মহাকাশে প্রথম নারী: ভ্যালেন্টিনা তেরেশকোভার অসাধারণ যাত্রা

মহাকাশে প্রথম নারী: ভ্যালেন্টিনা তেরেশকোভার অসাধারণ যাত্রা
সর্বশেষ আপডেট: 16-06-2025

১৬ই জুনের দিন ইতিহাসের পাতায় সোনালী অক্ষরে লেখা রয়েছে। এই দিনটিই বিজ্ঞান ও মানবতার নতুন এক উচ্চতায় পৌঁছানোর দিন। ১৯৬৩ সালের এই দিনে রাশিয়া (তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন)-এর এক সাহসী নারী মহাকাশে যাত্রা করে ইতিহাস সৃষ্টি করেছিলেন।

নয়াদিল্লি: ১৬ই জুনের দিন ইতিহাসে বারবার স্মরণ করা হয়, কিন্তু ১৯৬৩ সালে এই দিনে যে ঘটনা ঘটেছিল, তা শুধুমাত্র বিজ্ঞান জগতকে নয়, বরং নারীদের ক্ষমতার বিষয়ে পুরো বিশ্বের চিন্তাধারাকেও বদলে দিয়েছিল। এই দিনে সোভিয়েত ইউনিয়নের এক সাধারণ কারখানার কর্মী ভ্যালেন্টিনা তেরেশকোভা মহাকাশে উড়াল দিয়ে এমন এক কাজ করে দেখিয়েছিলেন যা আজ পর্যন্ত কোনও নারী করতে পারেননি। তিনি বিশ্বের প্রথম নারী মহাকাশচারী হয়ে উঠেছিলেন এবং মহাকাশে যাত্রা করে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও নারীশক্তির নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছিলেন।

এক সাধারণ মেয়ে থেকে মহাকাশের অধিনায়ক পর্যন্ত

ভ্যালেন্টিনা তেরেশকোভার জন্ম হয়েছিল ১৯৩৭ সালের ৬ই মার্চ সোভিয়েত ইউনিয়নের মাসলেনিকোভো নামক গ্রামে। তার পিতা ছিলেন একজন ট্র্যাক্টর চালক এবং মাতা ছিলেন একজন টেক্সটাইল কর্মী। ভ্যালেন্টিনা যখন মাত্র দুই বছর বয়সী ছিলেন, তখন তার পিতা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে শহীদ হন। এর পর থেকে তিনি তার মায়ের সাথে মিলে কারখানায় কাজ শুরু করেন।

তার জীবনের পরিবর্তনকারী মোড় তখন আসে যখন তিনি একটি নোটিশ বোর্ডে প্যারাসুটিং ক্লাবের বিজ্ঞাপন দেখেন। ১৯৫৯ সালে তিনি প্রথমবার আকাশ থেকে লাফ দেন এবং এই সাহসী খেলায় তার গভীর আগ্রহ তৈরি হয়। এই শখই পরবর্তীতে তার মহাকাশ যাত্রার ভিত্তি স্থাপন করে।

আমেরিকা-সোভিয়েত মহাকাশ প্রতিযোগিতায় নারীর দাও

১৯৬১ সালে ইউরি গ্যাগারিন প্রথম ব্যক্তি হিসেবে মহাকাশে যান। এই সাফল্য সোভিয়েত ইউনিয়নকে আমেরিকার থেকে এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু সোভিয়েত নেতৃত্ব এখানেই থেমে থাকার সিদ্ধান্ত নেয়নি। পরবর্তী মিশন ছিল - বিশ্বের প্রথম নারীকে মহাকাশে পাঠানো। এর জন্য দেশজুড়ে ৪০০ নারীর মধ্য থেকে পাঁচজনকে চূড়ান্ত প্রশিক্ষণের জন্য নির্বাচিত করা হয়, এবং তাদের মধ্যে ভ্যালেন্টিনাও ছিলেন।

বিশেষ ব্যাপার হল, ভ্যালেন্টিনা পেশাদার পাইলটও ছিলেন না, বিজ্ঞানীও ছিলেন না। তবুও তিনি প্রমাণ করেছিলেন যে দৃঢ় ইচ্ছাশক্তি ও নিয়মশৃঙ্খলা দিয়ে যে কোনও উচ্চতা অর্জন করা সম্ভব।

