২০৫০ সালের আগেই পৃথিবীর চারপাশে মহাকাশ হতে পারে অতিরিক্ত ভারাক্রান্ত, বর্ধমান উপগ্রহের সংঘর্ষ এবং মহাকাশ যানজটের আশঙ্কা।
পৃথিবী থেকে হাজার হাজার কিলোমিটার উপরে এমন এক জগৎ বসতি স্থাপন হয়েছে, যেখানে মানুষের কার্যকলাপের গতি থামার নাম নেই। এখানে কোন ট্রাফিক সিগন্যাল নেই, কোন যানজটের ঘোষণা নেই – তবুও মহাকাশ যানজটের উপকূলে দাঁড়িয়ে আছে। ২০২৪ সালে ২,৮০০ এর বেশি নতুন উপগ্রহ উৎক্ষেপণ করা হয়েছে এবং মে ২০২৫ পর্যন্ত পৃথিবীর চারপাশে মোট সক্রিয় উপগ্রহের সংখ্যা ১১,৭০০ ছাড়িয়ে গেছে। এই অবস্থা চলতে থাকলে, ২০৫০ সালের আগেই মহাকাশে জায়গা শেষ হয়ে যেতে পারে।
প্রতি দেড় দিনে একটি রকেট – উপগ্রহের বৃষ্টি
২০২৪ সালেই বিশ্ব প্রায় ২,৮০০ টি নতুন উপগ্রহ মহাকাশে পাঠিয়েছে। অর্থাৎ, গড়ে প্রতি ৩৪ ঘন্টায় একটি নতুন রকেট উৎক্ষেপণ করা হয়েছে। মে ২০২৫ পর্যন্ত মোট ১১,৭০০ এর বেশি সক্রিয় উপগ্রহ পৃথিবীর কক্ষপথে ঘুরছে। এই সংখ্যা দেখায় যে মানুষ কত দ্রুত মহাকাশকে প্রযুক্তির জালে ভরে দিয়েছে।
এই ভিড়ে সবচেয়ে এগিয়ে আছে ব্যক্তিগত কোম্পানিগুলির অবদান। বিশেষ করে এলন মাস্কের কোম্পানি SpaceX, যা তার Starlink প্রকল্পের মাধ্যমে এখন পর্যন্ত ৭,৪০০ এর বেশি উপগ্রহ উৎক্ষেপণ করেছে।
Starlink থেকে শুরু হয়েছে ইন্টারনেটের মহাকাশ অভিযান
Starlink-এর লক্ষ্য হল বিশ্বের প্রতিটি কোণে দ্রুত এবং সাশ্রয়ী মূল্যের ইন্টারনেট পৌঁছে দেওয়া, চাই সেটা পাহাড়ে অবস্থিত গ্রাম হোক বা সমুদ্রের মাঝখানে কোন জাহাজ। কিন্তু এই সুবিধা একটি মূল্যে আসছে – মহাকাশের ভিড় এবং বর্ধমান ঝুঁকি হিসেবে।
Amazonও তার Project Kuiper-এর মাধ্যমে এই প্রতিযোগিতায় যোগ দিয়েছে। এছাড়াও OneWeb এবং চীনের অনেক কোম্পানি তাদের নিজস্ব উপগ্রহ সিরিজ তৈরিতে ব্যস্ত। এই সমস্ত কোম্পানি পৃথিবীকে ডিজিটালভাবে সংযুক্ত করার জন্য একটি নতুন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করছে।
বিজ্ঞানীদের সতর্কতা: সীমিত মহাকাশের ক্ষমতা
পৃথিবী থেকে প্রায় ২০০০ কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত LEO কক্ষপথকে এখন পর্যন্ত নিরাপদ বলে মনে করা হত। বিজ্ঞানীদের অনুমান, এই এলাকা প্রায় ১ লক্ষ সক্রিয় উপগ্রহকে ধারণ করতে পারে। কিন্তু বর্তমান হারে দেখলে এই সীমা ২০৪৫-৫০ সালের মধ্যেই অতিক্রম হবে।
