জ্যৈষ্ঠ মাসের চারটি প্রধান ব্রত ও উৎসব

🎧 Listen in Audio
0:00

হিন্দু ধর্মে বর্ষের প্রতিটি মাসেরই বিশেষ ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক গুরুত্ব রয়েছে। সেইসব মাসের মধ্যে একটি হল ‘জ্যৈষ্ঠ মাস’, যাকে তপস্যা, সেবা ও দানের মাস হিসেবে মানা হয়। ২০২৫ সালে জ্যৈষ্ঠ মাস শুরু হয়েছিল ১৩ মে এবং শেষ হবে ১১ জুন। এই মাসের প্রখর রৌদ্র ও ঝড়ো বাতাসের মধ্যে করা দান ও ব্রত শুধুমাত্র শারীরিক কষ্টই দেয় না, আত্মাকেও শুদ্ধ করে। এই কারণেই এই মাসে ব্রত, উপবাস, দান ও তীর্থস্নানের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। আসুন জেনে নিই এই মাসে আগমনকারী চারটি প্রধান ব্রত ও উৎসব সম্পর্কে, যা আধ্যাত্মিক দিক থেকে অত্যন্ত পুণ্যময় বলে মনে করা হয়।

অপরা একাদশী – ২৩ মে ২০২৫ (শুক্রবার)

অপরা একাদশীর ব্রত জ্যৈষ্ঠ মাসের কৃষ্ণপক্ষের একাদশী তিথিতে পালন করা হয়। ২০২৫ সালে এই শুভ তিথি ২৩ মে, শুক্রবার। এই দিন ‘সর্বার্থসিদ্ধি যোগ’ ও ‘অমৃতসিদ্ধি যোগ’ যে সমস্ত বিশেষ সংযোগ গঠিত হচ্ছে, তার ফলে এই ব্রতের গুরুত্ব আরও বৃদ্ধি পায়। এই ব্রত ভগবান বিষ্ণুকে উৎসর্গীকৃত এবং এটি পালন করলে জীবনের সকল পাপ ধুলোয় মিশে যায় এবং পুণ্যের প্রাপ্তি হয়। এই দিন আত্মশুদ্ধি ও আধ্যাত্মিক উন্নতির জন্য অত্যন্ত শুভ বলে মনে করা হয়।

অপরা একাদশীতে ব্রতীদের ব্রহ্মমুহূর্তে উঠে স্নান করে এবং পরিষ্কার পোশাক পরে ভগবান বিষ্ণুর পূজা করতে হবে। পূজার সময় তুলসীপাতা, ফল, জল ও প্রদীপ অর্পণ করতে হবে। ঘি-এর প্রদীপ জ্বালিয়ে "ওঁ নমো ভগবতে বাসুদেবায়" মন্ত্রের জপ করতে হবে। এই দিন অন্ন গ্রহণ করা উচিত নয় এবং একবেলা ফলাহার গ্রহণ করতে হবে। পূর্ণ শ্রদ্ধা ও ভক্তি সহকারে উপবাস পালন করলে ভগবান বিষ্ণু তাঁর ভক্তদের মোক্ষ প্রদান করেন এবং জীবনে সুখ-শান্তি দান করেন।

বট সাবিত্রী ব্রত – ২৬ মে ২০২৫ (সোমবার)

বট সাবিত্রী ব্রত সুহাগিনী নারীদের জন্য একটি বিশেষ ও শ্রদ্ধাভরা উৎসব। এই ব্রত জ্যৈষ্ঠ মাসের অমাবস্যায় পালিত হয় এবং ২০২৫ সালে এই তিথি ২৬ মে, সোমবার। এই দিন ‘সোমবতী অমাবস্যা’ -র যোগও রয়েছে, যার ফলে এই ব্রতের গুরুত্ব আরও বৃদ্ধি পায়। এই ব্রত পবিত্র প্রেম, সমর্পণ ও স্বামীর দীর্ঘায়ু কামনার জন্য পালন করা হয়। নারীরা পুরোদিন নিরজল উপবাস পালন করে স্বামীর সুখ, সমৃদ্ধি ও সৌভাগ্যের কামনা করেন।

এই দিন ব্রতী নারীরা বট (বটগাছ) গাছের পূজা করেন। তারা গাছের চারিদিকে কাঁচা সুতা মুড়ি দিয়ে প্রদক্ষিণ করেন এবং সাবিত্রী-সত্যবানের কথা শোনেন। মনে করা হয় যে বটবৃক্ষে ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ – তিন দেবতার বাস। পূজায় সিঁদুর, হলুদ, অক্ষত (চাল), ফুল, ফল ও মিষ্টান্ন ব্যবহার করা হয়। এই ব্রত নারীদের দাম্পত্য জীবনকে সুদৃঢ় করে এবং তাদের অখণ্ড সৌভাগ্যের বরদান দেয়।

গঙ্গা দশমী – ৫ জুন ২০২৫ (বৃহস্পতিবার)

জ্যৈষ্ঠ শুক্লপক্ষের দশমী তিথিতে গঙ্গা দশমী পালিত হয়। মনে করা হয় এই দিনেই পবিত্র গঙ্গা নদী পৃথিবীতে অবতরণ করেছিলেন। এই দিন গঙ্গা নদীতে স্নান করলে সকল পাপ ধুয়ে যায় এবং মানুষ মোক্ষ লাভ করে। ২০২৫ সালে এই উৎসব ৫ জুন পালিত হবে। এই বার গঙ্গা দশমী উত্তর ফাল্গুণী নক্ষত্র ও সিদ্ধ রবিযোগের যোগে পড়ছে, যা তাকে আরও শুভ করে তুলছে। তাই এই দিন ভগবানের আরাধনা এবং গঙ্গা নদীতে স্নান করলে বিশেষ লাভ হয়।

