আজ, ১৩ মে ২০২৫, সমগ্র ভারতবর্ষে শ্রদ্ধা ও আস্থার সাথে নারদ জয়ন্তী পালিত হচ্ছে। হিন্দু ধর্মে এই দিনটির বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে, কারণ এটি সেই দিব্য ঋষির স্মরণোৎসবের দিন, যিনি ত্রিলোক সংচারক, তথ্যবাহক ও ধর্মদূত হিসেবে পরিচিত। আসুন জেনে নেই দেবর্ষি নারদ মুনির জীবনের অদ্ভুত কাহিনী, তাঁর গুরুত্ব এবং ২০২৫ সালের জয়ন্তীর শুভ যোগ।
নারদ মুনি কে?
নারদ মুনি ব্রহ্মা দেবের মানসপুত্র বলে বিবেচিত এবং তাঁকে দেবর্ষির উপাধি প্রাপ্ত। এই উপাধি কেবল সেই সকল ঋষিকে দেওয়া হয় যারা তিনটি লোক—স্বর্গ, পৃথিবী ও পাাতাল—এ বিচরণ করার ক্ষমতা রাখেন। নারদ মুনি একজন শাশ্বত ব্রহ্মচারী, মহান বীণাবাদক, জ্ঞানের ভাণ্ডার এবং ভগবান বিষ্ণুর অনন্য ভক্ত ছিলেন। তাঁর জীবনের উদ্দেশ্য ছিল জ্ঞানের প্রচার, ঈশ্বরভক্তি এবং ধর্মের রক্ষা।
নারদ জয়ন্তী ২০২৫: তিথি ও মুহূর্ত
- তিথি আরম্ভ: ১২ মে ২০২৫, রাত ১০:২৫ টা
- তিথি সমাপ্তি: ১৪ মে ২০২৫, রাত ১২:৩৫ টা
- উৎসব তিথি: মঙ্গলবার, ১৩ মে ২০২৫
গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত
- ব্রহ্ম মুহূর্ত: সকাল ৪:০৪ থেকে ৪:৪৬ টা পর্যন্ত
- অভিজিৎ মুহূর্ত: দুপুর ১১:৪৬ থেকে ১২:৪০ টা পর্যন্ত
- বিজয় মুহূর্ত: দুপুর ২:২৯ থেকে ৩:২৩ টা পর্যন্ত
- গোধূলি মুহূর্ত: সন্ধ্যা ৬:৫৮ থেকে ৭:১৯ টা পর্যন্ত
কেন নারদ মুনিকে সৃষ্টির প্রথম সাংবাদিক বলা হয়?
নারদ মুনিকে হিন্দু ধর্মের প্রথম সাংবাদিক বলে মনে করা হয় কারণ তিনি ত্রিলোকে স্বাধীনভাবে বিচরণ করে বিভিন্ন লোকের তথ্য একে অপরের কাছে পৌঁছে দিতেন। তিনি কেবল দেবতা ও অসুরদের মধ্যে যোগাযোগের সেতুবন্ধনই ছিলেন না, বরং ধর্ম, জ্ঞান ও চেতনার প্রচারেও অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন। তাঁর যোগাযোগ কেবল তথ্য প্রদানই ছিল না, বরং তাতে নীতি, ধর্ম ও দর্শনের ঝলক ছিল। তিনি কোনো সংবাদ কেবলমাত্র যথার্থভাবেই পৌঁছে দিতেন না, বরং তাতে লুকিয়ে থাকা বার্তাও উন্মোচন করতেন। এটাই তাঁকে একজন অনন্য সাংবাদিক করে তুলেছে।
জ্ঞান ও বিদ্বতার অতুলনীয় উদাহরণ
মহাভারতের শাণ্তিপর্ব-এ নারদ মুনির বিদ্বতার বিস্তারিত উল্লেখ রয়েছে। তাঁকে:
- চারটি বেদের জ্ঞাতা
- উপনিষদের মর্মজ্ঞ
- পুরাণ ও ইতিহাসের বিশেষজ্ঞ
- ব্যাকরণ, আয়ুর্বেদ, জ্যোতিষ, যোগ ও সঙ্গীতের প্রকাণ্ড পণ্ডিত বলে মনে করা হয়।
