মিলখা সিংহ: ভারতের ‘দ্য ফ্লাইং সিখ’ এর জীবন ও অবদান

🎧 Listen in Audio
0:00

মিলখা সিংহ (২০ নভেম্বর ১৯২৯ – ১৮ জুন ২০২১) ভারতীয় খেলার ইতিহাসের অন্যতম উজ্জ্বল নক্ষত্র ছিলেন। ‘দ্য ফ্লাইং সিখ’ নামে খ্যাত এই ব্যক্তি ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ডের একজন মহান দৌড়বিদ ছিলেন, যিনি নিজের পরিশ্রম ও অধ্যবসায়ের মাধ্যমে কেবল ভারতেই নয়, সমগ্র বিশ্বে নিজের পরিচয় তৈরি করেছিলেন। ভারতীয় সেনাবাহিনীতে কর্মরত থাকাকালীন তিনি খেলার সাথে জড়িত হন এবং পরবর্তীতে এশিয়ান গেমস এবং কমনওয়েলথ গেমসে ৪০০ মিটার দৌড়ে স্বর্ণপদক জয়ী একমাত্র ভারতীয় এথলেট হন।

প্রাথমিক জীবন ও কঠিন সময়

মিলখা সিংহের জন্ম হয় ২০ নভেম্বর ১৯২৯ সালে পঞ্জাবের গোবিন্দপুরা নামক গ্রামে, যা বর্তমানে পাকিস্তানের কোট আদু জেলায় অবস্থিত। তাঁর পরিবার ছিল সিখ রাঠোড় রাজপুত। দেশভাগের সময় তাঁর জীবনে সবচেয়ে বড় দুঃখ আসে, যখন তিনি অনাথ হন। তাঁর মা-বাবা, এক ভাই ও দুই বোন দেশভাগের সহিংসতার শিকার হন, এবং এই ঘটনাগুলি তিনি নিজের চোখের সামনে দেখেছিলেন।

দেশভাগের পর তিনি ভারতে আসেন এবং দিল্লিতে এক শরণার্থী শিবিরে থাকেন। কষ্ট এতটাই বেশি ছিল যে একবার তিনি তিহার জেলেও গিয়েছিলেন কারণ তিনি ট্রেনে টিকিট ছাড়া ভ্রমণ করেছিলেন। জীবনের এই নানা বিপর্যয় সত্ত্বেও তিনি হাল ছাড়েননি। তাঁর এক ভাই তাঁকে সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে উৎসাহিত করেন, যার ফলে তাঁর জীবনের নতুন অধ্যায় শুরু হয়।

খেলার দিকে প্রথম পদক্ষেপ

মিলখা সিংহের খেলার জগতে পদার্পণ হয় সেনাবাহিনীতে যোগদানের পর। সেনাবাহিনীতে যোগদান করার পর তিনি এথলেটিক্সের প্রশিক্ষণ পান। তিনি এই সুযোগটিকে পুরোপুরি মনোযোগ ও পরিশ্রমের সাথে গ্রহণ করেন। নিজের পরিশ্রম ও অধ্যবসায়ের ফলে তিনি দ্রুত একজন ভালো খেলোয়াড় হয়ে ওঠেন। ১৯৫১ সালে সেনাবাহিনীতে যোগদানের পর তিনি নিয়মিত অনুশীলন করেন এবং নিজের ক্ষমতা বৃদ্ধি করেন। এই পরিশ্রমের ফলেই তিনি পরবর্তীতে এশিয়ান গেমস এবং কমনওয়েলথ গেমসে ভারতের নাম উজ্জ্বল করতে সক্ষম হন। তাঁর এই পরিশ্রম ও অধ্যবসায় তাঁকে দেশের মহান এথলেটদের মধ্যে অন্যতম করে তুলেছে।

আন্তর্জাতিক মঞ্চে সাফল্য

মিলখা সিংহ ১৯৫৬ সালের মেলবোর্ন অলিম্পিকে ভারতের প্রতিনিধিত্ব করেন এবং ২০০ মিটার ও ৪০০ মিটার দৌড়ে অংশগ্রহণ করেন। সে সময় তাঁর আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতার অভাব ছিল, তাই তিনি পদক জিততে পারেননি। কিন্তু সেখানে তিনি বিশ্বের অন্যতম সেরা দৌড়বিদ, যেমন চার্লস জেনকিন্সের সাথে দেখা করেন, যা তাঁকে আরও বেশি পরিশ্রম করার অনুপ্রেরণা দেয়। এই অভিজ্ঞতা তাঁকে নিজের খেলায় উন্নতি ও এগিয়ে যাওয়ার শক্তি প্রদান করে।

এরপর ১৯৫৮ সালের এশিয়ান গেমস এবং কমনওয়েলথ গেমসে মিলখা সিংহ ৪০০ মিটার দৌড়ে স্বর্ণপদক জয় করে নতুন ইতিহাস রচনা করেন। একই বছর কটকে অনুষ্ঠিত জাতীয় খেলায় তিনি বেশ কয়েকটি জাতীয় রেকর্ড ভেঙে দেন। তাঁর এই চমৎকার সাফল্যের জন্য ভারত সরকার তাঁকে পদ্মশ্রী সম্মানে ভূষিত করেন, যা দেশের চতুর্থ সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান। এই সম্মান তাঁর পরিশ্রম ও দেশের জন্য অবদানকে স্বীকৃতি দেয়।

