জাভেদ আখতার: জীবন, কর্ম, এবং বিতর্ক

🎧 Listen in Audio
0:00

জাভেদ আখতারকে কারও কাছে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার প্রয়োজন নেই। হিন্দি চলচ্চিত্র জগতের গানগুলিকে নিজের কলমের জাদুতে মুগ্ধ করা জাভেদ আখতারকে কে না চেনে? গজলকে নতুন এবং সরল রূপ দেওয়ার ক্ষেত্রে জাভেদ সাহেবের বড় অবদান রয়েছে। সেলিম খান এবং জাভেদ আখতার 'শোলে', 'জঞ্জির' এবং আরও অনেক কালজয়ী সিনেমার চিত্রনাট্য লিখেছেন। এই জুটিকে সিনেমায় সেলিম-জাভেদ নামেও চেনা হয়। জাভেদ সাহেব ১৯৯৯ সালে পদ্মভূষণ এবং ২০০৭ সালে পদ্মবিভূষণ সম্মানে সম্মানিত হয়েছেন।

জাভেদ আখতারের জন্ম

জাভেদ আখতারের জন্ম ১৭ই জানুয়ারি, ১৯৪৫ সালে গোয়ালিয়রে হয়েছিল। জাভেদের পিতা জান নিসার আখতার ছিলেন উর্দু ভাষার কবি এবং হিন্দি সিনেমার গীতিকার। তাঁর মা সাфия আখতার ছিলেন গায়িকা ও লেখিকা এবং সঙ্গীত শিক্ষিকা। লেখার দক্ষতা জাভেদ উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছিলেন। তাঁর দাদু মুজতার খেরাবাদীও উর্দু ভাষার কবি ছিলেন। ছোটবেলা থেকেই জাভেদ এমন একটি পরিবেশে বড় হয়েছিলেন, যেখানে কবিতা ও সঙ্গীতের ভালো জ্ঞান ছিল। তাঁর বাবা-মা তাঁকে জাদু বলে ডাকতেন। এই নামটি তাঁর পিতার লেখা কবিতার একটি লাইন 'লমহা, লমহা কিসি জাদু কা ফাসানা হোগা' থেকে নেওয়া হয়েছিল। পরে তাঁর নাম জাভেদ রাখা হয়। খুব ছোটবেলায় জাভেদের মা মারা যান এবং তারপর তাঁর বাবা দ্বিতীয়বার বিয়ে করেন।

জাভেদ আখতারের শিক্ষা

জাভেদ আখতারের জন্মের কিছু সময় পরেই তাঁর পরিবার লখনউতে থাকতে শুরু করে। এই কারণে জাভেদ আখতার লখনউ থেকেই তাঁর বিদ্যালয়ের শিক্ষা সম্পূর্ণ করেন। জাভেদ আখতার আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন। এরপর জাভেদ আখতার ভোপালের 'সাফিয়া কলেজ' থেকে স্নাতক হন।

জাভেদ আখতারের কর্মজীবন

নিজের স্বপ্নকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য ১৯৬৪ সালে জাভেদ আখতার মুম্বাই আসেন। কলমের উপর তাঁর দখল ছোটবেলা থেকেই ছিল। এই কারণে তিনি মুম্বাইতে ১০০ টাকার বিনিময়ে সিনেমার সংলাপ লিখতে শুরু করেন। এরই মাঝে মুম্বাইতে তাঁর সাথে সেলিম খানের দেখা হয়। সেলিম খানও সেই সময় সংলাপ লেখক হিসাবে বলিউডে নিজের পরিচয় তৈরি করতে চাইছিলেন। তাই দুজনে একসাথে কাজ করার সিদ্ধান্ত নেন।

১৯৭০ সালে 'আন্দাজ' সিনেমার সংলাপ লেখার পর জাভেদ আখতারের বলিউডে পরিচিতি তৈরি হয়। এরপর জাভেদ আখতার ও সেলিম খান অনেক হিন্দি সিনেমায় সংলাপ লেখার কাজ পান। সেলিম-জাভেদ জুটি 'হাতি মেরে সাথী', 'সীতা ঔর গীতা', 'জঞ্জির' এবং 'ইয়াদোঁ কি বারাত'-এর মতো সুপারহিট সিনেমার সংলাপ লেখেন। বিশেষ করে 'জঞ্জির' সিনেমায় তাঁদের লেখা সংলাপ খুব জনপ্রিয় হয়েছিল। এই সিনেমাটি সুপারহিট প্রমাণিত হয়। 'শোলে' জাভেদ আখতার ও সেলিম খানের কর্মজীবনের সবচেয়ে বড় সিনেমা হিসাবে প্রমাণিত হয়। এই সিনেমাটি সেই সময়ের সবচেয়ে বড় হিট সিনেমা ছিল। আজও এই সিনেমার নামে অনেক বড় রেকর্ড রয়েছে। এই সিনেমার সংলাপগুলি খুব জনপ্রিয় হয়েছিল। এই সিনেমার মাধ্যমে জাভেদ আখতার ও সেলিম খান নতুন পরিচিতি পান। এরপরও এই জুটি অনেক সিনেমায় একসঙ্গে কাজ করে অনেক ভালো কাজ করেছেন।

