নেলসন ম্যান্ডেলা: বর্ণবাদের বিরুদ্ধে লড়াই এবং শান্তির প্রতীক

🎧 Listen in Audio
0:00

নেলসন রোলিহলাহলা মান্ডেলা (জন্ম: ১৮ জুলাই ১৯১৮ – মৃত্যু: ৫ ডিসেম্বর ২০১৩) শুধুমাত্র একটি নাম নয়, বরং স্বাধীনতা, সমতা এবং মানবাধিকারের জন্য সংগ্রামের প্রতীক। তিনি দক্ষিণ আফ্রিকায় দীর্ঘদিন ধরে চলা বর্ণবাদ (Apartheid) এর বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছেন এবং কেবলমাত্র দেশের প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ রাষ্ট্রপতিই হননি, বরং বিশ্বজুড়ে শান্তি ও ন্যায়বিচারের প্রতীক হিসেবেও স্বীকৃত হয়েছেন।

বর্ণবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করা একজন সच्चा নেতা

মান্ডেলা দক্ষিণ আফ্রিকার প্রথম এমন রাষ্ট্রপ্রধান ছিলেন যিনি সম্পূর্ণ গণতান্ত্রিক এবং বহুজাতিক নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত হয়েছিলেন। তাঁর রাষ্ট্রপতি কাল (১৯৯৪-১৯৯৯) বর্ণবাদী নীতির বিরুদ্ধে সুসংহতি, ঐক্য এবং সামাজিক ন্যায়বিচারের জন্য উৎসর্গীকৃত ছিল। তিনি আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেস (ANC) এর প্রধান নেতা ছিলেন এবং ১৯৯১ থেকে ১৯৯৭ পর্যন্ত দলের সভাপতিও ছিলেন। তাঁর আদর্শের মূলে ছিল আফ্রিকান জাতীয়তাবাদ এবং সমাজতন্ত্র।

রাজবংশ থেকে সংগ্রামের পথে

মান্ডেলার জন্ম হয়েছিল থেমবু রাজ পরিবারের জোসা সম্প্রদায়ে। তাঁর পারিবারিক নাম ছিল ‘রোলিহলাহলা’, যার অর্থ ‘দুষ্টু’ বা ‘ঝামেলা সৃষ্টিকারী’। পরবর্তীকালে তাঁকে তাঁর উপজাতীয় নাম ‘মাদিবা’ নামেও ডাকা হত। তাঁর ঠাকুরদাদা, রাজা ন্গুবেন্গুকা, থেমবু সাম্রাজ্যের শাসক ছিলেন। মান্ডেলার পিতা, গাদলা হেনরি ম্ফাকানিসওয়া মান্ডেলা, সম্রাটের একজন স্থানীয় প্রধান এবং রাজ পরিষদের সদস্য ছিলেন।

তাঁর মা, নোসেকেনি, একজন গভীর ধার্মিক মহিলা ছিলেন। নেলসন তাঁর প্রাথমিক জীবন কুয়ানু গ্রামে কাটিয়েছেন, যেখানে তিনি গরু চরাচ্ছেন এবং মাটির সাথে ঘনিষ্ঠভাবে জীবনযাপন করেছেন। ৭ বছর বয়সে একটি মেথোডিস্ট স্কুলে ভর্তি হন, যেখানে ব্রিটিশ ঐতিহ্য অনুযায়ী তাঁর নাম রাখা হয় ‘নেলসন’।

শিক্ষা থেকে সমাজ ও রাজনীতির জ্ঞান

মান্ডেলা ক্লার্কবেরি মেথোডিস্ট হাই স্কুলে পড়াশোনা শুরু করেন এবং পরে হিল্ডটাউনের ওয়েসলিয়ান কলেজে যান, যা তখন কৃষ্ণাঙ্গ ছাত্রদের জন্য একটি সম্মানিত প্রতিষ্ঠান ছিল। এরপর তিনি ফোর্ট হ্যারে বিশ্ববিদ্যালয়ে যান, যেখানে তাঁর রাজনৈতিক চিন্তাধারা আকার নিতে শুরু করে।

১৯৪৩ সালে ANC-তে যোগদানের পর তিনি ANC-এর যুব লীগের সহ-প্রতিষ্ঠাতা হন। ১৯৫০-এর দশকে তিনি বর্ণবাদী নীতির বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রতিবাদ আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দুতে আসেন। ১৯৫২ সালের অবাধ্যতা আন্দোলন এবং ১৯৫৫ সালের ‘কংগ্রেস অফ দ্য পিপল’-এ অংশগ্রহণ তাঁকে জননেতা হিসেবে গড়ে তোলে।

