্রকৃত ধর্ম।”
কবুতরদের কাছ থেকে শিক্ষা
কবুতরদের শান্ত স্বভাব প্রফেসরকে অনেক কিছু শিখিয়েছিল। তিনি পড়েছিলেন যে গ্রীকরা কবুতরকে খুব পছন্দ করত। প্রফেসর এখন বুঝতে পারছিলেন কেন। কবুতরদের না তো শিকারের জন্য পাঁজর আছে, না তো দানা জমা করার কোনো উপায়। তবুও তারা সারাদিন উড়ে বেড়ায় এবং যেখানেই দানা পায় সেখানেই খায়। তাদের গুটগুটানিতে একটা মধুর সুর আছে। কিন্তু কখনো কখনো কিছু কবুতর এমনও বের হয় যারা অন্যদের সাথে ঝগড়া করে, তাদের দানা খেতে দেয় না।
প্রফেসর এটা দেখে নিজের পুরোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা মনে করতেন, যেখানে কিছু ছাত্র অন্যদের উপর অত্যাচার করেছিল। তিনি ভাবতেন, যেমন কবুতরের মধ্যেও কিছু আক্রমণাত্মক স্বভাবের হয়, তেমনি মানুষের মধ্যেও। আর এই চিন্তা তাঁকে আবার জীবন ও প্রকৃতির গভীর প্রশ্নের দিকে টেনে নিয়ে যেত।
জীবনের নতুন দিক
ইতিহাস পড়াতে পড়াতে প্রফেসর জীবনের নানা দিক দেখেছিলেন এবং বুঝেছিলেন। তিনি ভাবতেন, মানব জাতি বারবার কেন ঝগড়া করে? কেন একে অপরকে কষ্ট দেয়? কখনো তিনি কার্ল মার্ক্সের মতো চিন্তাবিদদের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন, পরে তাঁর ঝোঁক আধ্যাত্ম ও প্রকৃতির দিকে ঘুরে গেল।
এখন তিনি পশু ও পাখি সম্পর্কে পড়তে বেশি আগ্রহী হয়ে উঠেছিলেন। তাঁর লাইব্রেরি পশু-পাখির বইয়ে ভরে গেল। তিনি জানতেন তাঁর একটা চোখ আর কাজ করে না, তবুও তিনি ছোটো একটি লেন্স নিয়ে চুলের গঠন দেখতেন। তিনি নিজের দাড়ির চুল ভেঙে স্লাইডে রাখতেন এবং বড়ো মনোযোগ সহকারে পর্যবেক্ষণ করতেন। তাঁর মনে হতো প্রতিটি চুল, প্রতিটি পালক, প্রতিটি জিনিসের মধ্যে ভগবানের জাদু লুকিয়ে আছে।
টেকলা প্রতিদিন তাঁর জন্য তাজা ফুলের তোড়া রাখত, যার ফলে তাঁর ঘর ও মন দুটোই মনোরম হয়ে উঠত। তাঁর চারপাশে পাখির কিচিরমিচির শব্দ গুঞ্জন করত – কোনো তোতা ‘ভুখা’, কোনো ‘উল্লু’ বলে, টেকলার গ্রামীণ ভাষায়। এসব শুনে প্রফেসর হেসে ফেলতেন।
জীবনের প্রকৃত অর্থ
প্রফেসর এখন সম্পূর্ণরূপে কবুতর, তোতা এবং বইয়ের জগতে হারিয়ে গিয়েছিলেন। তিনি ইতিহাসের যুদ্ধ এবং নেতাদের মিথ্যা গৌরব থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন। তাঁর এখন মনে হতো প্রকৃত শান্তি, প্রকৃত পূজা হলো এই পাখিদের দানা খাওয়ানো। তিনি মনে করতেন, মানুষ হোক বা পাখি, সবার জন্য প্রয়োজন ভালোবাসা, শান্তি ও বুদ্ধিমত্তা।
তিনি ভাবতেন, যদি ভগবান সত্যিই থাকে, তাহলে তিনি হিংসা নয়, করুণা ও সেবায় আনন্দিত হবেন। পাখির জগত দেখে তিনি বুঝতে পারতেন আমাদেরও একই পথ অবলম্বন করা উচিত – শান্তিপূর্ণ, সহাবস্থানমূলক। যখন জীবনের জটিলতা আমাদের ক্লান্ত করে তোলে, তখন ছোটো ছোটো প্রাণীর কাছ থেকেও আমরা প্রকৃত প্রেম, শান্তি ও ঈশ্বরের উপস্থিতির অনুভূতি পেতে পারি।