২০২৫ সালের রবি প্রদোষ ব্রত: তিথি, পূজা পদ্ধতি ও গুরুত্ব

🎧 Listen in Audio
0:00

সনাতন ধর্মে প্রদোষ ব্রতের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। এই ব্রত ভগবান শিব ও মা পার্বতীর প্রতি উৎসর্গিত, যা প্রতি পক্ষের ত্রয়োদশী তিথিতে পালন করা হয়। বিশেষ করে, ২০২৫ সালে আসন্ন জ্যৈষ্ঠ মাসের শেষ প্রদোষ ব্রত রবিবারে পড়ছে, যাকে রবি প্রদোষ ব্রত বলা হয়। শিবভক্তদের জন্য এই ব্রত অত্যন্ত শুভ বলে মনে করা হয় কারণ এই দিনে শিব যোগ ও শিববাস যোগের মতো ঐশ্বরিক সংযোগও গঠিত হচ্ছে। এই প্রবন্ধে আমরা জানবো কেন এই ব্রত বিশেষ, এর পূজা পদ্ধতি, শুভ মুহূর্ত এবং এর পিছনে থাকা ধর্মীয় বিশ্বাস।

প্রদোষ ব্রত: একটি আধ্যাত্মিক শুভ উপলক্ষ্য

প্রদোষ ব্রত ভগবান শিবকে উৎসর্গিত সেই তিথি, যখন দেবাদিদেবের বিশেষ কৃপা লাভের সুযোগ মেলে। 'প্রদোষ' শব্দের অর্থ 'সন্ধ্যাকাল', অর্থাৎ দিনের সেই সময় যখন দিন ও রাতের সংগম হয়। এই সময় সাধনা ও উপাসনার জন্য অত্যন্ত শুভ।

শিব পুরাণে বর্ণিত আছে যে, প্রদোষ ব্রত পালন করলে ব্যক্তির জীবনে সুখ-শান্তি, সমৃদ্ধি এবং মানসিক ভারসাম্য বজায় থাকে। পাশাপাশি, যিনি এই দিনে ভগবান শিবের আরাধনা করেন, তিনি পুণ্য, সৌভাগ্য, আরোগ্যতা এবং মোক্ষ লাভ করেন।

রবি প্রদোষ ব্রত ২০২৫-এর তিথি ও শুভ মুহূর্ত

রবি প্রদোষ ব্রত ২০২৫ সালে ৮ জুন, রবিবার পালিত হবে। এই দিন ত্রয়োদশী তিথি সকাল ৭:১৭ টায় শুরু হবে এবং ৯ জুন সকাল ৯:৩৫ টা পর্যন্ত থাকবে। ভগবান শিবের পূজার জন্য সবচেয়ে শুভ সময় ৮ জুন সন্ধ্যায় ৭:১৮ টা থেকে রাত ৯:১৯ টা পর্যন্ত। এই বিশেষ সন্ধ্যাকালীন সময়কে 'প্রদোষ কাল' বলা হয়, যা শিব পূজার জন্য অত্যন্ত পবিত্র বলে মনে করা হয়। এই মুহূর্তে ভক্তিপূর্ণ পূজা করলে শিবজির বিশেষ কৃপা লাভ হয় এবং ভক্তের প্রতিটি ইচ্ছা পূর্ণ হয়।

শিবযোগ ও শিববাস যোগের ঐশ্বরিক সংযোগ

এইবার প্রদোষ ব্রততে দুটি শুভ সংযোগ গঠিত হচ্ছে:

শিব যোগ: এই যোগে শিবের আরাধনা করলে সকল কাজ সফল হয়। জীবনে চলমান বাধাবিঘ্ন দূর হয় এবং মনে শান্তি আসে।

শিববাস যোগ: বিশ্বাস করা হয় যে, এই যোগে ভগবান শিব পৃথিবীতে বাস করেন এবং তাঁর ভক্তদের ডাক সরাসরি শোনেন। যিনি এই দিনে মনে মনে শিব পূজা করেন, তাঁর প্রতিটি ইচ্ছা পূর্ণ হয়।