‘স্টার সিটি’তে কঠোর প্রশিক্ষণ

ভ্যালেন্তিনাকে ‘স্টার সিটি’ নামক গোপন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে পাঠানো হয়, যেখানে তিনি সেন্ট্রিফিউজ পরীক্ষা, অভিকর্ষহীনতা (ওয়েটলেসনেস) অবস্থা, হিট চেম্বার এবং উচ্চতা থেকে লাফ দেওয়ার মতো অনেক কঠিন অনুশীলন করেছিলেন। তার আত্মজীবনী "The First Lady of Space"-এ তিনি লিখেছেন যে সমাজ সবসময় নারীদের ‘দুর্বল’ বলে মনে করেছে, কিন্তু এই প্রশিক্ষণ তাকে সেই ধারণা ভেঙে ফেলার সুযোগ দিয়েছিল।

অবশেষে ১৯৬৩ সালের ১৬ই জুন সেই দিন আসে, যখন ভ্যালেন্টিনা ‘ভোস্তোক-৬’ যানে বসেন। রকেট উড়াল দেওয়ার সাথে সাথেই রেডিওতে তার কণ্ঠস্বর শোনা যায় – "চাইকা, চাইকা (সিগল, সিগল)... সবকিছু ঠিক আছে। মেশিন ভালোভাবে কাজ করছে।" ‘চাইকা’ ছিল তার কোড নেম। এভাবে একজন সাধারণ নারী অসাধারণ কাজ করে পুরো বিশ্বকে চমকে দিয়েছিলেন।

তিনি তিন দিন ধরে মহাকাশে একা ভ্রমণ করেছিলেন এবং পৃথিবীর ৪৮ বার প্রদক্ষিণ করেছিলেন। সে সময়ের জন্য এটি যে কোনও নারীর কল্পনারও অতিক্রম ছিল।

প্যারাসুটিং হয়ে ওঠে জীবনরক্ষাকারী

ভ্যালেন্টিনার প্যারাসুটিংয়ের শখ তাকে শুধুমাত্র নির্বাচিত করেনি, বরং মহাকাশ মিশনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। ভোস্তোক মিশনের বৈশিষ্ট্য ছিল যে, ক্যাপসুল ল্যান্ডিংয়ের সময় যাত্রীকে ক্যাপসুল থেকে আলাদা হয়ে প্যারাসুটের মাধ্যমে নামতে হতো। ভ্যালেন্টিনা এই কাজটি সাবলীলভাবে করেছিলেন এবং সফলভাবে ল্যান্ডিং করেছিলেন। তার উড়ানের পর নারীদের নিয়ে অনেক মিথ ভেঙে গিয়েছে। যেখানে অনেকে এটিকে শুধুমাত্র সোভিয়েত প্রচার বলে মনে করতেন, সেখানে এই উড়ান প্রমাণ করেছিল যে নারীরাও মহাকাশের মতো কঠিন অভিযানে সাফল্য অর্জন করতে পারে। ভ্যালেন্টিনার এই সাফল্য বিজ্ঞানের নয়, বরং নারীশক্তির বিজয়গাথা ছিল।

আজও অনুপ্রেরণা ‘চাইকা’

আজ, ৬১ বছর পরেও, ভ্যালেন্টিনা তেরেশকোভার নাম যখনই উচ্চারিত হয়, তখন তিনি শুধুমাত্র একজন মহাকাশচারী হিসেবে নয়, বরং এক প্রতীক হিসেবে উপস্থাপিত হন - যা বলে যে সাধারণ পরিবারের কোনও মেয়েই বিশ্বের শীর্ষে পৌঁছাতে পারে। আজ ১৬ই জুন তাকে স্মরণ করা শুধুমাত্র ইতিহাস পড়া নয়, বরং সেই উদ্যম ও সাহসকে সালাম জানানো যা মানবতার সীমানা ভেঙে ফেলেছিল এবং মহাবিশ্বে নারীর উপস্থিতি নিশ্চিত করেছিল।

Leave a comment