- তিনি সময়ের অতীত ছিলেন—ভূতকাল, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ জ্ঞাতা। তাই তাঁকে ত্রিকালদর্শী বলা হয়।
নারদ মুনি ও ভগবান বিষ্ণুর সম্পর্ক
নারদ মুনি ভগবান বিষ্ণুর পরম ভক্ত ছিলেন। তিনি নিয়মিত বিষ্ণু নামের কীর্তন করতেন। "নারায়ণ-নারায়ণ" ছিল তাঁর প্রিয় মন্ত্র। বিষ্ণুও নারদের ভক্তিতে প্রসন্ন থাকতেন এবং তাঁকে বিশেষ স্থান দিতেন। কিন্তু একবার নারদ তাঁর তপ ও সংযমের অহংকারে পড়ে গেলেন এবং ভাবলেন যে তিনি কাম বা যৌন আকাঙ্ক্ষার উপর জয়ী হয়েছেন। বিষ্ণু তাঁর পরীক্ষা নিলেন এবং এক মায়ানগরী সৃষ্টি করলেন যেখানে এক অপূর্ব সুন্দরী রাজকুমারীর স্বয়ংবর অনুষ্ঠিত হলো।
নারদ সেই কন্যার প্রতি মুগ্ধ হয়ে পড়লেন এবং বিষ্ণুর কাছে সুন্দর রূপ দেওয়ার অনুরোধ করলেন। কিন্তু বিষ্ণু তাঁর পরীক্ষা নিয়ে তাঁকে বানরমুখ দিলেন। যখন কন্যা তাঁকে প্রত্যাখ্যান করলেন এবং স্বয়ংবরে তাঁর উপহাস হলো, তখন তিনি সত্য বুঝতে পারলেন। এতে নারদকে খুব দুঃখ হলো এবং তিনি বিষ্ণুকে অভিশাপ দিলেন—আপনিও স্ত্রীবিযোগের কষ্ট ভোগ করবেন!। এই অভিশাপের ফলেই ভগবান রামকে সীতা মাতার বিযোগের অভিজ্ঞতা ভোগ করতে হয়েছিল।
সঙ্গীতাচার্য নারদ: বীণা ও স্বরের দেবদূত
নারদ মুনিকে দেবী সরস্বতী নিজেই সঙ্গীতের শিক্ষা দিয়েছিলেন। তিনি মহান বীণাবাদক ছিলেন। তাঁর বীণার নাম ছিল মহতি। তাঁর বীণার শব্দে ঋষি-মুনি, দেবতা ও অন্যান্য প্রাণী মুগ্ধ হয়ে পড়ত। আজও ভারতীয় সঙ্গীতশাস্ত্রে নারদকে আদিগুরু হিসেবে মান্যতা দেওয়া হয়। নারদ মুনি আজীবন ব্রহ্মচারী ছিলেন। তিনি নিজেকে ভগবানের সেবায় নিবেদন করেছিলেন।
একটি কথানুসারে, ব্রহ্মা তাঁকে বিবাহ করার জন্য বলেছিলেন কিন্তু নারদ তা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। এতে ক্রুদ্ধ হয়ে ব্রহ্মা তাঁকে অভিশাপ দিয়েছিলেন যে তিনি আজীবন অবিবাহিত থাকবেন। নারদ মুনির কাহিনী কেবল ধর্মীয় বার্তাতেই সীমাবদ্ধ নয়। তিনি কर्मের প্রেরক, রাজনীতির मार्गदर्शক, ভক্তির প্রচারক এবং জ্ঞানের বাহকও ছিলেন। তাঁকে নারদ পুরাণ, ভক্তি সূত্র ইত্যাদি অনেক ধর্মীয় রচনার ঋণী। তিনি বহুবার রাজা ও ঋষিদের ধর্মের পথে চলার জন্য অনুপ্রাণিত করেছেন।
নারদ জয়ন্তীতে পূজা বিধি
- প্রাতঃকালে ব্রহ্ম মুহূর্তে স্নান করুন।
- শুচি বস্ত্র পরিধান করুন এবং ব্রতের সংকল্প করুন।
- ঘরের মন্দির পরিষ্কার করে গঙ্গাজল ছিটান।