১৯৬০ সালের রোম অলিম্পিকের স্মরণীয় দৌড়

মিলখা সিংহের সবচেয়ে স্মরণীয় দৌড় ছিল ১৯৬০ সালের রোম অলিম্পিকের ৪০০ মিটার ফাইনাল। এই দৌড়ে তিনি শুরুতে খুব দ্রুত দৌড়েছিলেন এবং ২০০ মিটার পর্যন্ত তিনি সবার আগে ছিলেন। কিন্তু পরে তাঁর গতি কিছুটা কমে যায় এবং তিনি চতুর্থ স্থানে থাকেন। এই দৌড়টি ছিল খুব কাছাকাছি, এমনকি বিজয়ীর সিদ্ধান্ত নিতে ফটো-ফিনিশ প্রযুক্তির প্রয়োজন হয়। তাঁর ৪৫.৭৩ সেকেন্ডের সময় ৪০ বছর ধরে ভারতের জাতীয় রেকর্ড হিসেবে ছিল, যা তাঁর অসাধারণ পরিশ্রম ও দক্ষতার প্রমাণ।

মিলখা সিংহ এই দৌড়ে তাঁর ভুলগুলি স্বীকার করেছিলেন এবং এটিকে তাঁর জীবনের "সবচেয়ে খারাপ স্মৃতি" বলে উল্লেখ করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন যে যদি দৌড়ে 조금 বেশি সতর্কতা অবলম্বন করা হতো এবং ক্রমাগত দ্রুত গতি বজায় রাখা হতো, তাহলে ফলাফল আরও ভালো হতে পারত। এই অভিজ্ঞতা তাঁর জন্য একটা বড় শিক্ষা হয়ে ওঠে, যা তাঁর খেলা এবং জীবনের দিক পরিবর্তন করে দেয়।

সাফল্য ও অবদান

মিলখা সিংহ ১৯৬২ সালের এশিয়ান গেমসে আবার স্বর্ণপদক জিতে তাঁর উজ্জ্বলতা বজায় রাখেন। এরপর ১৯৬৪ সালের টোকিও অলিম্পিকে তিনি ভারতের প্রতিনিধিত্ব করেন। যদিও এবার তিনি পদক জিততে সক্ষম হননি, তবুও তাঁর দৌড়ানোর অনন্য শৈলী ও কঠোর পরিশ্রম সমগ্র দেশের লাখ লাখ যুবককে খেলার প্রতি উৎসাহিত করে। তাঁর নাম ভারতের মহান খেলোয়াড়দের মধ্যে সর্বদা স্মরণীয় থাকবে।

সেনাবাহিনী থেকে অবসর গ্রহণের পর মিলখা সিংহ পঞ্জাব শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে খেলার পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন। সেখানে তিনি যুব খেলোয়াড়দের খেলার প্রতি উৎসাহিত করেন এবং খেলার উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ২০০১ সালে তাঁকে ভারত সরকারের অর্জুন পুরস্কার দেওয়া হয়, কিন্তু তিনি তা গ্রহণ করেননি কারণ তাঁর মতে এই পুরস্কার কেবল সক্রিয় খেলোয়াড়দেরই পাওয়া উচিত, তাই তিনি সম্মান গ্রহণ করতে অস্বীকার করেন।

মিলখা সিংহের ব্যক্তিগত জীবন ও শেষ সময়

মিলখা সিংহের ব্যক্তিগত জীবনও ছিল অত্যন্ত অনুপ্রেরণাদায়ক। তাঁর বিবাহ হয় নির্মল সেনির সাথে, যিনি নিজেই একজন অসাধারণ খেলোয়াড় ছিলেন এবং ভারতীয় মহিলা ভলিবল দলের প্রাক্তন অধিনায়ক ছিলেন। তাঁদের চারটি সন্তান রয়েছে, যার মধ্যে জীব মিলখা সিংহ গল্ফের ক্ষেত্রে একজন বিখ্যাত নাম। এছাড়াও, ১৯৯৯ সালে তিনি একজন শহীদ জওয়ানের ছেলেকে দত্তক নেন, যা তাঁর সংবেদনশীলতা ও সামাজিক দায়িত্ববোধের পরিচয় দেয়।

১৮ জুন ২০২১ সালে মিলখা সিংহের মৃত্যু হয়, তখন তাঁর বয়স ছিল ৯১ বছর। তাঁর মৃত্যু হয় কোভিড-১৯-এর কারণে, যা সে সময় দেশে ব্যাপক মহামারী ছিল। দুঃখের বিষয় হল, তাঁর স্ত্রী নির্মল সেনিও তাঁর মৃত্যুর মাত্র পাঁচ দিন আগে ইহলোক ত্যাগ করেন। এই দম্পতিকে ভারতীয় খেলার ইতিহাসে এক অসাধারণ ও অনুপ্রেরণাদায়ক জুটি হিসেবে স্মরণ করা হবে।

মিলখা সিংহের জীবন সংগ্রাম ও সাফল্যের এক উজ্জ্বল উদাহরণ। তিনি কেবল অনেক পদকই জিতেননি, বরং তাঁর পরিশ্রম ও ধৈর্য্য দিয়ে সমগ্র দেশকে অনুপ্রাণিত করেছেন। আজও তাঁর নামে অনেক স্টেডিয়াম ও খেলাধুলা প্রতিষ্ঠান তৈরি করা হয়েছে, যা নতুন প্রজন্মকে খেলার প্রতি উৎসাহিত করে। মিলখা সিংহের কাহিনী ভারতের খেলার ইতিহাসে সোনার অক্ষরে লেখা থাকবে এবং তিনি সর্বদা একজন অমর খেলা নায়ক হিসেবে স্মরণীয় থাকবেন।

Leave a comment