হিন্দু ধর্মে প্রতিটি পূর্ণিমা তিথিরই বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে, কিন্তু জ্যৈষ্ঠ মাসের পূর্ণিমা বিশেষ করে পুণ্যময় এবং আধ্যাত্মিক উন্নতির সুযোগ হিসেবে বিবেচিত হয়। এই তিথি কেবল দেব-দেবীদের কৃপা লাভের সুযোগ নয়, পিতৃদের তর্পণ এবং মোক্ষের কামনার জন্যও শ্রেষ্ঠ দিন। ২০২৫ সালে জ্যৈষ্ঠ পূর্ণিমা নিয়ে মানুষের মনে তিথি ও ব্রতের সঠিক তথ্য নিয়ে কিছুটা দ্বিধা রয়েছে।
জ্যৈষ্ঠ পূর্ণিমা ২০২৫: তিথি ও শুভ মুহূর্ত
পঞ্চাঙ্গ অনুসারে, জ্যৈষ্ঠ মাসের পূর্ণিমা তিথির সূচনা হচ্ছে ১০ জুন ২০২৫ সাল, সকাল ১১:৩৯ মিনিটে এবং এর সমাপ্তি হবে ১১ জুন ২০২৫ সাল, দুপুর ১:১৫ মিনিটে। যেহেতু ব্রত ও পূজার দিক থেকে উদয় তিথিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়, তাই ১১ জুন ২০২৫ (বুধবার) জ্যৈষ্ঠ পূর্ণিমার ব্রত পালন করা হবে।
এই দিন ব্রত ও পূজনের সংকল্প সকাল ৫:০০ টা থেকে ৭:০০ টার মধ্যে নেওয়া যেতে পারে। পূজা-পাঠ, দান-পুণ্য, চন্দ্রমার দর্শন এবং লক্ষ্মী পূজা ইত্যাদি কাজ সকাল ৬ টা থেকে রাত ৮ টা পর্যন্ত করা যেতে পারে।
ব্রত ও পূজন বিধি
জ্যৈষ্ঠ পূর্ণিমার দিন প্রাতঃকালে উঠে স্নান করে পবিত্র মনে ব্রতের সংকল্প করুন। যদি সম্ভব হয়, তাহলে কোনও পবিত্র নদী বা তীর্থে স্নান করুন, অন্যথায় ঘরেই গঙ্গাজল মিশিয়ে স্নান করুন।
পূজন সামগ্রী: দীপক, ধূপ, ফুল, রোলী, অক্ষত, জল কলস, মিঠাই, সাদা কাপড়, তুলসী পাতা, চন্দ্রমার পূজার জন্য সাদা চন্দন এবং দুধ।
পূজন বিধি
- প্রথমে ভগবান বিষ্ণু, মা লক্ষ্মী এবং চন্দ্রমার প্রতিমা বা ছবির সামনে দীপ জ্বালান।
- গঙ্গাজল দিয়ে তাঁদের অভিষেক করুন।
- চন্দন, অক্ষত, ফুল, ধূপ এবং নৈবেদ্য অর্পণ করুন।
- ‘ॐ सोमाय नमः’ মন্ত্র জপ করতে করতে চন্দ্রমার বিশেষ পূজা করুন।
- রাতে চন্দ্রদর্শন করে তাঁকে অর্ঘ্য দিয়ে ব্রতের সমাপ্তি করুন।
জ্যৈষ্ঠ পূর্ণিমার ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক গুরুত্ব
জ্যৈষ্ঠ পূর্ণিমার ব্রত হিন্দু ধর্মে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই দিন চন্দ্রমার পূজার সাথে সাথে পিতৃদের তর্পণের জন্যও বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। পূর্ণিমার দিন চন্দ্রমার দর্শন করলে মানসিক শান্তি পাওয়া যায় এবং ব্যক্তির জীবনে সুখ-সমৃদ্ধি আসে। যারা মানসিক চাপ, চন্দ্র দোষ বা আবেগগত সমস্যায় ভোগেন, তাদের জন্য এই দিন বিশেষ ফলপ্রসূ।
এই দিন করা সাধনা, তপস্যা এবং জপ দ্বারা মন ও আত্মার শুদ্ধি হয়। যোগ ও ধ্যানের অনুশীলন দ্বারা আধ্যাত্মিক উন্নতি হয় এবং ব্যক্তির মধ্যে ইতিবাচক শক্তির সংযোগ ঘটে। জ্যৈষ্ঠ পূর্ণিমার দিন ধর্মীয় গ্রন্থের অধ্যয়ন, দান-পুণ্য এবং পবিত্র নদীতে স্নান করাও অত্যন্ত উপকারী বলে মনে করা হয়।
জ্যৈষ্ঠ পূর্ণিমার দিন কী করবেন?