জাভেদ আখতার ও সেলিম খানের জুটি প্রায় ২৪টি সিনেমায় একসঙ্গে কাজ করেছেন, যার মধ্যে প্রায় ২০টি সিনেমাই ব্লকবাস্টার হিট হয়েছিল। কিন্তু ১৯৮৭ সালে মুক্তি পাওয়া 'মিস্টার ইন্ডিয়া' সিনেমার পর জাভেদ আখতার ও সেলিম খানের জুটি ভেঙে যায়। এরপরও জাভেদ আখতার সিনেমায় সংলাপ লেখার কাজ চালিয়ে যান। সিনেমায় সংলাপ লেখার পাশাপাশি জাভেদ আখতার একের পর এক সুপারহিট গানও লিখেছেন। ১৯৯৪ সালে জাভেদ আখতারের লেখা গান 'এক লড়কি কো দেখা তো অ্যায়সা লাগা' গানটি মানুষ খুব পছন্দ করেছিল। এই গানের জন্য জাভেদ আখতার শ্রেষ্ঠ গীতিকারের ফিল্মফেয়ার পুরস্কারে সম্মানিত হয়েছিলেন।

এছাড়াও জাভেদ আখতার 'সন্দেশে আতে হ্যায়', 'ঘর সে নিকলতে হি', 'পাঞ্চি নদিয়া পবন কে ঝোঁকে', 'সুন মিতওয়া', 'কল হো না হো', 'তেরে লিয়ে' গান লেখার জন্য সেরা গীতিকারের পুরস্কারে সম্মানিত হয়েছেন। এছাড়াও জাভেদ আখতার তাঁর গানের জন্য ৫ বার জাতীয় পুরস্কারেও সম্মানিত হয়েছেন।

জাভেদ আখতারের স্ত্রী

সিনেমা 'সীতা অর গীতা' নির্মাণের সময় জাভেদ আখতারের সাথে হানি ইরানির দেখা হয়। ধীরে ধীরে দুজনের মধ্যে প্রেম হয় এবং খুব শীঘ্রই জাভেদ আখতার হানি ইরানিকে বিয়ে করেন। হানি ইরানির সাথে জাভেদ আখতারের দুটি সন্তান হয়। জাভেদ আখতারের ছেলেমেয়ের নাম ফারহান আখতার ও জোয়া আখতার। জাভেদ আখতার ও হানি ইরানির সম্পর্ক বেশি দিন টেকেনি এবং ১৯৭৮ সালে তাঁদের বিবাহবিচ্ছেদ হয়ে যায়।

মিডিয়া রিপোর্ট অনুযায়ী, হানি ইরানি জাভেদ আখতারের শাবানা আজমির সাথে ঘনিষ্ঠতার ব্যাপারে জানার পর জাভেদ আখতারকে ডিভোর্স দিয়েছিলেন। তাঁর কর্মজীবনের শুরুতে জাভেদ আখতার, শাবানা আজমির বাবা কাইফি আজমির সহকারী ছিলেন। ১৯৮৪ সালে জাভেদ আখতার শাবানা আজমিকে বিয়ে করেন।

জাভেদ আখতারের বিতর্ক

জাভেদ আখতার সিএএ-এর বিরোধিতায় মোদী সরকারকে ঘিরে বলেছিলেন, 'ভারত যদি সকল নিপীড়িতদের নাগরিকত্ব দিচ্ছে, তাহলে পাকিস্তানে বসবাসকারী শিয়াদেরও নাগরিকত্ব দেওয়া উচিত।'

জাভেদ আখতার বলিউড অভিনেত্রী কঙ্গনা রানাউতের সাথে বিতর্কের কারণেও চর্চায় এসেছিলেন। কঙ্গনা জাভেদ আখতারের উপর অভিযোগ করে বলেছিলেন, 'হৃতিক রোশনের সাথে বিতর্কের সময় জাভেদ আখতার তাঁর উপর চিৎকার করে হৃতিকের পরিবারের কাছে ক্ষমা চাইতে বলেছিলেন।'

দিল্লি দাঙ্গার সময় জাভেদ আখতার অভিযুক্ত তাহিরের বিরুদ্ধে হওয়া পদক্ষেপকে ধর্মের সাথে যুক্ত করে দেখেছিলেন। এই মামলায় তাঁর বিরুদ্ধে এফআইআরও দায়ের করা হয়েছিল।

২০২১ সালে জাভেদ আখতার আরএসএস-এর তুলনা তালিবানের সাথে করেছিলেন। এই বিষয় নিয়েও অনেক বিতর্ক হয়েছিল।

জাভেদ আখতারের সম্মান ও পুরস্কার

১৯৯৪ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত সিনেমা "১৯৪২: এ লাভ স্টোরি"-এর গান 'এক লড়কি কো দেখা তো অ্যায়সা লাগা'-এর জন্য।

১৯৯৬ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত সিনেমা 'পাপা কেহতে হ্যায়'-এর গান 'ঘর সে নিকলতে হি' (১৯৯৭)-এর জন্য।

২০০০ সালে সিনেমা 'বর্ডার'-এর গান 'সন্দেশে আতে হ্যায়' -এর জন্য।

সিনেমা 'রিফিউজি'-এর গান 'পাঞ্চি নদিয়া পবন কে ঝোঁকে' (২০০১)-এর জন্য।

সিনেমা 'লগান'-এর 'সুন মিতওয়া..' (২০০৩)-এর জন্য।

সিনেমা 'কল হো না হো' (২০০৪)-এর 'কল হো না হো'-এর জন্য।

সিনেমা 'বীর জারা'-এর 'তেরে লিয়ে...'-এর জন্য।

নাগরিক সম্মান

পদ্মশ্রী (১৯৯৯)

পদ্মভূষণ (২০০৭)

জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার (সেরা গীতিকার)

১৯৯৬ সালে সিনেমা 'সাজ'-এর জন্য।

১৯৯৭ সালে 'বর্ডার'-এর জন্য।

১৯৯৮ সালে 'গড মাদার'-এর জন্য।

২০০০ সালে সিনেমা 'রিফিউজি'-এর জন্য।

২০০১ সালে সিনেমা 'লগান'-এর জন্য।

Leave a comment