পৃথিবী আবারও মহাকাশের অদৃশ্য শক্তির লক্ষ্যবস্তুতে। এবার লক্ষ্যবস্তু হয়েছে আমাদের সৌরজগতের কেন্দ্র — সূর্য। আমেরিকান মহাকাশ সংস্থা নাসা সতর্কতা জারি করেছে যে, সূর্যে সম্প্রতি যে তীব্র বিস্ফোরণগুলি রেকর্ড করা হয়েছে, সেগুলি একটি শক্তিশালী সৌরঝড়ের আকারে পৃথিবীর দিকে ধেয়ে আসছে। এর ফলে বিশ্বব্যাপী মোবাইল নেটওয়ার্ক, ইন্টারনেট সেবা এবং বিদ্যুৎ গ্রিডে ব্যাপক প্রভাব পড়তে পারে।
সূর্যের পৃষ্ঠে উত্তালতা: AR4087 সানস্পটের আন্দোলন
গত কয়েক সপ্তাহ ধরে সূর্যের পৃষ্ঠে একটি নির্দিষ্ট অঞ্চল সক্রিয় রয়েছে, যাকে বিজ্ঞানীরা 'AR4087 সানস্পট' নাম দিয়েছেন। এই অঞ্চলটি অত্যন্ত উচ্চ-শক্তিসম্পন্ন এবং ক্রমাগত উচ্চ তীব্রতার সৌর বিস্ফোরণ — যাকে 'X-ক্লাস সোলার ফ্লেয়ার' বলা হয় — বের করছে। এই ফ্লেয়ারগুলি এত উচ্চ শক্তি বহন করে যে, সরাসরি পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্রকে প্রভাবিত করে।
১৩ মে যখন প্রথম X1.2 ফ্লেয়ার পৃথিবীর দিকে এসেছিল, তখন বিজ্ঞানীরা পরিস্থিতির গুরুত্ব বুঝতে পেরেছিলেন। কিন্তু তার পরের দিনই X2.7 ফ্লেয়ারের বিস্ফোরণ পুরো বিশ্বের রেডিও সংকেতকে অস্থির করে তুলেছিল।
কোথায় প্রভাব দেখা গেছে? কারা প্রভাবিত হয়েছেন?
দ্বিতীয় বৃহৎ বিস্ফোরণের পরপরই আমেরিকা, ইউরোপ, আফ্রিকা এবং দক্ষিণ এশিয়ার অনেক অংশে রেডিও যোগাযোগ ব্যাহত হয়েছিল। বিমান চলাচল, সামুদ্রিক নেভিগেশন এবং প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রের যোগাযোগ চ্যানেলও এর প্রভাবে পড়েছিল। ভারতের কিছু অংশে মোবাইল নেটওয়ার্কেও অস্থায়ী ব্যঘাত দেখা গেছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, যদি আগামী কয়েকদিনে সূর্য থেকে আরও শক্তিশালী ফ্লেয়ার বের হয়, তাহলে মোবাইল টাওয়ার, ইন্টারনেট ব্যাকবোন এবং জিপিএস সিস্টেম পর্যন্ত বিপদের মুখে পড়তে পারে।
সৌরঝড় কী এবং এটি কেন বিপজ্জনক?
