যদি আপনি প্রতিদিন দাঁত ব্রাশ করার সময় মাড়ি থেকে রক্তপাতের সমস্যার সম্মুখীন হন, তাহলে তা উপেক্ষা করা আপনার স্বাস্থ্যের জন্য বিপজ্জনক হতে পারে। প্রায়শই লোকেরা এই অবস্থাকে সাধারণ বলে মনে করে উপেক্ষা করে, কিন্তু এটি ইঙ্গিত করতে পারে যে আপনার শরীরে কোন গভীর এবং গুরুতর রোগ লুকিয়ে আছে।
এই সমস্যা কেবল মাড়িতে সীমাবদ্ধ থাকে না, বরং এটি শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা থেকে শুরু করে হৃদয়, হাড় এবং সম্পূর্ণ স্বাস্থ্যকে প্রভাবিত করতে পারে। আসুন জেনে নিই দাঁত ব্রাশ করার সময় মাড়ি থেকে রক্তপাতের সাথে কোন চারটি গুরুতর রোগের সম্পর্ক থাকতে পারে:
১. জিঞ্জিভাইটিস: মাড়ির প্রদাহ এবং সংক্রমণ
মাড়ি থেকে রক্তপাত সাধারণত জিঞ্জিভাইটিস নামক রোগের প্রথম লক্ষণ। এটি মাড়ির একটি প্রাথমিক পর্যায়ের সংক্রমণ, যা দাঁতে জমে থাকা প্লাক (Plaque) এবং ব্যাকটেরিয়ার কারণে হয়। যখন আপনি ব্রাশ করেন, তখন এই প্লাক মাড়িকে ক্ষতি করে, ফলে সেখানে প্রদাহ হয় এবং রক্তপাত শুরু হয়।
লক্ষণ
- ব্রাশ করার সময় রক্তপাত
- মাড়িতে লালচেভাব এবং প্রদাহ
- হালকা জ্বালা বা চুলকানি
- মুখের দুর্গন্ধ
যদি সময়মতো এর চিকিৎসা না করা হয়, তাহলে জিঞ্জিভাইটিস ধীরে ধীরে গুরুতর আকার ধারণ করতে পারে এবং এটি পরবর্তী পর্যায়ে অর্থাৎ পেরিওডোন্টাইটিসে পরিণত হতে পারে।
২. পেরিওডোন্টাইটিস: হাড়ে ছড়িয়ে পড়া রোগ
জিঞ্জিভাইটিস উপেক্ষা করলে এটি পেরিওডোন্টাইটিসে পরিণত হয়। এটি কেবল মাড়ির সমস্যা নয়, বরং এটি আপনার চোয়ালের হাড়কেও প্রভাবিত করতে পারে। এই অবস্থায় ব্যাকটেরিয়া গভীর মাড়িতে পৌঁছে দাঁতের শিকড়কে ক্ষতি করে।
লক্ষণ
- মাড়ি থেকে ক্রমাগত রক্তপাত
- মুখ থেকে তীব্র দুর্গন্ধ
- দাঁতের নড়াচড়া বা ঢিলা হওয়া
- মাড়ির সঙ্কোচন
পেরিওডোন্টাইটিসের প্রভাব কেবল দাঁতে সীমাবদ্ধ থাকে না, বরং এটি হৃদরোগ, ডায়াবেটিস এবং অকাল প্রসবের মতো অবস্থাকেও সৃষ্টি করতে পারে। অতএব, যদি মাড়ি থেকে রক্তপাত দীর্ঘদিন ধরে চলে, তাহলে অবশ্যই দন্ত চিকিৎসকের সাথে পরামর্শ করুন।
৩. ভিটামিনের অভাব: শরীরে পুষ্টির ভারসাম্যহীনতার ইঙ্গিত
মাড়ি থেকে রক্তপাত সর্বদা মৌখিক স্বাস্থ্যের সাথে সম্পর্কিত সমস্যার ফল নয়, বরং এটি শরীরে কিছু প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদানের অভাবের ইঙ্গিতও হতে পারে। বিশেষ করে ভিটামিন সি এবং ভিটামিন কে-এর অভাব মাড়িকে দুর্বল করে তোলে।
ভিটামিন সি-এর অভাব
- এটিকে স্কার্ভি নামক রোগের সাথে যুক্ত করা হয়।
- শরীরে টিস্যু মেরামত এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়।