শান্তি থেকে উগ্র আন্দোলন পর্যন্ত

প্রথমদিকে মান্ডেলা অহিংস প্রতিবাদের সমর্থক ছিলেন, কিন্তু ১৯৬১ সালে তিনি দক্ষিণ আফ্রিকান কমিউনিস্ট পার্টি (SACP)-এর সহযোগিতায় একটি সশস্ত্র সংগঠন ‘আমখোন্তো ওয়ে সিজওয়ে’ প্রতিষ্ঠা করেন। এই সংগঠন সরকারের বিরুদ্ধে বহু সন্ত্রাসবাদী কর্মসূচি পরিচালনা করে। ১৯৬২ সালে তাঁকে গ্রেফতার করা হয় এবং পরে "রিভোনিয়া ট্রায়াল"-এ তাঁকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়।

২৭ বছরের কারাবাস: সহনশীলতা ও সাহসের পরীক্ষা

মান্ডেলা তাঁর জীবনের ২৭ বছর রবেন দ্বীপ, পোলসমুর এবং ভিক্টর ভারস্টারের মতো কারাগারে কাটিয়েছেন। এই সময় তিনি কেবলমাত্র ব্যক্তিগত কষ্টই পাননি, বরং কারাগারের ভিতরেও মানবাধিকারের লড়াই করেছেন। ধীরে ধীরে তাঁর নাম বিশ্বব্যাপী প্রতীক হয়ে ওঠে এবং আন্তর্জাতিক চাপের ফলে ১৯৯০ সালে রাষ্ট্রপতি এফ. ডব্লিউ. ডি. ক্লার্ক তাঁকে মুক্তি দেন।

বর্ণবাদের অবসান এবং নতুন যুগ

মুক্তির পর মান্ডেলা বর্ণবাদ নির্মূল করার জন্য ডি ক্লার্কের সাথে মিলে শান্তি আলোচনা শুরু করেন। এর ফলে ১৯৯৪ সালে বহুজাতিক সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, যাতে ANC জয়ী হয় এবং মান্ডেলা দেশের প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ রাষ্ট্রপতি হন।

তাঁর সরকার নতুন সংবিধান প্রয়োগ করে, ‘সত্য ও সুসংহতি কমিশন’ (Truth and Reconciliation Commission) প্রতিষ্ঠা করে যা বর্ণবাদী যুগের অপরাধের তদন্ত করে। তিনি দেশের সকল জাতিগত ও সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীর মধ্যে মিলন ও সম্প্রীতির প্রতীক হয়ে ওঠেন।

বিশ্ব নেতা এবং মানবতাবাদী সেবা

রাষ্ট্রপতি পদ থেকে অবসর নেওয়ার পরও মান্ডেলা বিশ্ব রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। তিনি অসংশ্লিষ্ট আন্দোলনের মহাসচিব হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। পরে তিনি ‘নেলসন মান্ডেলা ফাউন্ডেশন’ প্রতিষ্ঠা করেন, যা দারিদ্র্য এবং HIV/AIDS-এর মতো রোগের বিরুদ্ধে কাজ করে।

বিবাদের পরও আদর্শ নেতা

তাঁর জীবদ্দশায় মান্ডেলা সবসময়ই বিতর্কের বাইরে ছিলেন না। ডানপন্থী শক্তি তাঁকে কমিউনিস্ট ও সন্ত্রাসবাদী বলে আখ্যা দিত, আবার কিছু বামপন্থী তাঁকে বর্ণবাদী সরকারের সাথে অত্যধিক সুসংহতির জন্য সমালোচনা করত। কিন্তু বিশ্বজুড়ে তিনি সামাজিক ন্যায়বিচার, সমতা এবং গণতন্ত্রের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস হিসেবে বিবেচিত হয়েছেন। তিনি ২৫০টিরও বেশি আন্তর্জাতিক সম্মাননা লাভ করেছেন, যার মধ্যে ১৯৯৩ সালের নোবেল শান্তি পুরষ্কার অন্যতম।

নেলসন মান্ডেলার জীবনী একজন এমন ব্যক্তির কাহিনী যিনি অন্যায় সহ্য করেছেন এবং সেই ব্যবস্থাকে পরিবর্তন করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। তাঁর জীবনী প্রতিটি মানুষের জন্য অনুপ্রেরণা যারা বিশ্বকে আরও উন্নত করতে চায়। ২৭ বছর কারাগারের সলখা পিছনে কাটানোর পরও তিনি তাঁর মনে ঘৃণার বদলে ক্ষমা এবং প্রতিশোধের বদলে সম্প্রীতির স্থান দিয়েছেন – এটাই তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড় শিক্ষা।

Leave a comment