সৌরঝড় আসলে সূর্যের পৃষ্ঠে ঘটে যাওয়া ভয়ঙ্কর চৌম্বকীয় বিস্ফোরণ, যার ফলে শক্তি, প্লাজমা এবং চার্জড কণার দ্রুত প্রবাহ বের হয়। যখন এই প্রবাহগুলি পৃথিবীর দিকে আসে, তখন আমাদের গ্রহের চৌম্বক ক্ষেত্র প্রভাবিত হয়। এর ফলে কেবল রেডিও যোগাযোগ ব্যাহত হয় না, বরং উপগ্রহ ব্যবস্থা, ইন্টারনেটের আন্ডারসি কেবল এবং বিদ্যুতের ট্রান্সফরমার পর্যন্ত নষ্ট হতে পারে।
আমেরিকা প্রস্তুতি নিচ্ছে, ভারতকেও সতর্ক থাকতে হবে
এই বিপদের আভাস পেয়ে আমেরিকা ৮ মে কলোরাডোতে একটি বিশেষ অনুশীলন করেছিল। এতে মহাকাশ সংস্থা, জাতীয় নিরাপত্তা গোষ্ঠী এবং সাইবার ইনফ্রাস্ট্রাকচার সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা অংশ নিয়েছিলেন। এই অনুশীলনে একটি কাল্পনিক পরিস্থিতি তৈরি করা হয়েছিল যে, যদি ২০২৮ সালে একটি বিশাল সৌরঝড় পৃথিবীতে আঘাত করে, তাহলে কী হবে।
ড্রিল-এ অনুমান করা হয়েছিল যে, একটি ভয়ঙ্কর ঝড় আমেরিকার অনেক এলাকাকে অন্ধকারে ঠেলে দিতে পারে, ইন্টারনেট সেবা বন্ধ হয়ে যেতে পারে এবং বিদ্যুৎ গ্রিড সম্পূর্ণরূপে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। এই অনুশীলনের মাধ্যমে সরকার বুঝতে চাইছে যে, সংকটের সময় কীভাবে প্রতিক্রিয়া জানাতে হবে।
সাধারণ নাগরিকরা কী করবেন?
বিজ্ঞানীরা মনে করেন যে, এই ধরনের বিপদ থেকে সম্পূর্ণ রক্ষা করা সম্ভব নয়, তবে সতর্কতা অবলম্বন করে ক্ষতি কম করা অবশ্যই সম্ভব। সাধারণ মানুষকে কিছু বিষয়ের দিকে খেয়াল রাখা উচিত:
- মোবাইল নেটওয়ার্কের উপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীলতা না রাখা। প্রয়োজনীয় বিষয়গুলির জন্য ব্যাকআপ বিকল্প যেমন ল্যান্ডলাইন, টু-ওয়ে রেডিও বা স্যাটেলাইট ফোনের ব্যবস্থা রাখা।
- ব্যাকআপ পাওয়ার সিস্টেম প্রস্তুত রাখা। সোলার লাইট, পাওয়ার ব্যাংক এবং জেনারেটরের মতো যন্ত্রপাতির উপলব্ধতা রাখা।
- রেডিও বা সরকারী সতর্কতা ব্যবস্থার দিকে নজর রাখা। সৌরঝড় সম্পর্কে আগে থেকেই সতর্কতা দেওয়া হয়, যা মিডিয়া এবং আবহাওয়া সংস্থাগুলির মাধ্যমে পাওয়া যায়।
- ডিজিটাল ডেটার ব্যাকআপ নেওয়া। কম্পিউটার, মোবাইল এবং প্রয়োজনীয় ডিভাইসের ডেটা ক্লাউড বা হার্ড ড্রাইভে নিরাপদে রাখা।
বিজ্ঞানীদের নজর প্রতি মুহূর্তে সূর্যের উপর
নাসা এবং ইউরোপীয় মহাকাশ সংস্থা (ESA) এর দল ক্রমাগত সূর্যের কার্যকলাপের উপর নজর রাখছে। বর্তমানে, সূর্যের যে অংশে এই বিস্ফোরণগুলি ঘটছে, সেটি ক্রমাগত পৃথিবীর দিকে ঘুরছে। এর অর্থ হলো বিপদ এখনও কেটে যায়নি।
বিজ্ঞানীরা বলছেন যে, সৌর চক্র তার চূড়ান্ত পর্যায়ের দিকে এগিয়ে চলেছে, এবং এই সময়ে সৌর কার্যকলাপ বৃদ্ধি পাওয়া স্বাভাবিক। তবে, এটিও একটি ইঙ্গিত যে আমাদের আমাদের ডিজিটাল এবং বিদ্যুৎ ব্যবস্থাকে আরও শক্তিশালী করার প্রয়োজন।