এছাড়াও, সক্রিয় উপগ্রহের সাথে সাথে হাজার হাজার নিষ্ক্রিয় এবং ভাঙা উপগ্রহও একই কক্ষপথে ভাসছে। এগুলো ‘মহাকাশ ধ্বংসাবশেষ’ হয়ে উঠেছে এবং চলমান মিশনের জন্য বিপদ হয়ে উঠেছে।
সংঘর্ষ ও ধ্বংসাবশেষের বর্ধমান সংকট
হার্ভার্ড-স্মিথসোনিয়ান সেন্টারের জ্যোতির্বিজ্ঞানী জোনাথন ম্যাকডোওয়েলের মতে, বর্তমানে মোট প্রায় ১৪,৯০০ উপগ্রহ পৃথিবীর কক্ষপথে রয়েছে। কিন্তু এর মধ্যে হাজার হাজার নিষ্ক্রিয় হয়ে গেছে অথবা তাদের কাজ শেষ হয়েছে।
সমস্যা হল, যখন এই নিষ্ক্রিয় উপগ্রহগুলি নিয়ন্ত্রণ ছাড়াই কক্ষপথে ঘুরতে থাকে, তখন তারা চলমান উপগ্রহের সাথে সংঘর্ষ ঘটাতে পারে এবং ধ্বংসাবশেষ তৈরি করতে পারে। এই ধ্বংসাবশেষ অন্যান্য উপগ্রহের জন্যও বিপদ হয়ে ওঠে এবং একটি ‘ডোমিনো ইফেক্ট’ সৃষ্টি করতে পারে, যার ফলে আরও সংঘর্ষ হতে পারে।
মহাকাশ যানজটের আভাস
এখন বিজ্ঞানীরা বলছেন, যদি এই অবস্থা চলতে থাকে, তাহলে সেই দিন দূরে নয় যখন মহাকাশে ট্রাফিক জ্যামের মতো পরিস্থিতি তৈরি হবে। এই অবস্থায় নতুন মিশন উৎক্ষেপণ করা কঠিন হয়ে উঠবে এবং পূর্বের সক্রিয় উপগ্রহগুলিও ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
যেমন শহরগুলিতে ট্রাফিক জ্যামের কারণে গাড়ি থেমে যায়, তেমনি মহাকাশেও উপগ্রহের গতি এবং পথ বাধাগ্রস্ত হতে পারে। এই পরিস্থিতি মহাকাশ গবেষণা, আবহাওয়ার পূর্বাভাস, নেভিগেশন এবং গ্লোবাল সংযোগের মতো ক্ষেত্রগুলিকে গুরুতরভাবে প্রভাবিত করতে পারে।
সংযোগের নামে কি বিপদ ডেকে আনছি?
একদিকে যেখানে ইন্টারনেট সবার কাছে পৌঁছে দেওয়ার প্রচেষ্টা চলছে, অন্যদিকে তার মূল্য মহাকাশের নিরাপত্তার খরচে বহন করা হচ্ছে।
এখন প্রশ্ন উঠছে, কি আমাদের সর্বত্র ইন্টারনেট দরকার, চাই সেটা মহাকাশের ভিড় এবং সম্ভাব্য সংঘর্ষের বিনিময়েই হোক না কেন?
সমাধান কি?
অনেক দেশ এবং সংস্থা এখন মহাকাশ যানজট ব্যবস্থাপনার দিকে কাজ শুরু করেছে। উপগ্রহ নিয়ন্ত্রণ, নিষ্ক্রিয় উপগ্রহ অপসারণ এবং মহাকাশ ধ্বংসাবশেষ কমানোর জন্য নতুন আইন এবং প্রযুক্তি উদ্ভাবন করা হচ্ছে।
এছাড়াও ‘সাসটেইনেবল স্পেস পলিসি’রও দাবি উঠছে, যেখানে উপগ্রহ উৎক্ষেপণের আগে তার প্রয়োজনীয়তা, সময়সীমা এবং নিষ্ক্রিয়তার পর ধ্বংস করার পরিকল্পনা বাধ্যতামূলক করা হবে।