শিমলা চুক্তি: ইতিহাস, লঙ্ঘন এবং বর্তমান পরিস্থিতি

🎧 Listen in Audio
0:00

শিমলা চুক্তি একটি ঐতিহাসিক চুক্তি যা ১৯৭২ সালে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে স্বাক্ষরিত হয়েছিল। ১৯৭১ সালের যুদ্ধের পর শান্তি স্থাপনের উদ্দেশ্যে এই চুক্তি করা হয়েছিল, যা ছিল একটি নির্ণায়ক যুদ্ধ এবং যার ফলে বাংলাদেশের সৃষ্টি হয়েছিল।

শিমলা চুক্তি: পাকিস্তান কর্তৃক শিমলা চুক্তি বাতিল করার পর এটি আবারো আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে এসেছে। ১৯৭২ সালে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে একটি নির্ণায়ক যুদ্ধের পর দুই দেশের মধ্যে শান্তি স্থাপনের জন্য এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করা হয়েছিল। এখন, যখন দুই দেশের সম্পর্ক আবারো উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে, পাকিস্তানের এই পদক্ষেপ দুই দেশের মধ্যে নতুন জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে।

এই চুক্তি কেবলমাত্র তৎকালীন যুদ্ধের পর শান্তির দিকে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ ছিল না, বরং এর ফলে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়েছিল। এই প্রবন্ধে আমরা শিমলা চুক্তি সম্পর্কে বিস্তারিত জানব, এর গুরুত্ব, এর লঙ্ঘনের ঘটনা এবং পাকিস্তান কর্তৃক এটি বাতিল করার পর উদ্ভূত নতুন পরিস্থিতি সম্পর্কে।

শিমলা চুক্তি: ইতিহাস ও উদ্দেশ্য

ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে ১৯৭১ সালে যে যুদ্ধ হয়েছিল, তাকে পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা সংগ্রাম হিসেবেও জানা যায়, দুই দেশের জন্যই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এই যুদ্ধে ভারত পাকিস্তানকে পরাজিত করে এবং ফলশ্রুতিতে পাকিস্তানের পূর্ব প্রদেশ (বর্তমান বাংলাদেশ) স্বাধীনতা লাভ করে। এই যুদ্ধে ভারতীয় সেনাবাহিনী প্রায় ৯০,০০০ পাকিস্তানি সৈনিককে বন্দী করেছিল।

এর পর দুই দেশের সম্পর্ক উন্নত করার প্রয়োজন অনুভূত হয় এবং শান্তি স্থাপনের জন্য একটি চুক্তি করা হয়। ২ জুলাই ১৯৭২ সালে শিমলায় ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে একটি ঐতিহাসিক চুক্তি হয়, যাকে শিমলা চুক্তি বলা হয়। এই চুক্তিতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এবং পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি জুলফিকার আলী ভুট্টো স্বাক্ষর করেছিলেন।

এই চুক্তি দুই দেশের মধ্যে ভবিষ্যতে যুদ্ধ রোধ এবং শান্তির দিকে আলোচনা প্রসারের উদ্দেশ্যে করা হয়েছিল। এই চুক্তির অধীনে দুই দেশ একে অপরের সার্বভৌমত্ব এবং ভৌগোলিক অখণ্ডতা সম্মান করার শপথ নেয় এবং সিদ্ধান্ত নেয় যে ভবিষ্যতে কোনও বিরোধ আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করা হবে।

শিমলা চুক্তির মূল বিষয়াবলী

  1. সীমান্ত বিরোধের সমাধান: শিমলা চুক্তির অনুসারে দুই দেশ সিদ্ধান্ত নেয় যে ভবিষ্যতে কোনও সীমান্ত বিরোধ বা অন্যান্য বিরোধ সরাসরি আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করা হবে এবং কোনও তৃতীয় পক্ষকে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে গ্রহণ করা হবে না।
  2. যুদ্ধবন্দীদের আদান-প্রদান: এই চুক্তির অধীনে ভারত ও পাকিস্তান যুদ্ধবন্দীদের মুক্ত করে তাদের স্বদেশে ফিরিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল।
  3. সরাসরি আলোচনার সূচনা: এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল যে দুই দেশের মধ্যে নিয়মিত আলোচনা চলবে, যাতে পারস্পরিক বিরোধগুলি শান্তিপূর্ণভাবে সমাধান করা যায়।
  4. সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণ: দুই দেশ এ ব্যাপারে সম্মতি জানায় যে তারা একে অপরের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ডকে উৎসাহিত করবে না এবং একে অপরের সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘন করবে না।
  5. ব্যবসা ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা: চুক্তির অনুসারে দুই দেশের মধ্যে ব্যবসা ও অন্যান্য অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড প্রসারের কথা বলা হয়েছিল, যাতে দুই দেশের নাগরিকদের মধ্যে যোগাযোগ ও আস্থা বৃদ্ধি করা যায়।