- পূজা স্থলে নারদ মুনির প্রতিমা বা ছবি স্থাপন করুন।
- ধূপ, দীপ, ফুল, চন্দন, ফল ও মিষ্টান্ন দিয়ে বিধিপূর্ণ পূজা করুন।
- নারায়ণ মন্ত্র, ভক্তি সূত্র বা বিষ্ণুসহস্রনাম পাঠ করুন।
- ভোগ অর্পণের পর প্রসাদ বিতরণ করুন।
- ব্রাহ্মণ ও দরিদ্রদের দান করুন।
নারদ জয়ন্তীর গুরুত্ব
- এই দিনে জ্ঞান, ভক্তি ও সঙ্গীতের আরাধনা করা হয়।
- সাংবাদিকতা ও তথ্য প্রযুক্তির সাথে যুক্ত ব্যক্তিরা নারদ মুনিকে তাদের আদর্শ হিসেবে মনে করেন।
- এই দিনটি ঈশ্বর ভক্তি, সত্যের প্রচার ও আত্মসংযমের প্রতীক।
- মনে করা হয় এই দিনে ব্রাহ্মণ ভোজন, গোদান ও গ্রন্থদান করলে বিশেষ পুণ্যফল লাভ হয়।
ভগবান বিষ্ণুর আরতি (Lord Vishnu Aarti)
ওম জয় জগদীশ হরে, স্বামী!
জয় জগদীশ হরে।
ভক্ত জনের সংকট, ক্ষণে দূর করে॥
ওম জয় জগদীশ হরে।
যে ধ্যানে ফল পায়, দুঃখ বিনাশে মন কা।
স্বামী দুঃখ বিনাশে মন কা।
সুখ সম্পত্তি ঘরে আবে, কষ্ট মিটে তন কা॥
ওম জয় জগদীশ হরে।
মা-পিতা তুমি আমার, শরণ গহুঁ আমি কিসের।
স্বামী শরণ গহুঁ আমি কিসের।
তুমি বিন অন্য নাহি, আশা করি যাহার॥
ওম জয় জগদীশ হরে।
তুমি পূর্ণ পরমাত্মা, তুমি অন্তর্যামী।
স্বামী তুমি অন্তর্যামী।
পারব্রহ্ম পরমেশ্বর, তুমি সকলের স্বামী॥
ওম জয় জগদীশ হরে।
তুমি করুণার সাগর, তুমি পালনকারতা।
স্বামী তুমি পালনকারতা।
আমি মূর্খ খল কামী, কৃপা করো ভর্তা॥
ওম জয় জগদীশ হরে।
তুমি হও এক অগোচর, সকলের প্রাণপতি।
স্বামী সকলের প্রাণপতি।
এই পড়ুন - Narada Jayanti 2025: নারদ জয়ন্তীতে শিব্বাস যোগ সহ অনেক মঙ্গলময় সংযোগ, দ্বিগুণ লাভ मिलेगा
কি বিধি মিলুঁ দয়াময়, তোমাকে আমি কুমতি॥ ॐ জয় জগদীশ হরে।
দীনবন্ধু দুঃখহর্তা, তুমি ঠাকুর আমার।
স্বামী তুমি ঠাকুর আমার।
আপন হাত উঠাও, দ্বার পড়া তোমার॥
ওম জয় জগদীশ হরে।
বিষয়-বিকার মিটাও, পাপ হরো দেবা।
স্বামী পাপ হরো দেবা।
শ্রদ্ধা-ভক্তি বাড়াও, সন্তানের সেবা॥
ওম জয় জগদীশ হরে।
শ্রী জগদীশের আরতি, যে কোন নর গাবে।
স্বামী যে কোন নর গাবে।
কহে শিবানন্দ স্বামী, সুখ সম্পত্তি পাবে॥
ওম জয় জগদীশ হরে।
নারদ মুনি একজন এমন অদ্বিতীয় চরিত্র যিনি ধর্ম, জ্ঞান, যোগাযোগ ও সঙ্গীতের মাধ্যমে সমস্ত সৃষ্টিকে একত্রিত করার কাজ করেছেন। তাঁর জীবন একটি আদর্শ যে সঠিক তথ্য, সঠিক ভাব ও সঠিক সময়ে যদি পৌঁছে দেওয়া যায়, তবে তা সৃজনশীল পরিবর্তন আনতে পারে।