ওলা, উবার ও র্যাপিডোর মতো বড় রাইড-শেয়ারিং প্ল্যাটফর্মগুলো এই দিনগুলিতে সরকারের নির্দেশ অমান্য করার অভিযোগের মুখোমুখি হচ্ছে।
ভারতে ওলা, উবার ও র্যাপিডো নামক রাইড-শেয়ারিং অ্যাপগুলো এই দিনগুলিতে গ্রাহকদের ক্ষোভের মুখোমুখি হচ্ছে। এর কারণ হল এই কোম্পানিগুলো তাদের প্ল্যাটফর্মে প্রয়োগ করা বিতর্কিত ‘এডভান্স টেপিং’ ফিচার। সরকারের সতর্কতা ও কেন্দ্রীয় গ্রাহক সুরক্ষা কর্তৃপক্ষ (CCPA) এর নোটিশ সত্ত্বেও এই অ্যাপগুলো এই ফিচারটি অপসারণ করেনি অথবা এতে কোনো বড় পরিবর্তন আনেনি।
প্রকৃতপক্ষে, এই এডভান্স টেপিং সিস্টেমের মাধ্যমে রাইড বুক করার আগেই যাত্রীদের ড্রাইভারকে টিপ দেওয়ার বিকল্প দেখানো হয়। গ্রাহক চাইলেও না চাইলেও, এই বিকল্পটি এমনভাবে উপস্থাপন করা হয় যাতে মনে হয় যদি তারা টিপ না দেয় তাহলে তাদের রাইড গ্রহণ করা হবে না বা তাতে বিলম্ব হতে পারে।
কি এডভান্স টেপিং ফিচার এবং কেন বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে
এডভান্স টেপিং এমন একটি প্রক্রিয়া যেখানে রাইড বুক করার আগেই যাত্রীদের জানানো হয় যে তারা চাইলে ড্রাইভারকে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অগ্রিম টিপ দিতে পারেন। এই পরিমাণ সাধারণত ১০ টাকা থেকে ৫০ টাকা পর্যন্ত হয় এবং অ্যাপে এটা ইঙ্গিত করা হয় যে এতে রাইড দ্রুত পাওয়া যাবে।
যদিও, ব্যবহারকারীদের অভিযোগ, এই বিকল্পটি এমনভাবে উপস্থাপিত হয় যেন টিপ না দিলে রাইড পাওয়ার সম্ভাবনা কমে যায়। অনেক যাত্রী এক্স ও রেডিটের মতো সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মে অভিযোগ করেছেন যে টিপের বিকল্পটি ডিফল্টভাবে নির্বাচিত থাকে এবং এটি থেকে বের হওয়াও সহজ নয়।
সরকারের সতর্কতা ও নোটিশের কোনো প্রভাব নেই
কেন্দ্রীয় গ্রাহক সুরক্ষা কর্তৃপক্ষ (CCPA) মে মাসে ওলা, উবার ও র্যাপিডোকে এডভান্স টেপিং সিস্টেম নিয়ে নোটিশ জারি করেছিল। মন্ত্রণালয়ের বক্তব্য, এই ব্যবস্থা গ্রাহকদের বিভ্রান্ত করে এবং তাদের উপর চাপ প্রয়োগ করে অতিরিক্ত অর্থ প্রদান করতে বাধ্য করে।
নোটিশ সত্ত্বেও ২২শে জুন পর্যন্ত এই কোম্পানিগুলোর পক্ষ থেকে কোনো সুনির্দিষ্ট উত্তর আসেনি এবং অ্যাপগুলিতে এই ফিচারটি এখনও লাইভ আছে। এতে সরকারের নির্দেশ অমান্য এবং গ্রাহকদের অধিকার উপেক্ষা করার গুরুতর প্রশ্ন উঠেছে।
গ্রাহকরা কি বলছেন
অনেক ব্যবহারকারী তাদের অভিজ্ঞতা শেয়ার করে জানিয়েছেন যে, তারা যখন রাইড বুক করেন তখন টিপের বিকল্পটি ইতিমধ্যেই নির্বাচিত থাকে এবং তা অপসারণ করার জন্য আলাদা প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হয়।
- একজন ব্যবহারকারীর বক্তব্য: “আমি যখন উবার অ্যাপে ক্যাব বুক করেছিলাম, তখন দেখলাম ২০ টাকার টিপ ইতিমধ্যেই যুক্ত ছিল। আমি এটি অপসারণ করতে চেয়েছিলাম, কিন্তু একটি জটিল প্রক্রিয়া শেষ করে তবেই সেই বিকল্প বন্ধ হয়েছিল। এটা তো গ্রাহককে ইচ্ছা ছাড়াই টাকা দেওয়ার জন্য বাধ্য করা।”