- চন্দ্র পূজা: চন্দ্রমাকে শান্তি ও মনের স্থিরতার প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এই দিন চন্দ্রমার পূজা ও অর্ঘ্য দেওয়া মানসিক চাপ দূর করে।
- পিতৃদের তর্পণ: আপনার পূর্বপুরুষদের শ্রদ্ধাঞ্জলি জানানোর এটি একটি উত্তম সময়। পিন্ডদান ও তর্পণ করলে পিতৃদোষ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।
- দান-পুণ্য: জল, ছাতা, ফল, বস্ত্র, অন্ন, চিনি ইত্যাদির দান করলে অক্ষয় পুণ্যের প্রাপ্তি হয়।
- ধ্যান ও স্বাধ্যায়: এই দিন ধর্মীয় গ্রন্থের পাঠ-পাঠন করুন এবং মৌন থাকা অবস্থায় ধ্যান সাধনা করুন। এটি আত্মিক শক্তি বৃদ্ধি করে।
- ব্রত পালন: পূর্ণিমার দিন উপবাস করা শরীর ও মন উভয়কেই শুদ্ধ করে।
কী করবেন না?
- এই দিন মাংস-মদ্য, পেঁয়াজ-রসুন এবং অন্যান্য তামসিক খাবার থেকে বিরত থাকুন।
- বাণীতে কটুতা এবং মনে ক্রোধ রাখবেন না। শান্ত ও সংযমী আচরণ এই দিন বিশেষ ফলপ্রসূ হয়।
- রাতে অতিরিক্ত বিলাসিতা বা নেতিবাচক চিন্তা থেকে বিরত থাকুন, কারণ এই দিন আধ্যাত্মিক শক্তিতে পরিপূর্ণ।
জ্যৈষ্ঠ পূর্ণিমা কেন বিশেষ?
জ্যৈষ্ঠ মাস হিন্দু ক্যালেন্ডারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মাস হিসেবে বিবেচিত হয় এবং এই মাসের পূর্ণিমার গুরুত্বও অত্যধিক। এই দিন প্রকৃতি ও চন্দ্রমার মধ্যে সমন্বয়ের প্রতীক। জ্যৈষ্ঠ পূর্ণিমায় করা পূজা ব্যক্তির মনকে শান্ত করে এবং জীবনে সমৃদ্ধি ও সৌভাগ্য আনে। সাথে সাথে, এই দিন আত্মনির্ভরশীলতা এবং আধ্যাত্মিক সচেতনতার বার্তা দেয়।
এই দিন বটবৃক্ষের পূজা করলে পরিবারে সুখ আসে এবং বটসাবিত্রী ব্রত করলে সুহাগিনা স্ত্রীদের আয়ু এবং সুখ-শান্তি বজায় থাকে। পিতৃদের তর্পণ করে তাঁদের আশীর্বাদে পরিবারে সুখ-শান্তি ও সমৃদ্ধি আসে।
জ্যৈষ্ঠ পূর্ণিমার উৎসব ভক্তদের জন্য আধ্যাত্ম ও শ্রদ্ধার সংমিশ্রণ। ১১ জুন ২০২৫ এই তিথি আসছে, যখন আপনি পূজা, দান ও ব্রতের মাধ্যমে দেব-দেবী ও পিতৃদের কৃপা লাভ করতে পারেন। এই দিন কেবল ধর্মীয়ভাবেই উপকারী নয়, মানসিক শান্তি ও আধ্যাত্মিক ভারসাম্যের জন্যও বিশেষ ফলপ্রসূ।