শিমলা চুক্তি: পাকিস্তান কর্তৃক লঙ্ঘন

শিমলা চুক্তির লঙ্ঘন পাকিস্তান ১৯৯৯ সালে করেছিল, যখন পাকিস্তানের সেনাবাহিনী জম্মু ও কাশ্মীরের ভারতীয় অঞ্চলে অনুপ্রবেশ করেছিল। এই ঘটনা কার্গিল যুদ্ধ হিসেবে পরিচিত। পাকিস্তানি সৈন্যরা ভারতীয় সীমান্তে ঢুকে ভারতীয় জওয়ানদের সাথে লড়াই করেছিল এবং এই সংঘাতের ফলে ভয়াবহ যুদ্ধ হয়েছিল। এই যুদ্ধে ভারত পাকিস্তানি সৈন্যদের খেদিয়ে দেওয়ার জন্য ‘অপারেশন বিজয়’ চালিয়েছিল এবং পাকিস্তানকে বড় ধরণের পরাজয়ের সম্মুখীন হতে হয়েছিল।

কার্গিল যুদ্ধের সময় পাকিস্তান শিমলা চুক্তির লঙ্ঘন করেছিল, যেখানে এটি সম্মত হয়েছিল যে দুই দেশ তাদের সীমান্তের সম্মান করবে এবং যুদ্ধের মতো পরিস্থিতি থেকে বিরত থাকবে। যদিও এই যুদ্ধের পর পাকিস্তান শিমলা চুক্তি পুনরায় কার্যকর করার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু দুই দেশের মধ্যে আস্থার অভাব এবং কাশ্মীর নিয়ে ক্রমাগত চলমান বিরোধের কারণে এটি সফল হয়নি।

শিমলা চুক্তির প্রভাব ও সীমাবদ্ধতা

শিমলা চুক্তি দুই দেশের জন্য শান্তির দিকে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ ছিল, কিন্তু সময়ের সাথে সাথে দুই দেশের সম্পর্কের অবনতি শুরু হয়। ১৯৮০-এর দশকে সিয়াচেন হিমবাহ নিয়ে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সংঘাত হয়, যা একটি নতুন সীমান্ত বিরোধ হিসেবে দেখা দেয়। ১৯৮৪ সালে ভারত অপারেশন মেঘদূতের অধীনে সিয়াচেনে নিয়ন্ত্রণ স্থাপন করে, যা পাকিস্তান শিমলা চুক্তির লঙ্ঘন বলে মনে করে।

পাকিস্তান অভিযোগ করে যে সিয়াচেন নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি শিমলা চুক্তিতে স্পষ্টভাবে অন্তর্ভুক্ত ছিল না, এবং এর ফলে শিমলা চুক্তির লঙ্ঘন হয়েছিল। এছাড়াও, কাশ্মীর বিষয় নিয়ে দুই দেশের মধ্যে ক্রমাগত উত্তেজনা বজায় ছিল। ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে শান্তির চেষ্টা সত্ত্বেও, পাকিস্তানের পক্ষ থেকে প্রায়শই সন্ত্রাসবাদীদের সমর্থন এবং সীমান্তে অনুপ্রবেশের ঘটনা বৃদ্ধি পেয়েছে, যার ফলে শিমলা চুক্তির উদ্দেশ্য সফল হয়নি।

পাকিস্তান কর্তৃক শিমলা চুক্তি বাতিল করার প্রভাব

পাকিস্তান কর্তৃক শিমলা চুক্তি বাতিল করার সিদ্ধান্তের পর দুই দেশের সম্পর্কে একটি নতুন জটিলতা দেখা দিতে পারে। এই পদক্ষেপ পাকিস্তান কর্তৃক ভারতের বিরুদ্ধে আরও আগ্রাসী নীতি গ্রহণের ইঙ্গিত দেয়, যা দুই দেশের জন্যই উদ্বেগজনক হতে পারে। এছাড়াও, শিমলা চুক্তি বাতিল হওয়ার পর দুই দেশের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক আলোচনার সম্ভাবনা আরও কমে যেতে পারে, যার ফলে আঞ্চলিক স্থায়িত্বের উপর বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে।

Leave a comment