হিন্দু ধর্মে ব্রত ও উৎসবের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে, বিশেষ করে সেগুলো যা নারীশক্তি, ত্যাগ এবং আস্থার প্রতীক। এমনই একটি উৎসব হল বট পূর্ণিমা ব্রত, যা সুহাগিন নারীরা তাদের স্বামীর দীর্ঘায়ু, সুস্বাস্থ্য এবং সৌভাগ্যের জন্য পালন করে। এই ব্রত যত পবিত্র, ততটাই কঠিনও বলে মনে করা হয়, কারণ এটি নিরজলা উপবাস হিসেবে পালন করা হয়, অর্থাৎ সারাদিন জল গ্রহণ না করে উপবাস।
বট সাবিত্রী ব্রত বছরে দুইবার আসে—একবার জ্যৈষ্ঠ অমাবস্যায় এবং অন্যবার জ্যৈষ্ঠ পূর্ণিমায়। যেখানে উত্তর ভারতের অনেক অঞ্চলে অমাবস্যায় এই ব্রত প্রচলিত, সেখানে মহারাষ্ট্র, গুজরাট, গোয়া এবং উত্তরাখণ্ডে বট পূর্ণিমার ব্রত বিশেষ শ্রদ্ধা এবং ঐতিহ্যের সাথে পালিত হয়।
বট পূর্ণিমা ব্রত ২০২৫-এর তারিখ ও মুহূর্ত
২০২৫ সালে বট পূর্ণিমার উৎসব ১০ জুন, মঙ্গলবার পালিত হবে। এই দিনে নারীরা সকাল থেকে নিরজলা ব্রত পালন করে বটবৃক্ষ (বড় গাছ) পূজা করে এবং সাবিত্রী-সত্যবানের কাহিনী স্মরণ করে।
- জ্যৈষ্ঠ পূর্ণিমা তিথি আরম্ভ: ১০ জুন ২০২৫, সকাল ১১:৩৫ টা
- জ্যৈষ্ঠ পূর্ণিমা তিথি সমাপ্তি: ১১ জুন ২০২৫, দুপুর ১:১৩ টা
- বট পূজার শুভ মুহূর্ত: ১০ জুন সকাল ৮:৫২ টা থেকে দুপুর ২:০৫ টা পর্যন্ত
- স্নান ও দানের সময়: ১১ জুন সকাল ৪:০২ টা থেকে ৪:৪২ টা পর্যন্ত
- চন্দ্রোদয় সময়: ১০ জুন সন্ধ্যা ৬:৪৫ টা
মনে রাখবেন যে ব্রত পালন তিথির আরম্ভের ভিত্তিতে ১০ জুন করা হবে, তবে ঐতিহ্যগতভাবে স্নান, দান এবং অন্যান্য পুণ্যকর্ম ১১ জুন পূর্ণিমার সমাপ্তি কালে হবে।
বট পূর্ণিমার পৌরাণিক গুরুত্ব
বট পূর্ণিমা ব্রতের কাহিনী মহাভারতের বনপর্ব থেকে নেওয়া হয়েছে, যেখানে দেবী সাবিত্রী তার স্বামী সত্যবানের প্রাণ যমরাজ থেকে ফিরে পেয়েছিলেন। যখন সত্যবানের মৃত্যু হয়, তখন সাবিত্রী তাকে বটবৃক্ষের নিচে শুইয়ে রেখে বাঁশের পাখা দিয়ে তাকে বাতাস দিয়েছিলেন। তার দৃঢ় ভক্তি এবং ব্রতের শক্তির ফলে যমরাজও দ্রবীভূত হয়েছিলেন এবং সত্যবানের প্রাণ ফিরে এসেছিল।
এই ঘটনা নারীশক্তি, সমর্পণ এবং বিশ্বাসের প্রতীক হয়ে উঠেছে এবং তখন থেকেই এই দিন বটবৃক্ষের নিচে পূজার ঐতিহ্য চলে আসছে। নারীরা এই ঐতিহ্য বজায় রেখে তাদের স্বামীর জীবনের মঙ্গলকামনা করে।
বট পূর্ণিমা ব্রতের পূজা পদ্ধতি
বট পূর্ণিমার দিনের পূজা পদ্ধতি পূর্ণ শ্রদ্ধা এবং নিয়মের সাথে করা হয়। এখানে বিস্তারিত পূজা পদ্ধতি দেওয়া হল:
- প্রাতঃকাল স্নান ও সংকল্প: সূর্যোদয়ের পূর্বে উঠে স্নান করুন, পরিষ্কার বস্ত্র পরিধান করুন এবং ব্রতের সংকল্প করুন – আমি ফলানো নামে স্বামীর দীর্ঘায়ু ও সৌভাগ্যের জন্য বট পূর্ণিমা ব্রত পালন করছি।