প্রদোষ ব্রতের ধর্মীয় বিশ্বাস

প্রদোষ ব্রতের বিশ্বাস শিব পুরাণ ও অন্যান্য ধর্মীয় গ্রন্থে অত্যন্ত পবিত্র ও ফলপ্রদ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এই ব্রত ত্রয়োদশী তিথিতে পালন করা হয়, যা ভগবান শিবকে উৎসর্গিত। বিশ্বাস করা হয় যে, এই দিন সন্ধ্যাকালে ভগবান শিব তাঁর ভক্তদের পূজায় প্রসন্ন হয়ে তাদের কাম্য ফল প্রদান করেন। তাই প্রদোষ ব্রতকে অত্যন্ত শুভ বলে মনে করা হয়।

এই ব্রত পালন করলে জীবনের সকল দোষ দূর হয় এবং নেতিবাচকতা দূরীভূত হয়। যিনি ভক্তি ও শ্রদ্ধা সহকারে প্রদোষ ব্রত পালন করেন, তার জীবনে রোগ, শোক ও দারিদ্র্য টিকে থাকে না। এই ব্রত আধ্যাত্মিক শান্তি, মানসিক স্থিরতা এবং মোক্ষ লাভে সহায়ক।

রবি প্রদোষ ব্রতের পূজা পদ্ধতি

স্নান ও সংকল্প: ব্রতীকে সূর্যোদয়ের আগে উঠে স্নান করে পরিষ্কার পোশাক পরে ব্রতের সংকল্প করতে হবে।

নির্জল ব্রত: প্রদোষ ব্রত নির্জল পালন করা হয়, তবে অসুস্থ বা বৃদ্ধ ব্যক্তিরা ফলাহার করতে পারেন।

শিব পূজা: সন্ধ্যাকালে, প্রদোষ কালে ভগবান শিব, মা পার্বতী, নন্দী ও ভগবান গণেশের পূজা করতে হবে। শিবলিঙ্গের পঞ্চামৃত (দুধ, দই, মধু, ঘি ও গঙ্গাজল) দিয়ে অভিষেক করতে হবে।

ধূপ-দীপ ও পুষ্প অর্পণ: দীপ জ্বালাতে হবে, বেলপাতা, সাদা পুষ্প, ভস্ম, ধতুরা, ভাঙ্গ ইত্যাদি অর্পণ করতে হবে।

মন্ত্র জপ: 'ॐ नमः शिवाय' মন্ত্র কমপক্ষে ১০৮ বার জপ করতে হবে। তদুপরি 'ॐ त्र्यम्बकं यजामहे' মহামৃত্যুঞ্জয় মন্ত্র জপও শুভ ফল দেয়।

শিব কথা ও আরতি: শিব কথা শুনতে বা পড়তে হবে। তারপর শিব আরতি করতে হবে এবং শেষে ব্রত কথার পাঠ করতে হবে।

রবি প্রদোষ ব্রতের ফল

রবি প্রদোষ ব্রতের সাথে যুক্ত বিশ্বাস অনুসারে, যিনি এই ব্রত শ্রদ্ধা ও নিয়মিতভাবে পালন করেন, তিনি অনেক আধ্যাত্মিক ও সাংসারিক লাভ লাভ করেন:

  • আরোগ্যতা: রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া যায় এবং শরীরে নতুন শক্তির সঞ্চার হয়।
  • সৌভাগ্য বৃদ্ধি: দাম্পত্য জীবনে সুখ-শান্তি বৃদ্ধি পায় এবং অন্নপূর্ণা মাতার কৃপায় ধন-সম্পদের অভাব হয় না।
  • কর্ম সিদ্ধি: বন্ধ কাজ শুরু হয়, এবং জীবনে উন্নতির নতুন পথ খুলে যায়।
  • মোক্ষ প্রাপ্তি: এই ব্রত শিবের পরমলোকে স্থান দানকারী বলেও মনে করা হয়।

দিনের পঞ্জিকা (০৮ জুন ২০২৫)