যদি গঙ্গা নদীতে স্নান করা সম্ভব না হয়, তবে ঘরে গঙ্গাজল মিশিয়ে স্নান করতে হবে। এছাড়াও, এই দিন গরিব ও দরিদ্রদের সত্তু, গুড়, জল, বস্ত্র ও পাখা দান করা অত্যন্ত পুণ্যময় বলে মনে করা হয়। কোনও সর্বজনীন স্থানে পানীয় জলের ব্যবস্থা করা অথবা পিপাসুদের জল পান করানোও অনেক পুণ্য দেয়। এই ধরণের দান জন্ম-জন্মান্তরে ফলপ্রসূ হয় এবং জীবনে সুখ, শান্তি ও সমৃদ্ধি নিয়ে আসে। তাই গঙ্গা দশমীতে দান-পুণ্য করা অত্যন্ত শুভ কাজ বলে মনে করা হয়।

নিরজলা একাদশী – ৬ জুন ২০২৫ (শুক্রবার)

জ্যৈষ্ঠ শুক্লপক্ষের একাদশীকে নিরজলা একাদশী বলা হয়। এই দিন ব্রতীরা সম্পূর্ণরূপে নিরজল, অর্থাৎ জল ও অন্ন ছাড়া পুরোদিন উপবাস পালন করেন। এটিকে সবচেয়ে কঠিন উপবাস বলে মনে করা হয় কারণ এতে জলও পান করা যায় না। এই ব্রতকে ভীম একাদশীও বলা হয়, কারণ মহাভারতের ভীমসেন এই উপবাস অত্যন্ত শ্রদ্ধার সাথে পালন করেছিলেন। ২০২৫ সালে এই ব্রত ৬ জুন, শুক্রবার পালিত হবে। নিরজলা একাদশীর গুরুত্ব অপরিসীম কারণ মনে করা হয় যদি কোনও ব্যক্তি অন্যান্য ২৩টি একাদশীর ব্রত পালন করতে না পারে, তবে এই একাদশীর ব্রত পালনের মাধ্যমে সে সকলের সমান পুণ্য লাভ করতে পারে।

এই দিন ব্রতীরা ভগবান বিষ্ণুর বিশেষ পূজা করেন এবং পুরো মনে তাঁর ধ্যান করেন। নিরজলা একাদশী আত্মার শুদ্ধি ও ইচ্ছাপূরণের পথ। এই ব্রত শরীর ও মন উভয়কে নিয়ন্ত্রণ করার শিক্ষা দেয়। উপবাসের সময় ব্যক্তি সংযম ও ভক্তি সহকারে ভগবানের স্মরণ করেন, যার ফলে তার জীবনে শান্তি ও সৌভাগ্য আসে। এইভাবে, নিরজলা একাদশী পালন করার ফলে শুধু আধ্যাত্মিক লাভই হয় না, জীবনে ইতিবাচক পরিবর্তনও আসে।

জ্যৈষ্ঠ মাসে দানের গুরুত্ব

জ্যৈষ্ঠ মাসে প্রচণ্ড গরম থাকে, তাই এই সময় জল সেবা ও ঠান্ডা জিনিসপত্রের দান করা অত্যন্ত শুভ বলে মনে করা হয়। এই মাসে দান করলে শুধু পুণ্যের প্রাপ্তিই হয় না, এটি আমাদের মনকেও শান্তি ও প্রশান্তি দেয়। যেমন, পথচারীদের জন্য পানীয় জলের ব্যবস্থা করা, পাখা, ছাতা ও চটি দান করা অত্যন্ত ফলপ্রসূ। এর ফলে গরমে কষ্ট পাওয়া মানুষদের স্বস্তি মেলে এবং তাদের কল্যাণ হয়।

এছাড়াও, জলপাত্র স্থাপন করা এবং পাখিদের জন্য পানির ব্যবস্থা করাও অত্যন্ত জরুরি। এই ছোট ছোট কাজগুলির ফলে শুধুমাত্র আমরা আধ্যাত্মিক লাভ পাই না, আমাদের গ্রহ-নক্ষত্রও শুভ প্রভাব দেয়। জ্যৈষ্ঠ মাসে এই ধরণের দান করার ফলে জীবনে সৌভাগ্য আসে এবং আমরা আমাদের চারপাশে ইতিবাচক শক্তির প্রসার ঘটাই। তাই এই মাসে দান-পুণ্য করা অত্যন্ত জরুরি।

জ্যৈষ্ঠ মাস আত্মশুদ্ধি, তপস্যা ও সেবার মাস। এই মাসে করা ব্রত, উপবাস, স্নান ও দানের ফলে ব্যক্তি অপূর্ব আধ্যাত্মিক লাভ করে। অপরা একাদশী, বট সাবিত্রী ব্রত, গঙ্গা দশমী ও নিরজলা একাদশী – এই চারটি উৎসব শুধুমাত্র আমাদের ধর্মীয় ঐতিহ্যের অংশ নয়, আমাদের জীবনকেও উজ্জ্বল ও ইতিবাচক করে তোলার মাধ্যম। এই জ্যৈষ্ঠ মাসে আমাদের সকলের উচিত আমাদের ক্ষমতানুযায়ী সেবা, সাধনা ও সংযমের অনুশীলন করে জীবনকে ধর্মময় করে তোলার প্রতিজ্ঞা করা।

Leave a comment