- পূজা সামগ্রী প্রস্তুত করুন: পূজার থালায় রাখুন – জলের কলস, রোলী, চাল, ফুল, দুধ, ধূপ, দীপ, মেহেদী, চুড়ি, বিঁদি, সিঁদুর, লাল সুতির সুতা, মিষ্টান্ন এবং সাবিত্রী-সত্যবানের ছবি বা মূর্তি।
- বটবৃক্ষের কাছে গিয়ে পূজা করুন
- বটবৃক্ষে জল অর্পণ করুন
- দুধ, রোলী, চাল এবং ফুল অর্পণ করুন
- লাল সুতা বা কাঁচা সুতির সুতা নিয়ে বটবৃক্ষের চারিদিকে ৭, ১১ অথবা ২১ বার প্রদক্ষিণ করুন
- প্রদক্ষিণ করার সময় বট সাবিত্রী মাতার জয় এবং "সত্যবান সাবিত্রীর জয়" জপ করুন
কথাবাচন ও আরতি
- সাবিত্রী-সত্যবানের কথা শুনুন অথবা পড়ুন। এরপর দীপ জ্বালিয়ে বটবৃক্ষের আরতি করুন। শেষে আপনার ব্রতের ফল চেয়ে পরিবারের সুখ-শান্তির জন্য প্রার্থনা করুন।
- স্বামীর সেবা ও আশীর্বাদ: ঐতিহ্য অনুযায়ী নারীরা ঘরে ফিরে স্বামীর চরণ ধোয়, তাকে পাখা ঝাড়ে এবং তার আশীর্বাদ গ্রহণ করে।
- সৌভাগ্যবতী আশীর্বাদ এবং সামগ্রীর আদান-প্রদান: শেষে সুহাগিন নারীরা পরস্পরকে ‘সৌভাগ্যবতী ভব’ আশীর্বাদ করে এবং পূজার সামগ্রী যেমন চুড়ি, সিঁদুর, মেহেদী, বিঁদি ইত্যাদি পরস্পরকে উপহার হিসেবে দেয়।
কেন বিশেষ বটবৃক্ষ?
বটবৃক্ষ (বড়) ভারতীয় সংস্কৃতিতে অমৃত সমান বলে মনে করা হয়। এর উল্লেখ পুরাণ ও আয়ুর্বেদিক গ্রন্থেও আছে। একে ত্রিদেবের বাস বলা হয় – ব্রহ্মা এর শিকড়ে, বিষ্ণু কান্ডে এবং শিব এর শাখায় বাস করেন। তাই বটবৃক্ষের পূজা করলে সকল দেব-দেবীর আশীর্বাদ পাওয়া যায় বলে মনে করা হয়।
ব্রতের বৈজ্ঞানিক দিক
- বটবৃক্ষ অক্সিজেনের সবচেয়ে বড় উৎস বলে মনে করা হয়। এর ছায়ায় বসলে মন শান্তি এবং শরীর শক্তি পায়।
- নিরজলা উপবাস শরীরের ডিটক্স প্রক্রিয়া বাড়ায়।
- সামূহিকভাবে বৃক্ষের নিচে পূজা করা সামাজিক ঐক্য এবং পরিবেশ সচেতনতাও বাড়ায়।
সতর্কতা ও নিয়ম
- ব্রতের দিন চুল কাটা, নখ কাটা, অথবা মিথ্যা কথা বলা নিষেধ।
- শুধুমাত্র সাৎত্বিক খাবার তৈরি করা এবং অন্যদের খাওয়ানো শুভ বলে মনে করা হয়।
- নিরজলা ব্রত কঠিন, তাই যদি স্বাস্থ্য ভালো না থাকে, তাহলে জল সেবন করা যেতে পারে।
- যদি ব্রতী নারী গর্ভবতী হন অথবা অসুস্থ থাকেন, তাহলে ব্রতের বিকল্প মানসিক সংকল্প ও পূজার মাধ্যমে পূরণ করা যেতে পারে।
বট পূর্ণিমা ব্রত শুধুমাত্র একটি ধর্মীয় উৎসব নয়, বরং নারীশক্তি, আস্থা, সমর্পণ এবং প্রেমের প্রতীক। সাবিত্রীর মতো নারীর গাথা আজও লক্ষ লক্ষ নারীকে অনুপ্রাণিত করে যে সच्चा প্রেম, বিশ্বাস এবং সংকল্প যে কোন পরিস্থিতি পরিবর্তন করতে পারে। এই বছর ২০২৫ সালে, ১০ জুন যখন নারীরা বটবৃক্ষের চারিদিকে প্রদক্ষিণ করবে, তখন শুধু পূজা করবে না, বরং একটি সংস্কৃতি, ঐতিহ্য এবং শক্তির উৎসব পালন করবে।