- আরেকজন ব্যবহারকারী বলেছেন: “ড্রাইভারের সাথে কথা বলে জানা গেছে যে তাদের জানানো হয় কে টিপ দিচ্ছে। ফলে তারা টিপ দেওয়া গ্রাহকদের অগ্রাধিকার দেন। বাকি রাইডগুলোকে হয় দেরিতে গ্রহণ করেন অথবা রিজেক্ট করে দেন।”
- ড্রাইভারদের উপরও প্রভাব পড়ছে: এই বিতর্কিত ফিচারটির প্রভাব শুধুমাত্র গ্রাহকদের উপরই নয়, ড্রাইভারদের উপরও পড়ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই ব্যবস্থায় ড্রাইভার ও যাত্রীদের মধ্যে এক ধরণের অবিশ্বাসের সৃষ্টি হচ্ছে। ড্রাইভারদের কাছেও এই সিস্টেম স্পষ্ট নয় যে তাদের কত টিপ কখন ও কিভাবে পাওয়া যাবে।
কিছু ড্রাইভারের বক্তব্য, অ্যাপের মাধ্যমে প্রদত্ত টিপ তাদের কখনও কখনও কয়েকদিন পরে পাওয়া যায়, যখন যাত্রী মনে করেন তিনি অবিলম্বে টাকা দিয়েছেন। এতে ড্রাইভারদের কাছেও বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়।
আইনি ও নৈতিক প্রশ্ন
যেহেতু এই রাইড-শেয়ারিং পরিষেবাগুলো জনসাধারণের ব্যবহারের অন্তর্গত, তাই গ্রাহকের সম্মতি ও স্বচ্ছতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু বিশেষজ্ঞদের মতে, এই অ্যাপগুলোর বর্তমান নীতি এই দুটি মানদণ্ডেই পূরণ করে না।
একজন জ্যেষ্ঠ গ্রাহক অধিকার আইনজীবীর বক্তব্য,
“অ্যাপ্লিকেশনে এই ধরণের প্রি-সিলেক্টেড চার্জ যোগ করা গ্রাহককে প্রতারণা করা। এটি গ্রাহক সুরক্ষা আইনের উদ্দেশ্যের বিরুদ্ধে।”
নম্মা যাত্রী অ্যাপের ভূমিকা
রিপোর্ট অনুযায়ী, সর্বপ্রথম এই ফিচারটি বেঙ্গালুরু ভিত্তিক ‘নম্মা যাত্রী’ অ্যাপ চালু করেছিল। এরপর অন্যান্য কোম্পানিও এই মডেল অনুসরণ করতে শুরু করে। তবে এটা স্পষ্ট নয় যে নম্মা যাত্রীকেও CCPA-এর পক্ষ থেকে কোনো আনুষ্ঠানিক নোটিশ পাঠানো হয়েছে কি না।
এর অর্থ, যদি নম্মা যাত্রীকে নোটিশ পাঠানো না হয়, তাহলে এটি গ্রাহকদের মধ্যে অসম আচরণের উদাহরণ হতে পারে। এতে অন্যান্য কোম্পানিও নিয়মকানুন অমান্য করার জন্য উৎসাহিত হতে পারে।
এখনও পর্যন্ত আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি
এখনও পর্যন্ত ওলা, উবার, র্যাপিডো, নম্মা যাত্রী এবং এমনকি CCPA-এর পক্ষ থেকেও এই বিষয়ে কোনো আনুষ্ঠানিক বক্তব্য প্রকাশিত হয়নি। এই নীরবতা গ্রাহকদের উদ্বেগ আরও বাড়াচ্ছে।
কেন্দ্রীয় গ্রাহক বিষয়ক মন্ত্রী প্রহ্লাদ যোশী তবে এক্স-এ একটি পোস্টে বলেছেন যে সরকার এই বিষয়টিকে গুরুত্বের সাথে নিচ্ছে এবং সম্পৃক্ত সকল পক্ষের তদন্ত করা হচ্ছে।
সমাধান কি হতে পারে
- স্বচ্ছতার প্রয়োজনীয়তা সকল কোম্পানিকেই গ্রাহকদের স্পষ্টভাবে বিকল্প দিতে হবে যে তারা টিপ দিতে চান নাকি না, এবং সেই বিকল্পটি ডিফল্টভাবে নির্বাচিত থাকা উচিত নয়।
- সম্মতি ছাড়া কোনো চার্জ নয় কোনও অতিরিক্ত চার্জ গ্রাহকের সম্মতি ছাড়া যোগ করা উচিত নয়।
- সরকারের কঠোরতা CCPA-কে দ্রুত তাদের তদন্ত সম্পন্ন করে কঠোর নির্দেশনা জারি করা উচিত।
- নিয়ম অমান্য করার জন্য জরিমানা যে কোম্পানিগুলো নিয়ন্ত্রক নির্দেশনা অনুসরণ করে না, তাদের বিরুদ্ধে অর্থদণ্ড এবং লাইসেন্স নবীকরণে বাধা দেওয়ার মতো পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।