সূর্যোদয়: সকাল ০৫:২৩ টা

সূর্যাস্ত: সন্ধ্যা ০৭:১৮ টা

চন্দ্রোদয়: সন্ধ্যা ০৪:৫০ টা

চন্দ্রাস্ত: ৯ জুন সকাল ০৩:৩১ টা

ব্রহ্ম মুহূর্ত: সকাল ০৪:০২ টা থেকে ০৪:৪২ টা পর্যন্ত

বিজয় মুহূর্ত: দুপুর ০২:৩৯ টা থেকে ০৩:৩৫ টা পর্যন্ত

গোধূলি মুহূর্ত: সন্ধ্যা ০৭:১৭ টা থেকে ০৭:৩৭ টা পর্যন্ত

নিশিতা মুহূর্ত: রাত ১২:০০ টা থেকে ১২:৪০ টা পর্যন্ত

প্রদোষ ব্রতের দিন দানের গুরুত্ব

প্রদোষ ব্রতের দিন দান করা অত্যন্ত শুভ বলে মনে করা হয় কারণ এই দিন করা দান অনেকগুণ পুণ্য দেয়। বিশেষ করে এই দিন বস্ত্র, অন্ন, তামার পাত্র, ঘি, গুড় ও ধর্মগ্রন্থ দান করা অত্যন্ত ফলপ্রদ। এভাবে দান করলে কেবল ভগবান শিবের কৃপাই নয়, জীবনে সুখ, শান্তি ও সমৃদ্ধিও বৃদ্ধি পায়। প্রদোষ ব্রততে করা দান ব্যক্তির ক্রিয়া-কলাপ পরিষ্কার করে এবং তার দুঃখ কমায়, তাই এই দিন দান করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হয়।

রবি প্রদোষ ব্রতের কথা

অনেক আগের কথা, এক নগরে একজন দরিদ্র ব্রাহ্মণ তার স্ত্রীর সাথে বাস করত। তার জীবন অত্যন্ত কষ্টের মধ্য দিয়ে কাটছিল। সে প্রতিদিন ভগবান শিবের পূজা করত এবং প্রদোষ ব্রত পালন করত। একবার সে রবি প্রদোষ ব্রতের বিশেষ সংকল্প নিয়ে সম্পূর্ণ নিয়ম মেনে ব্রত পালন করে। তার ভক্তি ও শ্রদ্ধায় প্রসন্ন হয়ে ভগবান শিব স্বপ্নে তার দর্শন দিয়ে বললেন যে, শীঘ্রই তার জীবনে উন্নতি আসবে। কিছুদিন পর সে একটি ভালো কাজ পায় এবং তার অর্থনৈতিক অবস্থা উন্নত হতে থাকে।

আরেকটি কথার অনুসারে, দেবতা ও অসুরদের মধ্যে যখন সাগর মন্থন হয়েছিল, তখন হলাহল বিষ বেরিয়েছিল। যখন কেউ সেই বিষ ধরতে পারেনি, তখন ভগবান শিব তা তাঁর কণ্ঠে ধারণ করেছিলেন। এর ফলে তাঁর কণ্ঠ নীল হয়ে গিয়েছিল এবং তিনি 'নীলকণ্ঠ' নামে পরিচিত হয়েছিলেন। এই ঘটনা ত্রয়োদশী তিথিতে প্রদোষ কালে ঘটেছিল। তাই এই সময় ভগবান শিবের বিশেষ পূজার জন্য অত্যন্ত পবিত্র বলে মনে করা হয়। যখন এই তিথি রবিবারে আসে, তখন তাকে রবি প্রদোষ বলে।

এমন বিশ্বাস রয়েছে যে, রবি প্রদোষ ব্রত পালন করলে ব্যক্তি আরোগ্যতা, দীর্ঘায়ু ও সুখ-শান্তির আশীর্বাদ লাভ করেন। পাশাপাশি, এই ব্রত পালন করলে পাপের ধ্বংস হয় এবং জীবনে সৌভাগ্য বৃদ্ধি পায়। ভক্ত যদি পুরো মন ও শ্রদ্ধা সহকারে এই দিন ব্রত পালন করে এবং ভগবান শিবের পূজা করে, তাহলে তিনি সকল কাজে সফলতা লাভ করেন এবং তার সকল সমস্যা দূর হয়।

রবি প্রদোষ ব্রত কেবল ভগবান শিবের বিশেষ কৃপা লাভের সুযোগ নয়, বরং জীবনের সকল দুঃখ থেকে মুক্তি পাওয়ার আধ্যাত্মিক পথও। এই দিন শিবভক্তরা শ্রদ্ধা ও নিয়মিতভাবে ব্রত পালন করে ভগবান ভোলেনাথকে প্রসন্ন করলে নিশ্চিতভাবে জীবনে সুখ, শান্তি ও সমৃদ্ধির বাস হবে।

Leave a comment