- মাড়ি দুর্বল হয়ে সহজেই রক্তপাত করে।
ভিটামিন কে-এর অভাব
- এটি রক্ত জমাট বাঁধতে সাহায্য করে।
- এর অভাব থেকে সামান্য আঘাত বা ব্রাশ করার ফলেও রক্তপাত হয়।
সমাধান
- আমলকি, কমলালেবু, লেবু, সবুজ পাতাযুক্ত শাক-সবজি এবং ডাল আপনার খাদ্যতালিকায় অন্তর্ভুক্ত করুন।
- সময় সময় রক্ত পরীক্ষা করে পুষ্টি উপাদানের অবস্থা জেনে নিন।
৪. হরমোনের পরিবর্তন: নারীদের স্বাস্থ্যের সাথে সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ দিক
নারীদের মধ্যে হরমোনের উত্থান-পতন অনেক সময় মৌখিক স্বাস্থ্যের উপরও প্রভাব ফেলে। গর্ভাবস্থা, মাসিক ধর্ম বা মেনোপজের সময় ইস্ট্রোজেন এবং প্রোজেস্টেরন এর মতো হরমোনের পরিবর্তন মাড়িকে আরও সংবেদনশীল করে তোলে।
লক্ষণ
- ব্রাশ করার সময় মাড়ি থেকে রক্তপাত
- মাড়িতে হালকা জ্বালা বা প্রদাহ
- দাঁতের কাছে ব্যথা
বিশেষজ্ঞদের মতে, এই অবস্থা অস্থায়ী, কিন্তু এটিকে উপেক্ষা করা ঠিক নয়। গর্ভবতী মহিলাদের বিশেষ করে তাদের মৌখিক স্বাস্থ্যের পরীক্ষা করিয়ে চলতে হবে।
মাড়ি থেকে রক্তপাত: কখন বুঝবেন ডাক্তারের সাথে দেখা করা জরুরি?
যদি আপনার নিম্নলিখিত লক্ষণগুলি বারবার দেখা দেয়, তাহলে অবিলম্বে দন্ত বা স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের সাথে যোগাযোগ করুন:
- ব্রাশ বা ফ্লস করার সময় প্রতিবারই রক্তপাত
- মাড়িতে ক্রমাগত প্রদাহ
- মুখ থেকে তীব্র দুর্গন্ধ
- দাঁতের নড়াচড়া
- খাবার খাওয়ার সময় অসুবিধা বা ব্যথা
কিভাবে মাড়ির যত্ন নেবেন? কিছু প্রয়োজনীয় উপায়
- দাঁতের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা নিয়মিত করুন - দিনে দুবার ব্রাশ করুন এবং সপ্তাহে ৩-৪ বার ফ্লস করার অভ্যাস করুন।
- নরম ব্রিসেলযুক্ত টুথব্রাশ ব্যবহার করুন - শক্ত ব্রাশ মাড়িকে ক্ষতি করতে পারে।
- মাউথওয়াশ ব্যবহার করুন - অ্যান্টিসেপটিক মাউথওয়াশ ব্যাকটেরিয়া ধ্বংস করতে পারে।
- সুস্থ খাবার খান - ভিটামিন এবং খনিজ পদার্থে সমৃদ্ধ খাবার মাড়িকে শক্তিশালী রাখে।
- নিয়মিত দন্ত পরীক্ষা করিয়ে নিন - প্রতি ৬ মাস অন্তর একবার দন্ত চিকিৎসকের কাছে পরীক্ষা করানো আদর্শ বলে মনে করা হয়।
মাড়ি থেকে রক্তপাত একটি ছোট এবং সাধারণ মনে হতে পারে, কিন্তু এর পিছনে গুরুতর রোগ লুকিয়ে থাকতে পারে। শরীরের প্রতিটি অঙ্গ, বিশেষ করে দাঁত এবং মাড়ি, আপনার সম্পূর্ণ স্বাস্থ্যের ইঙ্গিত দেয়। যদি আপনি এই সমস্যাটি সময়মতো চিনতে পারেন এবং তার চিকিৎসা করাতে পারেন, তাহলে আপনি কেবল দাঁতই নয়, পুরো শরীরকেও সুস্থ রাখতে পারবেন।