গুরু রবিদাস জয়ন্তী মাঘ মাসের পূর্ণিমা তিথিতে পালিত হয়, যা সাধু গুরু রবিদাসের জন্মদিনের প্রতীক। রৈদাস পন্থ ধর্মের অনুসারীদের কাছে এই দিনটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই উপলক্ষে গুরু রবিদাসের অমৃতবাণীর পাঠ করা হয় এবং তাঁর সম্মানে নগরকীর্তন (সঙ্গীতময় শোভাযাত্রা) বের করা হয়। ভক্তরা এই দিনে পবিত্র নদীতে স্নান করেন এবং মন্দিরে গুরুর প্রতিমার পূজা করেন।
প্রতি বছর বারাণসীর সীতারাম গোবর্ধনপুরস্থিত শ্রী গুরু রবিদাস জন্মস্থান মন্দিরে একটি ঐশ্বর্যময় উৎসবের আয়োজন করা হয়, যাতে দেশ-বিদেশ থেকে লক্ষ লক্ষ ভক্ত অংশগ্রহণ করেন। এই আয়োজন সাধু গুরু রবিদাসের চিন্তাধারা ও শিক্ষাগুলি পুনরায় স্মরণ করার সুযোগ করে দেয়। তাঁর শিক্ষাগুলি সামাজিক সমতা, আধ্যাত্মিকতা এবং মানবতার মূল্যবোধের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে।
কখন জন্মগ্রহণ করেছিলেন গুরু রবিদাস?
গুরু রবিদাসের জন্ম হয়েছিল ১৫শ শতাব্দীতে, ১৩৭৭ বিক্রমী সংবৎ (প্রায় ১৩৯৮ খ্রিস্টাব্দে) বারাণসীর সীতারাম গোবর্ধন গ্রামে। তিনি এক চর্মকার পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তাঁর পিতার নাম ছিল রঘু শ্রী (যিনি জুতা তৈরি করতেন) এবং মাতার নাম ছিল ঘুরবিনিয়া (বা করম দেবী)। বাল্যকাল থেকেই গুরু রবিদাস ধার্মিক প্রকৃতির ছিলেন এবং সাধু-সন্তের সঙ্গ তাঁর অত্যন্ত প্রিয় ছিল।
গ্রামের এক স্থানীয় গুরুর কাছে তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা হয়, কিন্তু তাঁর জ্ঞান ও আধ্যাত্মিক বুদ্ধিমত্তা ছিল সহজাত। তিনি সামাজিক বন্ধন ও জাতি-ব্যবস্থার ঊর্ধ্বে উঠে মানবিক ঐক্য ও আধ্যাত্মিক প্রেমের বার্তা দিয়েছিলেন। গুরু রবিদাস তাঁর উপদেশের মাধ্যমে সমাজে সমতা, ভক্তি ও মানবতার আদর্শের প্রচার করেছিলেন। তাঁর চিন্তাধারা আজও লক্ষ লক্ষ অনুসারীর কাছে অনুপ্রেরণার উৎস।
গুরু রবিদাস জয়ন্তীর গুরুত্ব
রবিদাস জয়ন্তী গুরু রবিদাসের জন্মের প্রতীক এবং তাঁর অনুসারীদের কাছে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। গুরু রবিদাস জাতিবাদ ও অন্ধবিশ্বাসের বিরুদ্ধে তাঁর কাজের জন্য পূজ্য। একজন আধ্যাত্মিক ব্যক্তি হিসেবে তিনি সামাজিক সমতা এবং ভক্তিমার্গের প্রচার করেছিলেন। তাঁর উপদেশ ভক্তি আন্দোলনের অংশ হয়ে ওঠে এবং তিনি সাধু কবিরের ঘনিষ্ঠ বন্ধু হিসেবেও পরিচিত।
এই দিনে ভক্তগণ পবিত্র নদীতে স্নান করেন এবং গুরু রবিদাসের জীবনের সাথে জড়িত মহৎ ঘটনাগুলি স্মরণ করে অনুপ্রেরণা লাভ করেন। ভক্তরা তাঁর জন্মস্থান, সীতারাম গোবর্ধনপুর (বারাণসী)তে গিয়ে ঐশ্বর্যময় উৎসব পালন করেন। এই সময় তাঁর ছবিসহ শোভাযাত্রা বের করা হয় এবং কীর্তন-ভজনের আয়োজন করা হয়। রৈদাস পন্থের অনুসারীদের সাথে সাথে কবিরপন্থী, শিখ এবং অন্যান্য গুরুদের অনুসারীরাও এই দিনে বিশেষ শ্রদ্ধা প্রদর্শন করেন। গুরু রবিদাস জাতিপ্রথা নির্মূলের জন্য গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছিলেন, যার ফলে তিনি আজও সমাজ সংস্কারক ও সাধুদের মধ্যে একটি উচ্চ স্থান অধিকার করেন।
রবিদাসের সাধু হওয়ার গল্প
গুরু রবিদাসের সাধু হওয়ার গল্প অত্যন্ত অনুপ্রেরণাদায়ক। বলা হয়, শৈশব থেকেই তাঁর মধ্যে অসাধারণ ও অলৌকিক ক্ষমতা বিদ্যমান ছিল। এক কথার অনুসারে, যখন তিনি সাথীদের সাথে খেলছিলেন, একদিন তাঁর এক বন্ধু খেলতে আসেনি। রবিদাস যখন তাকে খুঁজতে যান, তখন জানতে পারেন যে সেই বন্ধুর মৃত্যু হয়েছে।
এই দুঃখজনক সংবাদে ব্যথিত হয়ে রবিদাস তার বন্ধুর কাছে গিয়ে বলেন, "উঠো, এটা ঘুমানোর সময় নয়। আমার সাথে খেলতে চলো।" তাঁর এই পবিত্র বাক্যে তার মৃত বন্ধু জীবিত হয়ে ওঠে। এই ঘটনা তাঁর দিব্য গুণ ও অলৌকিক ক্ষমতার প্রমাণ বলে মনে করা হয়।
তবে, গুরু রবিদাস তাঁর ক্ষমতা ভৌত অলৌকিক কাজ দেখানোর পরিবর্তে ঈশ্বর ভক্তি ও সমাজসেবায় নিবেদন করেছিলেন। তিনি ভগবান রাম ও কৃষ্ণের ভক্তিতে মগ্ন ছিলেন। তাঁর নিঃস্বার্থ সেবা, আধ্যাত্মিক উপদেশ এবং সমাজ সংস্কারের কাজের ফলে মানুষ তাঁকে একজন সাধু হিসেবে মনে করতে শুরু করে। তাঁর জীবন ভক্তি, করুণা ও সমতার প্রতীক হয়ে ওঠে।